X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিপদে যেন না করি ভয়!

শুভ কিবরিয়া
১৫ জুলাই ২০১৬, ১৩:০৩আপডেট : ১৫ জুলাই ২০১৬, ১৩:০৯

শুভ কিবরিয়া বাংলাদেশে এক সময় ছাত্ররাজনীতির জোয়ার ছিল। বাম, ডান,মধ্যপন্থী সব রাজনৈতিক দলে আদর্শিক প্রেরণায় ফিবছর নতুন নতুন শিক্ষার্থীদের রাজনীতির ছায়াতলে আনা হতো। প্রতি বছর নতুন রিক্রুটমেন্ট ছিল রাজনৈতিক সংগঠনে। অনেক বছর হলো সেই রিক্রুটমেন্ট আর তেমন করে নেই। এখন যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তার ছাত্রসংগঠন সক্রিয় থাকে শিক্ষাঙ্গনে। সেখানে আদর্শ বড় ভিত্তি পায় না, ক্ষমতা ও ব্যক্তিগত পার্থিব লাভালাভই মুখ্য হয়ে উঠে। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলে তাই আদর্শিক নতুন রিক্রুটমেন্টের হার খুবই নগণ্য।
বাম সংগঠনগুলো তাত্ত্বিক বিবেচনা আর দল ভাঙতেই বেশি ব্যস্ত। ক্ষমতাসীন দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করেই বাম সংগঠনগুলোর একাংশের দিন কাটে। ফলে, বাম সংগঠনগুলোতেও আগের মতোন নতুন সদস্য রিক্রুটমেন্ট তেমন একটা নেই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন বহু বছর বন্ধ। ফলে ছাত্ররাজনীতিতে এক বন্ধ্যাদশা চলছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধর্মবাদী রাজনীতি তার নতুন সদস্য রিক্রুটমেন্ট অব্যাহত রেখেছে। ছাত্ররাজনীতির এই বন্ধ্যাদশাতে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে চরমপন্থী ধর্মীয় সংগঠনগুলোই।
দুই.
ছাত্র রাজনীতি একসময় বিষময় হয়ে ওঠে জাতির কাছে। চাঁদাবাজি,দখলবাজি আর ছাত্ররাজনীতি সমার্থক হয়ে ওঠায় হৈ হৈ রৈ রৈ আওয়াজ ওঠে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের। মাথা ব্যথায় মাথা কাটার এই আওয়াজে আমরা অনেকেই শামিল হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সমাধান এই খানেই নিহিত।
শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি বিশেষত বহুদলীয় ছাত্র রাজনীতি বিকশিত হলে হত্যা-সন্ত্রাস-সংঘর্ষ-সংঘাতে বিপন্ন হয়ে পড়বে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই বিবেচনায় যখন যে সরকার এসেছে সেই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার দলীয় ছাত্র সংগঠনকে প্রভুত্ব করতে দিয়েছে। এতে করে বাকিদের পথ সংকুচিত করা হয়েছে। বহু ফুল ফুটতে দেবার নীতি সে মানেনি। বছরের পর বছর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রসংসদের নির্বাচন হয়নি। সামরিক সরকার আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হলেও গণতান্ত্রিক আমলের সরকার তা বহাল রাখেনি। সরকারি  ছাত্র সংগঠনের পরাজয়ের ভয়ে শিক্ষাঙ্গনগুলোর রাজনীতি-সংস্কৃতি এভাবে বন্ধ্যা হয়ে পড়েছে দিনের পর দিন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই রাজনীতি-সংস্কৃতি বন্ধ্যা করে দিয়ে আমরা একধরনের পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলেছি। পরবর্তীতে দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জন্মলগ্ন থেকেই শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেই এগুতে চেয়েছে। সেখানে এক ধরনের নির্দেশিত ও নিয়ন্ত্রিত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে নানা ফর্মে। এই যে আমরা পাবলিক,প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুক্ত চিন্তার বড় ক্ষেত্র,অবারিত ও পরিশীলিত ছাত্র রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠালাম আরও বেশি সুস্থতার আশায়, তার ফলাফল এখন কী হলো?

এখন তো দেখা যাচ্ছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের ধর্মীয় জঙ্গিবাদী প্ররোচনায় দীক্ষিত আত্মঘাতী তরুণ প্রজন্ম। আমরা যে সামান্য বিপদকে ম্যানেজ করতে না পেরে বজ্র আঁটুনি দিলাম মুক্তচিন্তার,সেই পলায়নপরতা তো আমাদের ঠেলে দিলো আরও বড় বিপত্তির মুখে। তাহলে লাভটা হলো কী!
তিন.

আমরা এখন শিক্ষাবিস্তারে অনেক টাকা খরচ করি। আমাদের একমাত্রিক উন্নয়ন ভাবনা জানান দেয় অবকাঠামো তৈরি হলেই হয়ত সমাধান। আমরা সমাজের উন্নতি বলতে আর্থিক প্রবৃদ্ধিকেই বড় করে ভেবেছি। ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি মানেই সমাজ এগুচ্ছে, এই প্রাচীনতম অংকের জ্ঞান নিয়েই আমরা রাষ্ট্র চালাতে চেয়েছি। কিন্তু সমাজে যে বৈষম্য বাড়ছে,ভেদজ্ঞান বাড়ছে, এই বিপদটাকে আমরা বিবেচনায় রাখিনি।
গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে সশস্ত্র জঙ্গিপনার পর এ ঘটনার অন্তরালের কারণ হিসেবে আমরা মাদ্রাসা,বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা উচ্চবিত্ত নিম্নবিত্ত খুঁজছি। শ্রেণি বিভাজিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আমরা শত্রুমিত্র খুঁজছি।
সম্প্রতি, দৈনিক বণিক বার্তা নানা ধরনের গবেষণার ওপর নির্ভর করে ১২ জুলাই (২০১৬) একটা রিপোর্টে বলছে,আমাদের আওয়াজ তোলা সব আয়োজন সত্ত্বেও জীবনগঠনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত দেশের অধিকাংশ তরুণ। এ প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৬৪ শতাংশ তরুণ স্কুল শেষ না করেই শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ে। ৬৮ শতাংশ তরুণ মজার ছলে নেশার দিকে যায়। ৬২ শতাংশ তরুণ সমাজ থেকে সততার শিক্ষা পায় না। ৫৭ শতাংশ যুবশ্রম সক্ষমতার নিস্ক্রিয় অংশ। দেশের তরুণদের ৬৯ শতাংশ কর্মসংস্থানের ঘাটতিতে ঝুঁকির পথে যাচ্ছে।
এই যে, ভেতরে ভেতরে সমাজে এত অসঙ্গতি,এত বিপত্তি আমরা লালন করছি এবং তা যে আমাদের অনেক বড় বিপদের পথ তৈরি করছে, তা আমরা খেয়ালও করছি না।
যে জীবনবিনাশী,কর্তৃত্ববাদী,দমবন্ধকরা,এককেন্দ্রিক, চরমপন্থী,সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ আমরা তৈরি করেছি, সেই পরিবেশটাকে উন্মুক্ত আলোর কাছে নিয়ে যেতে না পারলে এই অন্ধকার কাটবে বলে মনে হয় না। একটা বহুত্ববাদী, বহুমতের, পরমতসহিষ্ণু, উদার, গণতান্ত্রিক আবহ সৃষ্টি করে সবার সঙ্গে সবার বিকাশের সমান সুযোগ তৈরির চেষ্টা যদি আমরা করতে না পারি, তবে আমাদের তরুণ সমাজ নানাভাবেই বিপথগামী হবে।

চার.
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী প্রবণতা নতুন নয়। এখানে গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ারও নতুন ঘটনা নয়। এখানে নির্বাচিত সরকারকে বিপদে ফেলতে বা সরকারের ভাষায় ‘সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র’ বিষয়টিও নতুন নয়। অতীতে দেখা গেছে, গণতন্ত্রের জন্য এখানে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করে বটে কিন্তু নির্বাচনে বড় জনসমর্থন পেলে,সংবিধানে পরিবর্তনের গরিষ্ঠতা পেলে সে আচরণে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। সেই কর্তৃত্ববাদী আচরণ আবার বড় বিপদও তৈরি করে। এদেশে যতবার সরকারগুলো সংসদে সংবিধান পরিবর্তনের গরিষ্ঠতা পেয়েছে, ততবার একটা রাজনৈতিক বিপত্তি নিয়েই তাকে ক্ষমতা থেকে চলে যেতে হয়েছে।
১৯৭২ সালে স্বাধীনতার প্রথম সরকারের আমলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের কঠিন দায়িত্বও সরকার নির্বিঘ্নে পালন করতে পারেনি। সেই সরকারকেও মোকাবিলা করতে হয়েছে বামপন্থী জঙ্গিবাদ। সরকারের সেসময়ের বিপত্তির একটা ঘন বয়ান আছে বঙ্গবন্ধুর জামাতা দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী প্রয়াত এম. এ . ওয়াজেদ মিয়ার লেখনীতে।
তার অভিজ্ঞান হচ্ছে, ‘বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা, গুপ্তহত্যা ও সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু হয় ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ গুপ্তঘাতকদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের সংখ্যা দাঁড়ায় তিন শতাধিক। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সংসদ নির্বাচনের পর গুপ্তঘাতকদের সংখ্যা অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিয়াত্তরের জুন মাস পর্যন্ত গুপ্তঘাতকদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গদলসমূহের কর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দুই হাজারকেও ছাড়িয়ে যায়।

রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও বহু নিরীহ ব্যক্তি প্রাণ হারায় গুপ্তহত্যা ও অন্যান্য সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে। ফলে, ১৯৭৩ সালের মে মাস পর্যন্ত ১৭ মাসে গুপ্ত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯২৫টিতে। আর পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে ৬০টি। ফলে দেশের সর্বত্র শহর, বন্দর, গঞ্জ ও গ্রামে নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতির সঞ্চার হয়। এই পরিস্থিতিকে নিজের সহিংসতার রাজনীতির সাফল্য মনে করে জাসদের সন্ত্রাসবাদী অংশ ও উগ্রপন্থী দলগুলো তাদের তৎপরতা ক্রমশ বৃদ্ধি করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন আদর্শ-চেতনা বিস্মৃত, সামাজিক অনাচার ও অর্থনৈতিক অনটনজনিত হতাশায় জর্জরিত এবং বিভ্রান্ত ও বিপথগামী বহু তরুণ সন্ত্রাসবাদী এই গ্রুপ ও দলগুলোতে যোগদান করে।’
[তথ্যসূত্র: পৃষ্ঠা ১৭৭,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ ॥ এম এ ওয়াজেদ মিয়া ॥ ইউপিএল ॥ চতুর্থ সংস্করণ ২০০০]

পাঁচ.

বাংলাদেশ এখন এক বড় বিপদে পড়েছে। এই বিপদ যেমন ঘরের বিপদ ঠিক তেমনি এর একটা বাইরের চেহারাও আছে। ভেতর-বাইরের মিলিত চক্রান্ত মোকাবিলা করবার কাজটি অত সহজ নয়। সেই কারণে আরো সতর্কতা আর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ দরকার। বাঙালির জাতিভাবনায় সামরিকীকরণের প্রবণতা আছে। আবার এটাও ঠিক বাঙালি,নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করতেও পারঙ্গম। সমস্যাটির বহুমাত্রিকতা অনুভব করা দরকার সবারই। নিজেদের মধ্যে বিভেদ যত বাড়ানো যাবে, শত্রুপক্ষ তার সুবিধা নেবেই। সে কারণেই দেখা দরকার আমরা মাথা ব্যথায় মাথা কাটছি কী না!
যে রক্তশ্রম দিয়ে আমরা আমাদের বিদ্যায়তনগুলো তৈরি করেছি,জঙ্গি বিপদ তাড়াতে তা আবার ধবংস করে ফেলছি কী না! কোথায় গলদ সেটা বের করাই জরুরি কাজ।

সবকিছুকে সমূলে উপড়ে ফেলে নিজেদের প্রতিষ্ঠান বিনাশ করে অন্যের বাজার আবার আমরা তৈরিই করছি কী না সেই ভাবনাটাও ভাবা দরকার।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সম্প্রচারের দুই দশকে...
সম্প্রচারের দুই দশকে...
‘মাঠে আমার শরীর কেউ স্পর্শ করতে পারেনি’
‘মাঠে আমার শরীর কেউ স্পর্শ করতে পারেনি’
দোকান সাজাতে গিয়ে গানচিত্র নির্মাণ!
দোকান সাজাতে গিয়ে গানচিত্র নির্মাণ!
বিতর্কিত দ্বীপ নিয়ে জাপানের কূটনীতিককে তলব দ. কোরিয়ার
বিতর্কিত দ্বীপ নিয়ে জাপানের কূটনীতিককে তলব দ. কোরিয়ার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ