X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ধর্মের নামে হত্যা নয়

ফারজানা হুসাইন
০৩ জুলাই ২০১৬, ১৪:০০আপডেট : ০৩ জুলাই ২০১৬, ১৪:২০

ফারজানা হুসাইন গত শুক্রবার রাতে ফেসবুকের মাধ্যমে প্রথম জানতে পারলাম গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে কয়েকজন সন্ত্রাসী অস্ত্র হাতে ঢুকে পড়েছে, অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেখেছে সেখানে অবস্থানরত মানুষকে। গুলশান-২ এর আশেপাশে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশের একটি দল ঘটনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। 
রোজা প্রায় শেষ হয়ে আসছে, ঈদের আগে মানুষের নতুন কাপড় কেনার ধুম, ছুটিতে ঘরে ফেরার তাড়া- আর সন্ত্রাসী ঘটনায় ঘণ্টা তিনেক জ্যামে আটকে পড়া মানুষের তীব্র বিরক্তি আর অসহিষ্ণুতা ছাপিয়ে তখনও ঘটনার গুরুত্ব আমরা কেউই বুঝে উঠতে পারিনি ঠিকমত। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলা ট্রিবিউনের জাকিয়া আহমেদের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানলাম পুলিশের একজন ওসি নিহত, আহত অনেকেই। যেন নড়েচড়ে গেল পুরো বাংলাদেশ। রাত যতই গভীর হলো ততই বিস্তারিত সংবাদ জানতে পারলাম আমরা। হামলার দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেট (আইএস) তাদের মিডিয়া 'আমাক'-এ পোস্ট দিল। সে এক ভয়ঙ্কর অনুভূতি! সারা রাত জেগে আমরা বসে রইলাম টিভির সামনে, আপডেটের জন্য একটু পরপর খোঁজ নেই সিএনএন, বিবিসি আর বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকায়।
প্রায় পনেরো ঘণ্টা পরে, শনিবার সকালে এই ভয়াবহ ঘটনার শেষ হলো সম্মিলিত বাহিনীর অভিযান 'অপারেশন থান্ডারবোল্ট'-এর মাধ্যমে। ১৩ জন জিম্মিকে জীবন্ত উদ্ধার করা হলো, কিন্তু ততক্ষণে ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিক, দুইজন পুলিশ কর্মকর্তাকে চিরতরে হারিয়েছি আমরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার রাতে জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ দিয়েছেন, দুই দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহু আকবার বলে তরবারি হাতে অতর্কিত আক্রমণ করে একরাতেই বিশজন মানুষকে হত্যা করার মতো বিভৎস ঘটনা আমাদের দেশে এই প্রথম। কিন্তু ধর্মের ঢালের আড়ালে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদী যে কার্যকলাপ সেই ২০০১ সালের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, ইস্তাম্বুলে বোমা বিস্ফোরণ আর শুক্রবার রাতের গুলশানের হলি আর্টিজানের বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি আর হত্যা করা সেই জঙ্গিবাদের সম্প্রসারণের কিছু সাম্প্রতিক উদাহরণ মাত্র। আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ান শক্তিকে অপসারণের জন্য মার্কিনি মদদে জন্ম নেয় জঙ্গিবাদী গ্রুপ মুজাহেদীন, এই মুজাহেদীন হলো আল কায়েদার পূর্বসূরি। ৯/১১ এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, মিত্র বাহিনীকে নিয়ে তারা আক্রমণ করে আফগানিস্তান, ইরাক আর সর্বশেষ সিরিয়া। সিরিয়ার বাশার সরকারের পতনের উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয় অস্ত্র। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ইরাকে সন্ত্রাসবিরোধী মার্কিন হামলা চলাকালীন সময়ে বাগদাদের আবু গারিব কারাগার হয়ে ওঠে সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গিদের স্থান। ইসলামিক স্টেটসের নেতাদের অনেকেই এই কারাগারে একই সময়ে অবস্থান করে এবং এই স্থান থেকেই ইসলামিক স্টেটসের ধারণার জন্ম বলে উল্লেখ আছে। বারবার সন্ত্রাসী হামলার মুখে পড়ে পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে, তাই পশ্চিমা বিশ্বের ইমিগ্রেশন আইন হঠাৎ করেই কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে উঠেছে। নিজেদের বাড়ির দরজা বন্ধ করে আইসিস আর আল কায়েদার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ব্যস্ত ওরা। সুতরাং সন্ত্রাসবাদ আর জঙ্গি বাহিনী ঢুকে পড়ছে আফ্রিকা আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে।

‘আমার দেশে কোনও জঙ্গি নেই’, আইএস- আল কায়েদার মতো উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশি কেউ জড়িত থাকতে পারে না- এ জিম্মি আর হত্যাকাণ্ড যেন আমাদের বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে। শুক্রবার রাতের হলি আর্টিজানের নাশকতার ঘটনায় গোটা বাংলাদেশ প্রকম্পিত, নড়ে গেছে বিশ্বাসের ভিত। এরকম পরিস্থিতিতে শুধু সরকার আর নিরাপত্তারক্ষাকারী বাহিনী নয় বরং একত্রিত হতে হবে দল, মত, ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে। কিন্তু চোখ কান খোলা রাখলেই আমরা বুঝতে পারবো অনৈক্য আর বিভেদের সুর সর্বত্র। একদল দোষ দিচ্ছে প্রধান বিরোধীদল সহ ইসলামপন্থী দলগুলোর ওপর, অন্যদল বলছে সরকার বিরোধীদলকে দমননীতি আর ধরপাকড় অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে যা এর জন্য দায়ী। শুক্রবার রাতের ওয়াশিংটন পোস্ট এই সুযোগে আঙুল তুলেছে মানবতাবিধোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রমের ওপরে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা সিএনএন বলছে, বাংলাদেশের রাজধানীতে এ ধরনের বড়সড় সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড বিস্ময়কর কিছুই নয়। এ যেন সবার জানাই ছিল। বাংলাদেশকে এই মূল্য দিতে হয়েছে জঙ্গিদমনে সরকারের নমনীয় নীতির কারণে, এমনটাই বলছে পশ্চিমা মিডিয়া।
সমগ্র দেশবাসী যখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় টেলিভিশনের সামনে সারারাত বসে ছিল তখন টানা দশ ঘণ্টায় ও সরকারের পক্ষ থেকে কোনও মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী সামনে এগিয়ে আসেননি, কোনও বক্তব্য দেননি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে। সরকারের এহেন নিস্তব্ধতা সবাইকে আশাহত করেছে। মূল ঘটনার প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পরে শনিবার রাতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তাকে কিছুটা বিচলিত এবং নিস্তেজ লেগেছে। সবাই যখন আশা করেছিল, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তিনি শক্ত অবস্থানের কথা ঘোষণা করবেন তখন প্রধানমন্ত্রীকে কিছুটা হতবিহবল আর সংশয়গ্রস্ত মনে হয়েছে। একথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, হলি আর্টিজানের মতো সংঘবদ্ধ আর সুপরিকল্পিত সন্ত্রাসবাদের ঘটনা ঘটার নজির বাংলাদেশে এর আগে না থাকলেও, গত দুই-তিন বছরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জঙ্গি নাশকতার ঘটনা পত্রিকার পাতায় উঠে আসছিল প্রায়ই। নাস্তিকতার দোহাই দিয়ে ব্লগার হত্যা তো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে উঠেছিল। মুক্তবুদ্ধি আর জ্ঞানের চর্চাকে সরকারের মন্ত্রীরা জনসমক্ষে কটাক্ষ করেছেন, বলেছেন ধর্মের বিপক্ষের কোনও আলোচনার দায় ওই ব্যক্তিকেই নিতে হবে, নাস্তিকতাকে বাংলাদেশে স্থান দেওয়া হবে না।

একের পর এক জঙ্গি আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরও দেশের অভ্যন্তরে কোনও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের সংঘবদ্ধ কার্যক্রমকে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার উপেক্ষা আর অস্বীকার করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দোষারোপ করা হয়েছে বিরোধীদল আর জামাত-শিবিরকে। বিরোধী দল বিএনপি দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য দায়ী করেছে খোদ সরকারকে। সার্বিকভাবে আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে, রাজনীতির এই দ্বিপাক্ষিক ব্লেমগেইমে চিড়েচ্যাপ্টা দেশের সাধারণ মানুষ।

এই সুযোগে জঙ্গিরা সংঘবদ্ধ হয়েছে, প্রকাশ্যে চাপাতি চর্চা হয়েছে, গত দুই বছরের বিভিন্ন সময়ে বিদেশি নাগরিক, ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি, ধর্মীয় আর সেক্সচুয়াল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে জঙ্গিরা। গুলশানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ডিপ্লোম্যাট এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতখানি ঠুনকো তার প্রমাণ দেয় সাত-আটজন জঙ্গির বন্দুক, পিস্তল, গ্রেনেড আর ধারালো অস্ত্রশস্ত্র সহ অবলীলায় ঢুকে পড়ার ঘটনায়। আমরা বড়সড় সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম মোকাবেলায় কতখানি অগোছালো আর অদূরদর্শী তার প্রমাণ জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে দুইজন পুলিশ কর্মকর্তাকে। তবে, শুক্রবার রাতের হামলা আগের অন্যান্য হামলার চেয়ে অনেকটা ভিন্ন। ব্লগার হত্যাসহ সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের হত্যাকাণ্ডে খুনি ছিল দুই-তিনজনের দল, যারা হত্যা শেষে পালিয়ে গেছে। কিন্তু গুলশানের এই রেস্টুরেন্টে অবস্থানগত কারণে ধারণা করা যায় এই হামলাকারীরা আত্মঘাতী, হামলা শেষে বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা নেই জেনেই এসেছিল তারা। উপরন্তু এবারের হামলাকারীরা সাত-আটজনের সংঘবদ্ধ দল, কেবল চাপাতি নয় বরং বন্দুক, পিস্তল, গ্রেনেডের মতো অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই সুপরিকল্পিত এবং সুগঠিত হামলা করেছে। তাই, হলি আর্টিজানের হামলাকে পূর্বের ঘটনার মতো বিচ্ছিন্ন ঘটনার তকমা দেওয়ার কোনও অবকাশ নেই।

ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান। দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গিরা আস্তানা গাড়ছে, আল-কায়েদা কিংবা আইএস এর অবস্থান ঠাহর করা যাচ্ছে- এ তথ্য স্বীকারে কোনও লজ্জা নেই। আল-কায়েদা বা আইএস কোন নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা নয়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ রুখতে কাউন্টার টেরোরিজম এখন বৈশ্বিক রাজনীতির মূলকথা। হলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলা আমাদের জন্য ওয়েক আপ কল। সমস্যার দিকে আঙুল তুলতে পারার ক্ষমতাই সমস্যা নিরোধের পথে অনেকখানি এগিয়ে দেবে আমাদের। রাষ্ট্রযন্ত্রের দেহে পচন ধরতে শুরু করেছে, একথা স্বীকার করলেই কেবল পচন প্রতিরোধ আর প্রতিকারের সম্ভাবনা থাকে। নতুবা বংলাদেশকে ও যে খুব শিগগিরই জঙ্গিবাদী দেশ হিসাবে আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের পাশের সারিতে দাঁড়াতে হবে তা বলতে দ্বিধা নেই।

পশ্চিমা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য থাকে জনসাধারণ আর স্থাপনা। অপরদিকে এশিয়া কিংবা আফ্রিকার দেশগুলোতে জঙ্গিদের টার্গেটে পরিণত হয় বিদেশি নাগরিক আর ব্যুরোক্রেটসরা, জিম্মি নাটকের মূল লক্ষ্যই পশ্চিমা মিডিয়ার মনোযোগ পাওয়া। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত যে সতেরজন বিদেশি নাগরিকের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হয়েছে, এই মৃত্যুর এখানেই শেষ নয়। নিঃসন্দেহে এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন দেশের আমদানি-রফতানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ আর চুক্তিতে, আন্তর্জাতিক লেনদেনের সম্পর্কেও। তাই এই হামলার দায় এড়াতে পারেন না প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রযন্ত্র।

২.

শুক্রবার রাতের জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি বিষয় আমাদের নজরে এসেছে, প্রফেশনাল জার্নালিজম বা পেশাদারিত্বমূলক সাংবাদিকতা। বিভিন্ন সময়ের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে এখন টিভি চ্যানেলের ছড়াছড়ি। কোনও মান নিয়ন্ত্রণ বা কাঠামোর মধ্যে না এনে যাকে তাকে ইলেকট্রনিক আর ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার মালিকানা আর অংশগ্রহণ দেওয়া হয়েছে। এই মিডিয়াগুলো কী ধরনের খবর প্রচার-প্রসার করছে, বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচারের সাংবাদিকতার ন্যুনতম এথিক্স আর পেশাদারিত্বের মনোভাবকে কতটা জিইয়ে রেখে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে তা নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই, ফিরে দেখার সময়ই নেই। সরকার এসব বেসরকারি মিডিয়াকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আজ অব্দি সুস্পষ্ট কোনও গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়ন না করায়, টিভি চ্যানেলগুলো টিএরপি বাড়াতেই কেবল উন্মুখ।

দর্শকের চোখের সামনেই অল্প সময়ে 'কেউকাটা' উপস্থাপক বা সাংবাদিক বনে যাওয়া সাংবাদিকেরা কতটা ‘সাংঘাতিক’ তার প্রমাণ শুক্রবার রাতের হলি আর্টিজানের ঘটনার লাইভ টেলিকাস্ট। জঙ্গি হামলার ঘটনাস্থল থেকে একজন অসহায় জিম্মি ফোনে নিজের নাম আর অবস্থানের কথা জানিয়ে গণমাধ্যমের কাছে সাহায্য চায় অথচ ঘটনার গুরুত্ব না বুঝে কেবল দর্শক কাটতি বাড়ানোর জন্য স্বনামধন্য সাংবাদিক জিম্মির সব তথ্য, পুলিশ আর নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা টিভিতে সম্প্রচার করেন। বাজার কাটতির নেশায় লোলুপ সাংবাদিক কি একবার চিন্তা করে দেখেছিলেন যে ঘটনার স্থলে টেলিভিশন আছে, এই তথ্য হামলাকারীরাও জানতে পারবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমকে সতর্ক করে দিয়েছেন শনিবার সকালে। ‘আমি যেমন দিতেও পারি, আবার নিতেও পারি’- এই সতর্কবাণী কেন সরকার প্রধানকে করতে হবে? র‌্যাব মহাপরিচালকের অনুরোধের পরে জঙ্গি হামলার লাইভ প্রচার বন্ধ হয় না কেন? বস্তুনিষ্ঠ আর নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার করা যাদের আরাধ্য, তারা দেশের ভয়ঙ্কর সময়ে সামান্য বুদ্ধিমত্তার কেন প্রমাণ দেবেন না, দায়িত্বজ্ঞানের কোনও বালাই থাকবে না কারও? এসবের একটাই কারণ, এতদিনেও কোন সম্প্রচার নীতিকাঠামো দাঁড় করতে না পারা। একটু চটকদার কিছু করার জন্য, সবার আগে ঘটনার যে কোন মনগড়া কাহিনি বলে বাজার কাটতি বাড়ানোর আগে স্মরণ করা দরকার - with great power, comes great responsibility.

৩.
শনিবার রাত থেকে অসমর্থিত সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে কতিপয় বিশ বাইশ বছরের তরুণের ছবি। গুলশানের জিম্মি আর হত্যাকাণ্ড এরাই ঘটিয়েছে বলে চাউর করা হচ্ছে মিডিয়ায়। সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনও নিশ্চিত খবর পাওয়া যায়নি। সাংবাদিকদের কাছে বিনীত অনুরোধ থাকবে, এই ছবির ছেলেগুলোর পরিবার আছে, এই ছবিগুলো শুধু কিছু ছবি নয়। আমরা যেন আবারও দর্শক-পাঠক আকৃষ্ট করার চেষ্টায় এই পরিবারগুলোর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করি, পরিবারগুলোকে জনরোষ আর ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে না দেই। এখানে উল্লেখ করবো, ২০০৫ সালের লন্ডন পাতালট্রেনে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা। ওই আত্মঘাতী বোমা হামলার পর ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয় বোমা হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীদের পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার এবং নিরাপত্তার স্বার্থে ওই পরিবারগুলোর পরিচয় গোপন করা হয়। আমাদেরও উচিত হবে সরকারের অনুমতি ছাড়া সন্দেহভাজন বা সন্ত্রাসী কারও পরিচয় গণমাধ্যমে প্রকাশ না করা।
শুক্রবার রাতের জঙ্গি হামলায় দেশের সবার সঙ্গে-সঙ্গে সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী আর গণমাধ্যম সবাই অপ্রস্তুত আর আতঙ্কিত। এই ধরনের জঙ্গি হামলা আমাদের দেশে প্রথম তবে এটাই শেষ নয়। জঙ্গি প্রতিরোধে কঠোর আইন আর পদক্ষেপ নিতে হবে, জিরো টলারেন্স অন টেরোরিজম দেখাতে হবে সরকারকে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এধরনের কোনও হামলার ঘটনা মোকাবেলায় অন্ততপক্ষে রাজধানীতে প্রস্তুত রাখতে হবে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটিলিয়নের এমন একটি দলকে যারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো অপারেশনকে সফলভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম। হামলার ঘটনা ঘটার পর সিলেট থেকে, সাভার থেকে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রশিক্ষিত কমান্ডোদেরকে ঢাকায় নিয়ে আসার মতো সময়ক্ষেপণের কোনও যুক্তি নেই। উপরন্তু যে কোনও জিম্মি ঘটনায় সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে হামলাকারীদের সঙ্গে আলোচনার বা সমোঝতার পরিস্থিতির দেখা দেয়। আটকে পড়া প্রতিটি মূল্যবান জীবনের কথা মাথায় রেখেই কমান্ডো অপারেশন সহসাই শুরু করা যায় না। তবে আত্মঘাতী হামলাকারীরা যেহেতু প্রাণ নিয়ে ফেরত যাওয়ার কথা মাথায় রাখে না, তাই জিম্মিদের ওপর হামলার শুরুতেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাতে তারা কালক্ষেপণ করে না। এ পরিস্থিতিতে আলোচনার জন্য কতটা সময় পার করা উচিত, অপারেশনে কতটা দেরি করা উচিত তা আবারও ভাবার বিষয়। নিরাপত্তা বাহিনী আর মিডিয়ার মাঝে কাজের সমন্বয় সাধন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অসমর্থিত সূত্রের বরাত দিয়ে এলোমেলো খবর প্রকাশ না করে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিরাপত্তাবাহিনীর মুখপাত্র মিডিয়ার সামনে আসলে আদতে জনগণ অসমর্থিত সূত্রে পাওয়া খবরে বিভ্রান্ত হবে না। হামলাস্থলে পৌঁছানো মাত্র নিরাপত্তা বাহিনীর প্রথম দলটির কাজ হবে ইয়োলো টেপিং বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা মার্ক করা, মিডিয়া ও উৎসুক জনতা এই এলাকার বাইরে অবস্থান করবে। এতে করে মিডিয়া ও পথচারীর নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করা যাবে, একইসাথে কমান্ডো বা অন্য অপারেশনের কৌশলগত বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করা সহজ হবে।
তবে সব দায়িত্ব শুধু সরকার, নিরাপত্তারক্ষাকারী বাহিনী আর গণমাধ্যমকে চাপিয়ে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার ও কোনও অবকাশ নেই আমাদের। এই জঙ্গিরা দেশের বাইরে থেকে আসেনি, এরা সবাই আমাদের সন্তান, ভাই, বন্ধু। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, অস্বাভাবিক কোনও আচরণ করছে কী না সেসব লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব একান্তই পরিবারের।
পরিশেষে বলবো, এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়। আমার দেশের সংবিধান নিশ্চিত করে ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতি শান্তিপ্রিয় জাতি। এ দেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর ধর্ম ইসলাম যার অর্থ শান্তি। আমরা ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। আমরা সেই ধর্মনিরপেক্ষ সোনার বাংলাকে আবারও ফিরে চাই।

মঙ্গল প্রভাতে
মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
উদার আলোক মাঝে
উন্মুক্ত বাতাসে।।


লেখকঃ আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী
[email protected]

আরও খবর: গুলশানে জিম্মি অবস্থার তিনটি ভিডিও

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ