X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ম নিয়ে ব্যবসা লাভজনক হবে না

আনিস আলমগীর
১২ জুলাই ২০১৬, ১৩:৪১আপডেট : ১২ জুলাই ২০১৬, ১৪:০৪

আনিস আলমগীর তথ্য ও প্রযুক্তির বিকাশ আজ এতো চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, বিশ্বের যে কোনও প্রান্ত থেকে ইন্সট্রাকশন নিয়ে অপরাধ সংগঠন করা এবং আবার অপরাধ সংগঠিত করার পর তার চিত্র বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া অতি সহজ হয়ে গেছে। গত ১ জুলাই শুক্রবার রাত পৌনে নয়টা থেকে ঢাকার গুলশানের রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসীদের হত্যাযজ্ঞ চালানোর এবং তাৎক্ষণিকভাবে ছবিসহ বহির্বিশ্বে প্রকাশ করার ঘটনা আবারও সেই প্রমাণ দেয়।
তথ্য ও প্রযুক্তির কারণে সব দেশের সন্ত্রাসীরা এখন এক সরলরেখায় এসে উপস্থিত হয়েছে। ধীরে ধীরে ভিন্নতা মুছে যাচ্ছে। সুতরাং কে আল-কায়দা, কে আইএস, কে জেএমবি আর কে আনসার আল ইসলাম- সে বিতর্ক এখন অহেতুক। তারা সবাই বিবেকহীন সন্ত্রাসী এটাই সত্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এদের স্রষ্টা। দীর্ঘদিন সুন্নি জিহাদিদের সিআইএ সৌদি আরবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এরা ইরাক যুদ্ধ সৃষ্টি করে সাদ্দামের সেনাবাহিনীকে কর্মচ্যুত করেছে। এরাইতো এখন আইএস হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইএস-এর মূল ঘাঁটি থেকে আইএস উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত না নেবে ততদিন পর্যন্ত বিশ্ব আইএস মুক্ত হবে না। আমেরিকা তার মূল পরিকল্পনার পরিবর্তন আনবে কিনা কে জানে। তারা যদি তাদের পরিকল্পনার পরিবর্তন না আনে তবে বিশ্ব সহজে আইএস মুক্ত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।
১ জুলাই গুলশানের হত্যাযজ্ঞে দায় আইএস স্বীকার করেছে। আইএস- এর আমাক নিউজ এবং সাইট ইন্টালিজেন্স ১ জুলাই রাতে গুলশান ঘটনা নিয়ে সারারাত সক্রিয় ছিল। তুরস্কের বিমানবন্দরে সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় সব সন্ত্রাসী ছিল বাইরের তুরস্কের স্থানীয় কোনও লোক ছিল না। এমন কী বিদ্রোহী কুর্দিদেরও কেউ ছিল না। এরা চেচনিয়া আর কাজাকিস্তানের লোক। ইস্তাম্বুলের ব্যাপারে আইএস-এর দায় স্বীকারের যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের কোনও যুক্তি গোয়েন্দাদের কাছে টিকছে না। তারা মনে করে গুলশান ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব জঙ্গিই স্থানীয়। তারা জেএমবির লোক। জেএমবির জন্ম আইএস-এর আগে। আইএস জন্মের আগেই জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক আব্দুর রহমান এবং ছিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। শোলাকিয়ার ঘটনার সঙ্গেও যারা জড়িত তারাও স্থানীয় এবং জেএমবির লোক। সুতরায় এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা আইএস দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে পারে কিন্তু আইএস নয়। বাংলাদেশে ইসলামি সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসের মূল কারণ যুদ্ধাপরাধদের বিচার এবং ফাঁসি। বিচারটাকে বানচাল করার জন্য সন্ত্রাসের সূচনা। ১৯৭৫ সালের পরে জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়ার সময়ে জামায়াতে ইসলামী সংগঠনিকভাবে, অর্থে ভিত্তে সুপ্রতিষ্ঠিত সংগঠনের রূপ নিয়েছে।

দেশে সংগঠিত জঙ্গি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জামায়াত নিরব। ১৫০/২০০ সন্ত্রাসী যুবক এতো সুক্ষ্মভাবে সন্ত্রাসী কাজ চালাতে পারতো না যদি জামায়াত ইসলামী তার পেছনে না থাকতো। দেশব্যাপী জামায়াতের নেটওয়ার্ক রয়েছে। শোলাকিয়ার যে বড় ভাই থাকার ঘর ঠিক করে দিয়েছিল সেও জামায়াত। জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী যে সব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তার মূলধন নাকি ১২ হাজার কোটি টাকা। অর্থেরতো অভাব নেই। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো ঘটানোর জন্য মীর কাসেম আলীর তহবিল থেকে নাকি ১৫০ কোটি টাকা সরবরাহ করা হয়েছে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই'ও নাকি জড়িত। কিছু ছেলেকে নাকি আইএসআই পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে নিয়ে ট্রেনিং দিয়ে এনেছে। এমন সব খবরের সত্যতা কতটুকু জানি না। তবে এসব কঠিন কঠিন কাজ যে এই ছেলেগুলো একক উদ্যোগে করতে পারে তা কখনও বিশ্বাস করা কঠিন। শক্তিশালী নেটওয়ার্ক একমাত্র জামায়াত ইসলামীরই রয়েছে এবং তারাই নেপথ্যে কাজ করছে বলে অনেকের বিশ্বাস।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে চার মাস আর ২০১৫ সালের প্রথম ৯২ দিন জামায়াত সর্বশক্তি নিয়োগ করে সরকার উৎখাত এবং বিচার বানচালের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল কিন্তু জনসাধারণের সমর্থন না পাওয়ায় তারা ব্যর্থ হয়েছে। এখন টার্গেট কিলিং করছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগেছে। এটাও যখন কোনও কাজে আসছে না তখন বড় বড় হামলার পরিকল্পনা করেছে। আরও কিছু হামলার হয়তো তারা পরিকল্পনা করতে পারে। সুতরাং সরকারি বাহিনীকে ব্যাপক সতর্ক থাকতে হবে আর গোয়েন্দা তৎপরতাও খুবই তীব্রভাবে চালাতে হবে। আনন্দবাজার পত্রিকা বলেছে- সন্ত্রাসীরা ঢাকার থেকে দূরে একটা রিজার্ভ বেইস তৈরি করছে বড় একটা হামলার জন্য। আনন্দবাজারের এ তথ্য কতটুকু সত্য তা আমরা জানি না তবে হামলার সম্ভাব্যতার কথা উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

বাংলাদেশ খুবই বিপদসংকুল অবস্থার মধ্যদিয়ে চলছে। শেখ হাসিনার সরকারকে উড়িয়ে দেওয়ার একটা মহা-পরিকল্পনা তাদের হাতে রয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার দীর্ঘ ৭ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার পরও প্রতিষ্ঠানিক যে বিরোধিতার সম্মুখীন হওয়ার কথা তা তার বিরোধীরা সৃষ্টি করতে পারেনি। কারণ যে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে দেশের মানুষের সম্মতি থাকে সে পথে তারা না হেঁটে তারা সন্ত্রাসের পথ বেয়ে চলার চেষ্টা করেছে। মানুষ কখনও সন্ত্রাস চায় না। বিদেশিদের স্মরণাপন্ন হয়েছেন। কোনওখানে আশাব্যঞ্জক সাড়া পায়নি।

অনেক পণ্ডিত বলছেন, বিবেকের স্বাধীনতা হারিয়ে, গণতন্ত্র চর্চা থেকে বঞ্চিত হয়ে বর্ণাঢ্য পরিবারের ছেলেগুলো মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে আইএসএ যোগদান করেছে। এ কথা কোনও অংশে সত্য নয়। তারা বিবেকের স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের অধিকারের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে যায়নি। তারা গিয়েছে আবু বকর বাগদাদীর খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য যেখানে বিবেকের স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের চর্চা- কিছুই নেই। তারাও শেষ পর্যন্ত সব কিছু উপলব্ধি করার পর হুস ফিরে পাবে। এখানে যারা সন্ত্রাসে জড়িত তারা বয়সে খুবই তরুণ। সমগ্র হৃদয় তাদের আবেগে ভরপুর। তাদের আবেগ নিয়ে হয়তো ইসলামের কথা বলে কিছু লোক খেলছে কিন্তু যখন তারা বুঝবে যে ইসলামের নামে তারা প্রতারিত হচ্ছে তখন সঠিক পথে ফিরে আসবে। ফিরে আসবে তাদের সঙ্গীদের পরিণতি দেখেও। সরকারকে তেমনই দৃষ্টান্তমূলক পরিণতি দেখাতে হবে।

আরও মর্মান্তিক ব্যাপার হচ্ছে অপারেশনে যাওয়ার আগে এ যুবকগুলোকে নাকি নেশা জাতীয় ট্যাবলেটও খাওয়ানো হচ্ছে। আবু বক্কর বোগদাদীর আইএস-এর লোকজন ইয়াযেদী সম্প্রদায়ের মেয়েদেরকে যৌনদাসী হওয়ার প্রস্তাব করেছিল, তারা সম্মত না হওয়ায় নির্বিচারে তাদেরকে হত্যা করেছে।

হযরত আলী (রা.)  বিরুদ্ধ পক্ষের এক বীরকে যুদ্ধক্ষেত্রে মাটিতে ফেলে বুকের ওপর বসে হত্যা করার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন। তখন পতিত বীর হযরত আলী (রা.) এর মুখের উপর থুতু নিক্ষেপ করেছিল। হযরত আলী (রা.) তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং হযরত আলী (রা.) কে সে পতিত বীর জিজ্ঞেস করেছিল হাতের মুঠোয় পেয়ে ছেড়ে দিলেন কেন? তখন হযরত আলী (রা.) বলেছিলেন- যুদ্ধাবস্থায় তোমাকে হত্যা করলে আমি সওয়াব লাভ করতাম কিন্তু তুমি আমার মুখে থুতু নিক্ষেপ করায় আমার হৃদয়ে তোমার সম্পর্কে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ জেগে উঠেছে। এখন আমি তোমাকে হত্যা করলে তা হতো ব্যক্তিগত বিদ্বেষের কারণে। আর এমন হত্যা মহাপাপ।

এমন পবিত্র ইসলামকে ব্যবহার করা হচ্ছে আজ নিকৃষ্টতম পথে। ধর্ম নিয়ে এ ব্যবসা কখনও লাভজনক হবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

আরও পড়তে পারেন: গুলশান হত্যাকাণ্ড: কিছু জিজ্ঞাসা, কিছু উপলব্ধি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ