X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

পিস টিভি, বাকস্বাধীনতা ও নাগরিক কর্তব্য

চিররঞ্জন সরকার
১৪ জুলাই ২০১৬, ১৬:৫৪আপডেট : ১৪ জুলাই ২০১৬, ১৬:৫৫

চিররঞ্জন সরকার বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে ‘জঙ্গিবাদে উৎসাহ জোগানোর’ অভিযোগ ওঠায় রবিবার (১০ জুলাই) আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধের ওই সিদ্ধান্ত দেয়।
সুবক্তা হিসেবে পরিচিত ইসলামি বক্তা জাকির নায়েককে নিয়ে বিতর্ক বহু দিনের। জঙ্গিবাদের প্রতি তার সমর্থনসূচক বক্তব্য যেমন সমালোচিত, তেমনি সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষকতায় ওহাবি মতবাদ প্রচারকারী হিসেবে তাকে সন্দেহের চোখে দেখেন অনেকে।
জাকির নায়েক পরিচালিত মুম্বাইভিত্তিক ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিষ্ঠান হলো এই পিস টিভি। এ টিভিতে ধর্ম নিয়ে আলোচনায় তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
গত ১ জুলাই গুলশানে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম জঙ্গি হামলার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে অন্তত দু’জন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জাকির নায়েকের মতো ইসলামি বক্তাদের নিয়মিত অনুসরণ করত। তার কথায় প্ররোচিত হয়ে ভারতের কয়েকজন তরুণ আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে বলেও খবর এসেছে। এরপর প্রথমে ভারতে, পরে বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত  নেওয়া হয়।
পিস টিভি বন্ধের সিদ্ধান্তকে ‘বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ’ বলে অনেকেই সমালোচনা করছেন। পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে জঙ্গিবাদী তৎপরতা দমনে কতটুকু কী লাভ হবে, সে প্রশ্ন তো রয়েছেই। কিন্তু কথা হলো বাকস্বাধীনতা কি শর্তহীন হতে পারে? কারও বক্তব্য যদি একদল মানুষকে হিংস্র, খুনি হওয়ার উস্কানি দেয়, তবু কি আমরা সেই বক্তব্য প্রকাশ ও প্রচারের জন্য উৎসাহ জুগিয়ে যাব? প্রশ্নগুলো বর্তমান সময়ে খুবই জরুরি। হিংস্র জঙ্গিবাদী তৎপরতার প্রেক্ষাপটে আমাদের শুধু অন্যের সমালোচনা নয়, আত্মসমালোচনাও প্রয়োজন। জঙ্গিবাদী তৎপরতা বন্ধ হোক এটা সবাই চায়। এ জন্য সম্ভাব্য যা কিছু করা দরকার তার সবই করতে হবে। প্রশাসনিক উদ্যোগগুলো সরকারকেই নিতে হবে। কিন্তু সরকারের প্রতিটি উদ্যোগকে যদি আমরা সমালোচনা করি, তাহলে সরকার এই জঙ্গি দৈত্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবে কিভাবে?
বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে যা খুশি তা-ই বলা বা ছাপা কোনও মতেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। বিশেষত তার কারণে যদি কেউ হিংস্র হয়, মানুষ খুন করা শুরু করে, এটা তো একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়।
কিছু মানুষ নিশ্চয়ই বলবেন, কোনও কথায় কার মনে আঘাত লাগলো সেটা বিবেচ্যই নয়। বাকস্বাধীনতা শুধু স্বাধীনতাটুকুর কারণেই জরুরি। যেকোনও বিশ্বাসভিত্তিক অবস্থানের মতো, এই অবস্থানটির সঙ্গেও তর্ক চলে না। কিন্তু এ রকম বিশ্বাসভিত্তিক অবস্থানের বদলে আর পাঁচটা বিষয়ের মতো এখানেও আমরা ফলাফলের দিক থেকে তার বিচার করতে পারি। অর্থাৎ সবার অবাধ বাকস্বাধীনতা স্বীকার করে নিলে তার ফল কী, আর রাষ্ট্রকে সেই স্বাধীনতা খর্ব করতে দিলে তার ফলই বা কী? অর্থনীতির ভাষায় স্বাধীন বাক-এর ‘কুফল’কে এক্সটার্নালিটি বা অতিক্রিয়া ভাবলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব আমরা? নদীর জলে আমার কারখানার দূষিত জল মিশলে অন্যদের ওপর তার যে কুপ্রভাব পড়ে, সেটাই অতিক্রিয়া। ধরা যাক, আমার স্বাধীন কথায় আপনার মনে আঘাত লাগলে সেটাও আমার কথার অতিক্রিয়াই। অর্থাৎ কথাটা বলে আমার নিজের আনন্দ হচ্ছে বটে, কিন্তু সেই চক্করে আপনার খারাপ থাকা বাড়ছে। যে প্রক্রিয়ায় অতিক্রিয়া আছে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারও রাষ্ট্রের আছে, অন্তত কোনও রাষ্ট্র তেমনটা মনে করলে আপত্তি করার উপায় নেই।

কিন্তু প্রায় সব কাজেরই যেমন অতিক্রিয়া থাকে, তেমন প্রায় সব কথাতেই কারও না কারও মনে আঘাত লাগতে পারে। রাষ্ট্র যদি নিরপেক্ষ বা সমদর্শী হয়, তবে প্রত্যেকটা খারাপ লাগাকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া তার কর্তব্য। অর্থাৎ রাষ্ট্রের পক্ষে দুটি পৃথক দিকে হাঁটা সম্ভব। এক, যেখানে কারও কোনও কথা খারাপ লাগলেই (এমনকী, খারাপ লাগার আশঙ্কা থাকলেও) তা নিষিদ্ধ করে দেওয়া যেতে পারে। ফ্রান্সে যেমন ইহুদিবিদ্বেষী কথা নিষিদ্ধ। অতএব, বলা যেতে পারে, মুসলমানদের (অথবা খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু বা অন্য কোনও ধর্মাবলম্বী মানুষের) ধর্মবিশ্বাসে যে কথা আঘাত করতে পারে, সেগুলোকেও নিষিদ্ধ করা সমদর্শী রাষ্ট্রের কর্তব্য। অথবা রাষ্ট্র বলতে পারে, যে কথা শুনতে খারাপ লাগছে, অথবা যে সিনেমা-ছবি-বই-নাটকে আঘাত লাগছে কোনও বিশ্বাসে, দয়া করে সেগুলিকে এড়িয়ে চলুন। ভালো না লাগলে পড়বেন না সালমন রুশদি বা তসলিমা নাসরিনের বই। আপনি যে গান শোনেন, তা আমার কুরুচিকর মনে হতে পারে, এবং সেই গান লোকে শুনে সমাজ কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে গোছের চিন্তাও আমাকে যন্ত্রণা দিতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ না মাইকে সজোরে সেই গান চালিয়ে আপনি আমার জীবন অতিষ্ঠ করছেন, ততক্ষণ আপনার সেই গান শোনায় হস্তক্ষেপ করার পক্ষে যুক্তি দুর্বল, কারণ আপনার যা ঘোর অপছন্দের, তা হয়তো আর এক জনের কাছে বেঁচে থাকার মন্ত্র। এটা ঠিক যে এই নানা উদাহরণে, যারা অপছন্দ করছেন তাদের প্রত্যেকের কাছেই এই ঘটনাগুলোর নেতিবাচক অতিক্রিয়া মারাত্মক। কিন্তু যতক্ষণ সেই অতিক্রিয়াকে এড়িয়ে যাওয়া যায়, রাষ্ট্রের হাত গুটিয়ে থাকাই সমীচীন। অবশ্য কারও পক্ষে কোনও অতিক্রিয়া যখন এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হবে, তখন রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে বিলক্ষণ। কিন্তু সেটা বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া-এটাও তো মানতে হবে।

এখানে একটা কথা মনে রাখা ভালো। বাকস্বাধীনতা জিনিসটা কিন্তু খরচ না করে মেলে না। বহু ক্ষেত্রেই তার মূল্য দিতে হয়। বন্ধুবিচ্ছেদ থেকে মানহানির মামলা, সবই হতে পারে। অফিসে বসের বিরুদ্ধে বাকস্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করলে চাকরি যাওয়াও বিচিত্র নয়। কিন্তু সেই বিরুদ্ধতাগুলোও অপর দিকের স্বাধীনতারই প্রকাশ। যতক্ষণ তা আইনের স্বীকৃত গণ্ডিতে থাকছে অর্থাৎ কোনও কথায় ক্ষুণ্ন হয়ে কেউ বন্দুক হাতে তেড়ে না আসছে, ততক্ষণ এতে আপত্তির কোনও কারণ নেই।

আসলে অসুখের লক্ষণ এবং কারণকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। ক্ষমতার বৈষম্য সব সমাজে আছে, এবং তাকে খর্ব করা বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। সেই লড়াইয়ে বাকস্বাধীনতা একটা অবশ্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার, কিন্তু কোনও মতেই তা একাই যথেষ্ট নয়। আর বাস্তবে বাকস্বাধীনতার অধিকার যে সবার সমানভাবে আয়ত্ত নয়, সেটা সমস্যার উপসর্গ, তার কারণ নয়।

জঙ্গিবাদ বর্তমানে আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে নির্মমভাবে বিদেশিদের হত্যা করায় বৈদেশিক সাহায্য, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশিদের ভাবমূর্তি সব কিছুর ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অল্পকিছু বিপথগামী ‘ভ্রান্ত আদর্শের অনুসারী’র জন্য পুরো দেশকে আমরা উচ্ছন্নে যেতে দিতে পারি না। গোটা বিশ্বে বাংলাদেশের মানুষের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হবে, আমরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হব, আর সব দোষ ‘ইন্দো-মার্কিনের’ ওপর চাপিয়ে আঁতলামি করব, অথবা ভয়ে সেঁটিয়ে যাব, তা হতে পারে না। জঙ্গিবাদের উৎস বন্ধে নানা উদ্যোগ নিতে হবে। পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়তো সামান্য একটি পদক্ষেপ। আরও ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। এর কোনোটা কাজ করবে, কোনোটা হয়তো করবে না। কিন্তু আমাদের তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। শুধু সমালোচনা নয়, আমাদের প্রত্যেকের নিজের ভূমিকাও মূল্যায়ন করে দেখতে হবে। রাষ্ট্রকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণে যেমন বাধ্য করতে হবে, তেমনি নাগরিক হিসেবে কর্তব্যকর্মগুলো খুঁজে বের করে তা পালন করতে হবে। নিজেকে দায়িত্বশীল হতে হবে। দায়িত্ব পালন করতে হবে। দেশে যেন জঙ্গি তৈরি না হয়, ‘আমার ভূমিকা’ যেন একজন জঙ্গি উৎপাদনেও ন্যূনতম উৎসাহ না জোগায়, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমি অন্তত দৃশ্যমান কিছু করতে পারি—এ মুহূর্তে প্রত্যেক সুনাগরিকের এটাই ব্রত হওয়া উচিত। 

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সেতুমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে জিডি
সেতুমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে জিডি
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
ফসলের মাঠে সোনারঙ, তীব্র গরমেও কৃষকের মুখে হাসি
ফসলের মাঠে সোনারঙ, তীব্র গরমেও কৃষকের মুখে হাসি
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভূমিকা রাখার আহ্বান
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভূমিকা রাখার আহ্বান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ