X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে ধরতে হবে

প্রভাষ আমিন
১৪ জুলাই ২০১৬, ১৩:৩৬আপডেট : ১৪ জুলাই ২০১৬, ১৩:৪০

প্রভাষ আমিন ট্যুর ডি ফ্রান্সের আদলে বাংলাদেশে বসছে সাইক্লিং প্রতিযোগিতা ‘ট্যুর ডি বাংলাদেশ’। গত ২৩ জুন এ উপলক্ষে ওয়েস্টিনে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ সাইক্লিং ফেডারেশনের চুক্তি হয়েছে। এটিএন নিউজ সম্প্রচার সহযোগী বলে সে অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেখানেই প্রথম এবং একমাত্র সাক্ষাৎ ভদ্রলোকের সঙ্গে। ২ জুলাই গুলশান হামলার পরদিন ফেসবুকে একটি গ্রুপ ছবি দেখে চমকে উঠি। আরে জঙ্গি হিসেবে আলোচিত রোহান ইমতিয়াজের পাশের ভদ্রলোককে তো চেনা-চেনা লাগছে! পরে দেখলাম ঠিকই, তিনি ইমতিয়াজ হোসেন খান বাবুল, সাইক্লিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, এক হতভাগ্য পিতা।
এত কাছে এমন ভয়ঙ্কর জঙ্গির বিচরণ দেখে আমি চমকে যাই। পরে যখন এটিএন নিউজের নিউজ আওয়ার এক্সট্রায় ফোনে ইমতিয়াজ বাবুল বর্ণনা করলেন তার করুণ পরিণতি, মাত্র একবার দেখা হওয়া এই ভদ্রলোকের জন্য, এই অসহায় পিতার জন্য গভীর বেদনায় আর্দ্র হলো আরেক পিতার হৃদয়। তিনি বলছিলেন, তার পুরো পরিবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং সক্রিয়। তার একমাত্র ছেলে রোহান ইমতিয়াজ, যে ক্লাস নাইনে থাকতেও তেলাপোকাকে ভয় পেতো। রোহান স্কলাস্টিকার ছাত্র, তার মাও একই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। বাবা ক্রীড়া সংগঠক, মা শিক্ষক, পুরো পরিবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সক্রিয়া কর্মী। সেই পরিবারের ছেলে কিভাবে এত অল্প সময়ে মানুষ খুন করার পর্যায়ে চলে গেল, বাবা ভেবেই পান না। আমরাও ভেবে পাই না।
একই অসহায়ত্ব মীর সামেহ মোবাশ্বেরের বাবা মীর হায়াত কবিরের কণ্ঠে। তার ছেলে নিজ হাতে ভাত মেখে খেতে পারতো না। সেই ছেলে কোচিংয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। তারা অপেক্ষায় ছিলেন, হয়তো ঈদের আগেই ছেলে ফিরবে। ছেলে ফিরলো বটে, তবে সেই মায়ের আঁচল ধরা মোবাশ্বের নয়; এক ভয়ঙ্কর খুনিতে বদলে যাওয়া অপরিচিত মোবাশ্বের। ছেলের কোনও কমতি রাখেননি হায়াত কবির। ভালো স্কুলে পড়িয়েছেন। এখন বুঝতে পারেন না, বিড়বিড় করেন, কোথাও কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে। লজ্জিত বাবা জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন ফেসবুকে আলোচিত জঙ্গি নিবরাস ইসলামের বাবা নজরুল ইসলাম ও মা লায়লা বিলকিসও। মেধাবী নিবরাসের ফেসবুক টাইমলাইন দেখলে চমকে যাবেন যে কেউ। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা এই বয়সের ছেলেরা যেমন হয় তেমনই। হইচই, বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে আড্ডা, গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো, প্রিয় নায়িকার হাতের ছোঁয়ায় আপ্লুত নিবরাস। পড়তে গিয়েছিল মালয়েশিয়ায়। সেখান থেকে সে লাপাত্তা হয়ে যায়। তারও খোঁজ মেলে ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে। গোটা জাতির মতো পরিবারকেও বিস্মিত করে এই ছেলেগুলো দেশি-বিদেশি ২০ জন মানুষকে কুপিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

ঘটনার দুদিন পর তিন বাংলাদেশির এক ভিডিও বার্তা প্রচারিত হয়, যাতে গুলশানের ঘটনাকে ঝলকমাত্র বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে আরও হামলার। এই তিন তরুণের একজন তাহমিদ প্রথম ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতার সেরা ১৫ জনের একজন, চমৎকার গান গাইতো। তার বাবা সাবেক আমলা এবং নির্বাচন কমিশনার সফিউর রহমান। আরেক তরুণ সাবেক সেনা কর্মকর্তার ওয়াশিকুর আজাদের ছেলে তুষার। এরা সব আমাদের অতি পরিচিত আবহের সন্তান, আমাদেরই সন্তান। মাদ্রাসার হোক কিংবা ইংলিশ মিডিয়ামের হোক, দরিদ্র পরিবার হোক আর বিত্তশালী হোক; এই সন্তানরা আমাদেরই। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। কোন অশুভ শক্তি ইসলামের নামে এদের অন্ধকার পথে ঠেলে দিয়েছে। জীবন শুরুর আগেই কেন তারা মৃত্যুকেই বেছে নিল?

এই ছেলেগুলো ৫/৬ মাস ধরে লাপাত্তা। পরিবারের সঙ্গে এদের কোনও যোগাযোগ নেই। রোহান ইমতিয়াজের বাবা এটিএন নিউজকে বলছিলেন, এমন আরও অনেক ছেলে আছে, যারা হারিয়ে গেছে। এমন অনেক পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। সেদিনই দৈনিক সমকাল পত্রিকায় দেখলাম, ‘বিত্তবান পরিবারের শতাধিক তরুণ নিখোঁজ’। নিউজে আছে ঊর্ধ্বতন সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সমাজের প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানেরা আছে নিখোঁজের তালিকায়। শুনে ভয় পেয়ে যাই। এই নিখোঁজ ছেলেগুলোকে নিশ্চয়ই পিকনিক করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়নি। তাদেরকে নিশ্চয়ই আরও ভয়ঙ্কর কোনও মিশনের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। এখনই সতর্ক না হলে, এই নিখোঁজ ছেলেগুলোকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে আরও বড় বিপর্যয়ের জন্য মানসিকভাবে তৈরি হতে হবে আমাদের। আমাদের নিখোঁজ সন্তানদের ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন সবাই সিরিয়াস সন্তানদের ব্যাপারে। তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিখোঁজ সন্তানদের ফিরিয়ে আনতে অভিভাবকদের সর্বোচ্চ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শুধু জিডি করে বসে থাকলেই হবে না। পুলিশকে সব তথ্য দিতে হবে। স্কুলে কারা অনুপস্থিত সে তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে। আসলেই আগে এই নিখোঁজদের নিয়ে না পরিবার, না পুলিশ; কেউই অত সিরিয়াস ছিলেন না। আগে মাদকাসক্ত সন্তানকে যেমন বাবা-মা লুকিয়ে রাখতেন, এখন তেমনি আড়াল করে রাখতে চান জঙ্গি হয়ে যাওয়া সন্তানকে। কিন্তু লুকিয়ে রেখে সমস্যার সমাধান হয় না। বরং সমস্যা আরও বাড়ে, সন্তান হারিয়ে যায় চিরতরে। তাই সব লজ্জা, সামাজিকতা ভুলে নিখোঁজদের ব্যাপারে সবাইকে আরও সক্রিয় ও সোচ্চার হতে হবে। সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বা অভিমানে ঘর ছাড়া ভেবে পুলিশও আগে সিরিয়াস হয়নি। আর এমনিতে তো কত ছেলে গুম হয়ে যায়। গুম আর নিখোঁজে তালগোল পাকিয়ে গেছে। গুম হোক, নিখোঁজ হোক সবাইকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। তবে সরকারের একার পক্ষে এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। সব তথ্য নিয়ে পুলিশের পাশে থাকতে হবে অভিভাবকদের। আবার বন্ধুসুলভ আন্তরিকতা ও মমতা নিয়ে অভিভাবকদের পাশে দাঁড়াতে হবে সরকারকে।

আমরা এখন সবাই মিলে হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের খুঁজে ফিরছি। নিজের সন্তানদের সামলে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু খুঁজতে হবে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে। যার বাঁশির সুরে আমাদের সন্তানরা বাবা-মার ভালোবাসার টান উপেক্ষা করে, মৃত্যুর পরোয়া না করে ছুটে যাচ্ছে অন্ধকার গন্তব্যে। পতঙ্গ যেমন না বুঝে আগুনে ঝাঁপ দেয়। সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে খুঁজে বের করতে না পারলে, জঙ্গিবিরোধী সব অভিযানই ব্যর্থ হবে, সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হবে। উৎস খুঁজে না পেলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান হবে জুতা আবিষ্কারের মতো, জগৎ ধুলাময় হবে, জগত কাদাময় হবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। কারখানা বন্ধ না হলে, রাস্তাঘাটে ইয়াবা বা ফেন্সিডিল আটকে মাদকের থাবা বন্ধ করা যায়নি, যাবেও না। জঙ্গিদের এক টিম ধরলে, আরেক টিম মাঠে নামবে। ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে জঙ্গিরা অনেক বেশি প্রশিক্ষিত, অনেক বেশি দক্ষ। তারা অস্ত্রে, অর্থে, প্রযুক্তিতে, কারিগরি জ্ঞানে আমাদের পুলিশ বাহিনীর চেয়েও নিজেদের দক্ষ প্রমাণ করেছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত ধারার অভিযানে কাজ হবে না।

সরকারকে অস্বীকার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে, পুরো পরিস্থিতি নতুন করে মূল্যায়ন করে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক আরও সক্রিয় ও শক্তিশালী করে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের সর্বাত্মক ও কার্যকর অভিযানে নামতে হবে। আর জাতীয় ঐক্যের কথা মুখে না বলে সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সত্যিকারের জাতীয় ঐক্য গড়তে হবে। কারণ বাংলাদেশ এর চেয়ে বড় বিপদে আর পড়েনি।

গুলশানের ঘটনার পর সবাই ভয় পেয়েছে। আমিও পেয়েছি। যতটা না হামলার ভয়, তারচেয়ে বেশি সন্তানকে নিয়ে ভয়। আমাদের সবার ঘরে ঘরে ছেলে আছে। আমার ছেলে প্রসূন ক্লাস এইটে পড়ে। আমার পাশের চেয়ারের সহকর্মী কাজী তাপসের তিন ছেলে। সেদিন তাপস বলছিল, ইচ্ছা করে তিন ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘরে বসে থাকি। আমিও প্রতিদিন বাসায় ফিরে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখি। ভয় থেকে, শঙ্কা থেকে। ভালোবাসায়, মমতায় জড়িয়ে ধরে রাখতে চাই। কিন্তু বেহুলার বাসর ঘরেও ছিদ্র থাকে। সেই ছিদ্র দিয়ে সুতানলী সাঁপ ঢুকে লখিন্দরকে দংশন করে। তাই সেই ছিদ্রটা বন্ধ করতে হবে। নইলে সুতানলী সাঁপেরা আমাদের শেষ করে দেবে।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

আরও খবর: জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় তিন কৌশল সরকারের

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মানবিকতায়ও নজির স্থাপন করেছে পুলিশ: ডিএমপি কমিশনার
মানবিকতায়ও নজির স্থাপন করেছে পুলিশ: ডিএমপি কমিশনার
চাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বাজেট
চাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বাজেট
লিঙ্গবৈচিত্র্য ও পুরুষতন্ত্রের মেনে নেওয়া-না নেওয়া
লিঙ্গবৈচিত্র্য ও পুরুষতন্ত্রের মেনে নেওয়া-না নেওয়া
তীব্র গরমে কৃষিশ্রমিকের সংকট চরমে
তীব্র গরমে কৃষিশ্রমিকের সংকট চরমে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ