X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গিবাদের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৩ জুলাই ২০১৬, ১৩:০৯আপডেট : ১৩ জুলাই ২০১৬, ১৩:২৩

ইশতিয়াক রেজাগুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি আর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদগাহ ময়দানে জঙ্গি হানা যখন হয়েছে তখনও বিশ্বব্যাপী আলোচনায় তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর, সৌদি আরবের মদিনা আর বাগদাদ আক্রমণ। বাংলাদেশ, তুরস্ক, ইরাক এবং সৌদি আরবে প্রায় একই সময়ে জঙ্গি আক্রমণ আর খুন বলে দেয় এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের একটি বহুজাতিক চরিত্র দাঁড়িয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশ সরকার স্পষ্ট করেই বলছে, দেশের আইসিস নেই।
আইসিস আছে কী নেই এ বিতর্ক শেষ পর্যন্ত আমাদের সুফল দেয় না। সুফল দেবে, যদি প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তা করা যায়। গুলশান হামলার পর প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জঙ্গিদের শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে যারা দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি কায়দায় মানুষ খুন করছে, কিংবা ইরাক বা তুরস্কে যারা আত্মঘাতি বোমা হামলা করে যাচ্ছে, তারা একটি বহুজাতিক নেটওয়ার্কে রয়েছে তা আনুমান করা যায়। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড কোথাও বসে খুব সচেতনভাবে দেশে দেশে আক্রমণগুলো পরিচালনা করছে।
সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের বহুজাতিক চরিত্র বলা হলেও, এগুলো প্রকৃতপক্ষে পরিচালিত হয় স্থানীয়ভাবে। সন্ত্রাসের গড ফাদাররা স্থানীয় রাজনীতির সুযোগ নেয়, সরকারের বাইরে থাকা সহিংস চরিত্রের বিরোধী দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়, কখনওবা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমর্থনও পায়। ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব এমন কী ইউরোপ ও আমেরিকাতেও যে সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে একটির পর একটি তার মূলে রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সহিংস আদর্শ। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সহিংস চরিত্রের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশেও আছে, আছে নানা গোষ্ঠীও (যেমন হেফাজতে ইসলাম) যারা প্রকারান্তরে অরাজনৈতিক সংগঠন পরিচয়ে রাজনীতিই করে উদার ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশে এই খুন ও জঙ্গি রাজনীতি অনেকদিনের। রগ কাটার রাজনীতি কি আজকের? আর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের ওপর গ্রেনেড ও বোমা হামলাতো অনেকদিন ধরেই দেখে আসছি আমরা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চকে যারা মেনে নেয়নি তারাই রাজীব হায়দার থেকে শুরু করে একের পর এক মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারকে খুন করেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার হলে যে রাজনীতির সমস্যা হয় তারাই যে এই খুন শুরু করেছিল আর করে যাচ্ছে এখনও তা বুঝতে রকেট সায়েন্স বোদ্ধা হতে হয় না। আর নিজামীর ফাঁসির পরে তুরস্ক ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ায় প্রমাণিত যে, এদের বহুজাতিক যোগাযোগ বহুদিনের।  

সীমানা পেরিয়ে সেই জঙ্গি নেতৃত্বের সংস্পর্শে সবাই আসবে বা আসতে পারবে এমন নয়। দেশের অভ্যন্তরে, বা বাইরে, এই রাজনীতি যারা করে, সেই নেতৃত্বের মধ্যে আদর্শিক মিলটাই বড় যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। প্রেরণার জায়গাটি হলো পরলৌকিক সুখ আর শান্তি, যা এদেশে যেমন, অশান্ত সিরিয়া ইরাকেও তাই। উপরি হিসেবে আছে তেল বাণিজ্যসহ অন্যান্য ব্যবসা থেকে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ আর অসংখ্য, অজস্র যৌন দাসি ভোগের প্রলোভন।

এসব জঙ্গিরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে কাজ করে স্থানীয় নেতৃত্বের নির্দেশে, তবে তাদের আসল মুরুব্বি তারাই যারা খেলাফতের কথা উচ্চারণ করছে মধ্যপ্রাচ্য আর উপসাগরে। তাই স্থানীয় রাজনৈতিক আর সামাজিক প্রেক্ষাপটই দেশে দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের প্রসারে বড় ভূমিকা রাখছে। ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসারে আন্তর্জাতিক যোগাযোগও এখন কোনও কঠিন কাজ নয়।

ইরাক এবং সিরিয়ায় আইসিসের প্রাথমিক সাফল্য দেশে দেশে মুসলিম তরুণ তরুণীদের উৎসাহিত করেছে এই জঙ্গিদের দলে যোগ দিতে। শুধু মুসলিম দেশ থেকে নয়, ইউরোপীয় অমুসলিম দেশের মুসলিম তরুণ তরুণীও যোগ দিয়েছিল দলে দলে। কিন্তু আইসিসের সেই দখল আর বজায় নেই। এ বছর জুন মাসে তারা ইরাকের সরকারি সেনাদের হাতে হারিয়েছে ফাল্লুজা। সিরিয়া এবং ইরাকের অনেক এলাকা এখন তাদের হাতছাড়া। এমন বাস্তবতায় আইসিস নেতৃত্ব এখন যেখানে সম্ভব, সেখানেই তার অবস্থান জানান দিতে কোনও নির্দিষ্ট দেশ বা এলাকা নয়, নানা দেশকে বেছে নিয়েছে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে।

ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও কোনও মুসলিম দেশই এই আদর্শকে গ্রহণ করছে না। মুসলিম দেশের রাজনৈতিক এবং আদর্শিক নেতৃত্ব থেকে নিন্দাই করা হচ্ছে এসব হামলার। দেশে দেশে আদর্শিক মতদ্বৈততা যাই থাকুক, খেলাফতের এই ধারণা কোনও দেশই গ্রহণ করেনি। ফলে আইসিস নেতৃত্বের জন্য এটি এক বড় পরাজয়। মুসলিম দেশগুলোয় এমন কথাও উচ্চারিত হচ্ছে যে, আইসিস মুসলমান হলে এটা করতে পারতো না।  

ষড়যন্ত্র তত্ত্বে যেসব কথা বলা হয় অর্থাৎ, এই জঙ্গিবাহিনী গঠন ও পরিচালনায় মদদ আছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের, তাহলে বলতেই হবে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সহসা শেষ হওয়ার নয়। আল কায়েদা, তালেবান, আল শাবাব, নুসলাহ ফ্রন্ট বা বকো হারামের কর্মকাণ্ড যারা বিশ্লেষণ করেন তারা বলেন, তাদের প্রত্যেকে এক একটি রাজনৈতিক সংগঠন এবং স্ব স্ব দেশের ক্ষমতা দখলই তাদের একমাত্র লক্ষ্য, ইসলাম কায়েম নয়। ব্যতিক্রম হলো আইসিস যার নেতারা বলছে তারা বিশ্বব্যাপী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠলেও আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সহজলভ্য হওয়ায় এগুলোর বিস্তার ঘটছে দ্রুত। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের চরম সহিংস বিরোধিতা আমরা দেখেছি। সেগুলোও জঙ্গি ও সন্ত্রাসী রাজনীতি। রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত সমাজে জঙ্গির বিকাশ হয় সংঘবদ্ধভাবে। এখানেও তাই হয়েছে। আর এদের হাতে আছে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও বাণিজ্য। যে কয়টি মুসলিম দেশে জঙ্গিদের উত্থান ঘটেছে, খেয়াল করলে দেখা যাবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দুর্বলতা আর সংঘাতময় পরিস্থিতির সুযোগেই তা হয়েছে। সরকার বিরোধিতা করতে গিয়ে এদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি। ঢাকায় ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের সমাবেশের সময় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর এমন চরিত্র আমরা দেখেছি। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন নাইজেরিয়াতেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই জন্ম নিয়েছে জঙ্গি সব সংগঠন।

সমাজ ও রাজনীতি থেকে সমর্থন না পেলে কোনও সংগঠনের পক্ষেই বাড় বাড়ন্ত সম্ভব নয়। জঙ্গিরা তাদের শক্তির জানান দিচ্ছে। সরকার এবং সমাজকে দুর্বল করতে চাচ্ছে। সরকার দুর্বল হলে রাজনৈতিকভাবে যারা লাভবান হয় তাদের দিক থেকেও সমর্থন আছে কিনা তা বেশি করে খতিয়ে দেখার সময় এখন। সরকারকে তাই জঙ্গিবাদের স্থানীয় উৎসের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে।

গুলশান ঘটনার পর নির্ধারিত সময়ের আগেই ঢাকা ঘুরে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করে বলছে, বাংলাদেশ স্বীকার করুক এদেশে আইসিস ও আল কায়েদা আছে। বাংলাদেশের নিজের অবস্থান এক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববাসীকে তো বটেই, দেশের মানুষকে সরকারকেই পরিষ্কার বার্তা দিতে হবে সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান কতটা দৃঢ়। 

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

আরও খবর: যে কারণে জঙ্গিদের রক্ত ও ডিএনএ পরীক্ষা

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, হিট অ্যালার্ট জারি
চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, হিট অ্যালার্ট জারি
জিমি নেই, তারপরও খেলতে নেমেছে মোহামেডান
জিমি নেই, তারপরও খেলতে নেমেছে মোহামেডান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ