X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

তনু ও মিতু হত্যাকাণ্ডের মিল যেখানে

সালেক উদ্দিন
০৯ জুলাই ২০১৬, ১২:৪৯আপডেট : ০৯ জুলাই ২০১৬, ১২:৫৪

Salek Uddinপৃথিবীর সকল মানুষের হাসি ও কান্নার মধ্যে অদ্ভুত একটা মিল আছে। কথাটা কয়েকযুগ আগে ছেলেবেলায় আমাদের সেই প্রত্যন্ত গ্রামে এক বড়ভাইয়ের মুখে শুনেছিলাম এবং এই কথাটির মর্মার্থ অবাক হয়ে অনুধাবনের চেষ্টা করেছিলাম। গ্রামের সেই বড় ভাইয়ের সেই কথা এতই মনে ধরেছিল যে চার যুগ পরেও তা অবিকল মনে আছে। আর সেই হাসি কান্নার মিলের মতই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সংঘটিত দুটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যেও একটি সুস্পষ্ট মিল দেখতে পাচ্ছি।
প্রথম হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল কুমিল্লায় আর দ্বিতীয়টি চট্টগ্রামে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে হত্যা করা হয়, চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার তিন মাস আগে। কুমিল্লা সেনানিবাসের একটি জঙ্গল থেকে ২০ মার্চ রাতে তনুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। সাধারণ অপরাধীদের পক্ষে সেনানিবাস এলাকায় খুন করে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া তনুর পরিবার থেকে সেনাবাহিনীর দুইজন সদস্যের নাম এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত বলে সরাসরি অভিযোগ করা হয়েছিল। আর সে জন্যেই এই হত্যাকাণ্ডটিকে নিয়ে সব মহলে ব্যাপক আগ্রহ ও চাঞ্চল্য তৈরি হয়। এই হত্যার বিচার দাবিতে সারাদেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়। সভা হয় সমাবেশ হয় মিছিল হয় মানববন্ধন হয় । তারপরও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ তনুর পরিবারের সদস্যরাই এখন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ঘটনাটিকে আড়াল করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। শুরু থেকেই তদন্ত কাজে ঢিলাঢালা ভাব লক্ষ করা যাচ্ছিল। দুইবার ময়নাতদন্ত করতে হয়েছে। প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। এতে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি, আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। অনেকেই মনে করেছে কারও স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এরপর দাবির মুখে তনুর লাশ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত হলে এবং দীর্ঘ টালবাহানার পর প্রকাশিত সেই প্রতিবেদন। সেটা দেখার পর ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে বলে অধিকাংশ মানুষই আর মনে করছেন না। মনে করছেন ক্ষমতাধর কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বাঁচানোর জন্যই এরকমটি করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডটি ঘটে জুন মাসে। চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু ৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় শহরের জিইসি এলাকায় গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন। পুলিশ বাহিনীতে চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে বাবুল আক্তারের একটা ইমেজ ছিল। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার জন্য তিনি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন। সঙ্গত কারণেই সবাই ধরে নিয়েছিল এটা জঙ্গিদের কাজ। পরে পুলিশি অভিযানে এই মামলায় যাদের গ্রেফতার করা হলো, যারা আদালতে হত্যার স্বীকারোক্তি করলো তারা কেউ জঙ্গি নয়। তাদের কেউ কেউ পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতো।

বিষয়টি আরও ঘোলাটে হয়ে গেল যখন এসপি বাবুল আক্তারকেই পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে গভীর রাতে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হলো এবং বিষয়টি নিয়ে কড়া গোপনীয়তা অবলম্বন শুরু হলো। দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে মানুষ জানলো পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাবুল আক্তারকে দুটো অপশন দিয়েছেন- তাকে হয় জেলে যেতে হবে, না হয় পুলিশের চাকরিতে ইস্তেফা দিতে হবে। বাবুল আক্তার নাকি দ্বিতীয় অপশন মেনেও নিয়েছেন এবং চাকরিতে ইস্তেফা দেওয়ার পত্রে স্বাক্ষর করে এসেছেন।

ওদিকে মিতুকে হত্যাকারী ভাড়াটে খুনিরা স্বীকার করেছে তারা পুলিশের সোর্স মুছার নির্দেশে খুন করেছে। খুনের আগে মুছা তাদের জন প্রতি পাঁচ শ টাকা করে দিয়েছিল এবং খুনের পরে জন প্রতি আরও পনর শ টাকা করে দিয়েছে। খুনে মুছা নিজেও অংশ নিয়েছিল। পুলিশ বলছে মুছা পলাতক। আর মুছার স্ত্রী বলছে পুলিশ মুছাকে তুলে নিয়ে গেছে। মানুষ ধারণা করছে আর একটি কথিত বন্দুকযুদ্ধে একদিন মুছার মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যাবে এবং মিতু হত্যার নির্দেশ দাতার নাম কেউ কোনওদিন জানতে পারবে না।

কুমিল্লার কলেজ ছাত্রী ও নাট্য কর্মী সোহাগী জাহান তনুর হত্যা আর চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার  স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর হত্যার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও এক জায়গায় অভিন্নতা লক্ষ করা যায়। তা হলো দুটি হত্যাকাণ্ডের বিষয়েই বেশ রাখঢাক করা হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দুটিই বেশ স্পর্শকাতর। কেঁচো খুঁড়তে শাপ বের হওয়ার ভয়ে প্রশাসন তটস্থ। দুটি হত্যারই তদন্ত ঘিরে রহস্য খোলাসা হওয়ার চেয়ে তা আরও জটিল হতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে কাউকে রক্ষা করার চেষ্টা চলছে।

তনুর পরিবারের সদস্যরা তো সরাসরি অভিযোগ করেছে যে, সেনাবাহিনীর দুইজন সদস্য তনুকে হত্যা করেছে- যা সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা তাদের নাম সহ জেনেছি। তারা আরও বলেছে সেনাবাহিনীর অনুষ্ঠানে গান না গেয়ে শ্রীমঙ্গল বেড়াতে যাওয়ায় প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে তনুকে হত্যা করা হয়েছে।

অপরপক্ষে মিতু হত্যার ক্ষেত্রেও স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে জেলে যাওয়া অথবা চাকরি থেকে ইস্তেফা দেওয়ার শর্ত আরোপ করা, পুলিশের সোর্স মুছার বিষয়ে রাখঢাক ভালো লক্ষ্মণ নয়।

দুটি ক্ষেত্রেই মানুষ মনে করছে অপরাধীকে রক্ষা করার বা আড়াল করার চেষ্টা চলছে। গুঞ্জন রয়েছে অপরাধী নিশ্চয়ই এমন কেউ, যাকে রক্ষা করা জরুরি।

প্রশ্ন হচ্ছে কেন অপরাধিকে রক্ষা বা আড়াল করতে হবে? সেনাবাহিনীর বা পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য এমনটি করার কথাইবা মানুষের মনে আসবে কেন?

তনুর মা’র মতো একজন অতি সাধারণ মহিলা যখন বলতে পারেন, ‘আমরা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলিনা, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলিনা। তবে সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য আমার মেয়েকে হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই’। সেখানে আমাদের কেন ভাবতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুই এক জন সদস্য অপরাধ করলে তাদের বিচারের আওতায় আনা যাবে না? কেন এতে পুরোবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হবে?

দেশের ক্ষমতাসীন কেউ যদি এমনটি ভেবে থাকেন তবে ভুল করবেন এবং প্রকৃতির নিয়মেই তাদেরও এর ফল ভোগ করতে হবে।

প্রকৃতির নিয়ম কথাটি লিখতেই একটি বহুল প্রচারিত ঘটনা বা গল্প মনে পড়লো। গল্পটি এমন- ছোটবেলার দুই বন্ধু ব্যবসা করতে তৎকালীন বার্মায় গিয়ে বেশ অর্থশালী হয়েছিল। এমন সময় শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানীরা বার্মা আক্রমণ করে মানুষদের কচুকাটা শুরু করলে দুই বন্ধু ঠিক করলো তাদের অর্থ সম্পদ নিয়ে তারা দেশে ফিরে যাবে। যে কথা সেই কাজ। দুইবন্ধু দেশে ফিরে আসছে। পথিমধ্যে তুমুল বৃষ্টি। বন্ধুরা নির্জন এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিল। এমন সময় শক্তিশালী বন্ধুটির মনে হলো যদি কমজোর বন্ধুটিকে মেরে ফেলা যায় তবে পুরো অর্থের মালিক তো সে নিজেই হয়ে যাবে। যে ভাবনা সেই কাজ। শক্তিশালী বন্ধুটি কমজোর বন্ধুটির গলা চিপে ধরলো। মৃতপ্রায় বন্ধুটির বাঁচার জন্যে সে কী আকুতি! শেষ পর্যন্ত বলল, ‘আমাকে মারলে তুমিও বাঁচবে না, তোমার বিচার হবে, তোমার ফাঁসি হবে’। ঘাতক বন্ধু অট্টহাসি হেসে বললো, ‘সাক্ষী কোথায়? সাক্ষী ছাড়া বিচার হয় না। কে খুনের সাক্ষী দেবে? কে দেখেছে যে আমি তোকে খুন করলাম?’

মৃতপ্রায় বন্ধুটি চারদিকে কাউকে না দেখে বললো, ‘ওই যে পটকা (বৃষ্টির পানির ফোঁটা মাটিতে যে বুদবুদ সৃষ্টি করে) দেখেছে।’

এরপর অনেকদিন। যুদ্ধ শেষ হলো। মৃত বন্ধুর অর্থকড়ি নিয়ে বেশ সুখের দিন কাটছিল ঘাতক বন্ধুর। পাশের গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে বিয়ে করলো সে। শুরু হলো সুখের সংসার।

একদিন এক বৃষ্টির বিকেল। স্বামীর চোখ পড়লো বাইরের বৃষ্টির পানির পটকার ওপর। মনে পড়লো মৃত বন্ধুর কথা ‘ওই যে পটকা দেখেছে। পটকা সাক্ষী দেবে’। অট্টহাসি হেসে উঠলো সে। স্ত্রী সেই হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে স্বামী বলল, ‘ও কিছু না। এমনেতেই হেসেছে’। স্ত্রীর কৌতূহলী মন এতে নিবৃত হওয়ার নয়। এই উত্তরে সে সন্তুষ্ট হলো না।শুরু হল তার আহ্লাদী পিড়াপীড়ি। প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর সেই অনুরোধে একপর্যায়ে পটকা সাক্ষী দেওয়ার ঘটনাটি বলেই ফেললো স্বামী। এরপর স্ত্রী বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে আর ফিরে এলো না। ভাবলো, যে মানুষ স্বার্থের জন্য তার ছেলেবেলার বন্ধুকে খুন করে গোপন করতে পারে সে তার স্ত্রীকে খুন করেও গোপন করতে পারবে।

স্বামী নাছোড় বান্দা। ভাবলো, তার সুন্দরী স্ত্রী অন্যকোনও পুরুষের মোহে পড়েছে। দুই গ্রামের মানুষ নিয়ে শালিস বসলো। জোর করে স্ত্রীকে স্বামীর বাড়ি পাঠাবার জন্যে সবাই যখন একমত তখন স্ত্রী পটকার কাহিনিটি অর্থাৎ স্বার্থের জন্যে তার স্বামীর বন্ধু হত্যার ঘটনাটি বলতে বাধ্য হলো।
তারপর যা হওয়ার তাই হলো। বন্ধু হত্যার দ্বায়ে ফাঁসি হলো ঘাতক বন্ধুর।
প্রকৃতির প্রতিশোধ বড় কঠিন। তাইতো প্রকৃতির নিয়মে পটকাও সাক্ষী দেয়। অপরাধীকে তার জীবদ্দশায়ই অপরাধের ফল ভোগ করতে হয়।
তারপরও মানুষ মনে করতে পারে আলোচ্য খুন দুটোর হোতারা পার পেয়ে গেছে। অপরাধের বিচার হবে এমন আশা উবে গেছে। আসলে কি তাই? না, তা নয়। এই হত্যাকাণ্ড যে রাঘব বোয়ালই করুক বা যে জঙ্গি গোষ্ঠীই করুক কিংবা বিশেষ কোন বাহিনীর লোকজনই করুক, জনগণ তাদের কাঠগড়ায় দেখতে চায়। প্রকৃত সত্য ঢাকতে আর কোনও নতুন নাটক দেখতে চায় না।

আমরা আশা করবো তনু এবং মিতুর  হত্যাকারীদেরকে আড়াল করা হবে না। যদি আড়ালের চেষ্টা করা হয় তবে সেটা হত্যাকারীকে উৎসাহিত করা হবে এবং আরও হত্যার পথ প্রশস্ত করে দেওয়া হবে। তারপরও যদি তাই করা হয় প্রকৃতির প্রতিশোধ কাউকেই ছাড়বে না।          

লেখকঃ কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

আরও খবর: অনেকে ভুল ব্যক্তির ফাঁদে পড়ে ভুল ইসলাম শিখছেন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
লখনউ ও চেন্নাইয়ের অধিনায়ককে ১২ লাখ রুপি জরিমানা 
লখনউ ও চেন্নাইয়ের অধিনায়ককে ১২ লাখ রুপি জরিমানা 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ