X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

আইএস - ইউএস: উভয়ের টার্গেট কেন বাংলাদেশ?

আমীন আল রশীদ
১৬ জুলাই ২০১৬, ১৪:৩১আপডেট : ১৬ জুলাই ২০১৬, ১৪:৩৬

আমিন আল রশীদ ইসলামিক স্টেট এবং ইউনাইটেড স্টেট- আপাতদৃষ্টিতে আদর্শিকভাবে বেশ অমিল থাকলেও, উভয়ের টার্গেট এখন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মাটির নিচে এখন অব্দি তেল বা সোনার খনি আবিষ্কৃত হয়নি; গ্যাসের যা মজুদ আছে, তা নিয়েও অদূর ভবিষ্যতে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু নেই- কিন্তু তারপরও কিসের আকর্ষণে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস এবং বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে টার্গেট করলো, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। অর্থাৎ কোন মধুর টানে এখানে আইএস তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে চায় এবং সেই জানান দেওয়ায় কেন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়- তা জানা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশে যখনই জঙ্গিবাদ, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, আইএস বা আল কায়েদার মতো ইস্যুগুলো নিয়ে নানা ফোরামে আলোচনা তর্ক-বিতর্ক হয়, তখন আরেকটা প্রশ্ন সবাই করেন যে, বাংলাদেশকে কি আদৌ ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া বা আফগানিস্তান বানানো সম্ভব? সুতরাং এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও জরুরি।
২.
বাংলাদেশে আইএস আছে বা নেই-এই অহেতুক তর্কে সময় নষ্ট না করে বরং এটি এখন স্বীকার করে নেওয়াই সঙ্গত যে, বাংলাদেশ এরইমধ্যে আইএস-এর টার্গেটে পড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের চক্রে পড়ে গেছে উদার, অসাম্প্রদায়িক এবং অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে থাকা বিশাল জনশক্তির অপার সম্ভাবনাময় এই রাষ্ট্র। এখানে তেল বা সোনার খনি নেই- কিন্তু এখানে যা আছে তা তেল ও সোনার চেয়েও মূল্যবান। সেটি হলো এখানের ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিশাল জনগোষ্ঠী এবং সুবিধাজনক ভৌগলিক অবস্থান।
আইএস যে তথাকথিত ইসলামিক খেলাফতের কথা বলে, যেটি তারা ইরাক-সিরিয়ায় প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেরকম আরেকটি খেলাফত  প্রতিষ্ঠার জন্য তারা হয়তো ভাবছে যে, বাংলাদেশের প্রায় ১৫ কোটি মুসলমান- যারা ধর্মীয় বিষয়ে উগ্র বা গোঁড়া নয়, তারা একটা বড় শক্তি হতে পারে। আবার যদি এখানে তাদের সেই খেলাফত প্রতিষ্ঠা সম্ভব নাও হয়, তাহলে এখানের সুবিধাজনক ভৌগলিক অবস্থান ব্যবহার করে ভারত-পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে নিজেদের নজরদারি বহাল রাখতে পারে। যে কারণে তারা এখানে সংখ্যালঘু হিন্দু, খ্রিস্টান, নাস্তিক ব্লগার, মুক্তমনা লেখকদের ওপর হামলা চালিয়ে বা তাদের হত্যা করে একটা বার্তা দিতে চাচ্ছে বা এরইমধ্যে হয়তো দিয়েছে যে, তারা চাইলে এর চেয়ে আরও বড় হামলা চালাতে পারে; যার একটা মহড়া সম্ভবত তারা দেখিয়েছে গুলশানে। যদিও সরকার এখনও স্বীকার করেনি যে, এই আইএসই  ঘটিয়েছে।

আইএস, আল কায়েদা বা আনসার আল ইসলাম কিংবা জেএমবি- নাম যাই হোক না কেন, তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য মোটামুটি অভিন্ন। সুতরাং আমরা যদি সরাসরি আইএস এখানে আছে বা নেই এই তর্কের বাইরে থেকেও আলোচনা করি, তারপরও এটা মেনে নিতে হবে যে, আমরা এরইমধ্যে জঙ্গিদের নিশানায় পরিণত হয়েছি এবং এখানে তারা তাদের মিশন বাস্তবায়নে আরও বড় কোনও ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করবে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, সিরিয়া বা ইরাকে এখনও আইএস তাদের কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কারণ গৃহযুদ্ধের মধ্যে বা রাষ্ট্রীয় অস্থিতিশীলতার মধ্যে কোনও ধরনের সরকার কাঠামোই আসলে কার্যকর থাকে না। সুতরাং সিরিয়া ও ইরাকে সফলতার আগেই তারা খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশকে কেন টার্গেট করবে?

হতে পারে এমন যে, তারা সিরিয়া ও ইরাকে এখন বেশ মার খাচ্ছে বলে নিজেদের বিশ্বের নানা প্রান্তে তারা ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছে এবং তারা যে ছড়িয়ে যাচ্ছে সেটি প্রমাণের জন্যই আজ এখানে তো কাল ওখানে হামলা চালাচ্ছে বা হামলার পর দায় স্বীকার করে কথিত বিবৃতি দিচ্ছে।

৩.

কিন্তু বাংলাদেশে যদি আইএস – এর সাংগঠনিক কার্যক্রম সত্যিই থেকে থাকে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বিগ্ন হওয়ার কী কারণ? এটি হয়তো খুব সিলি প্রশ্ন। কেননা একই প্রশ্ন করা যায়, ইরাকে ক্ষমতায় সাদ্দাম হোসেন থাকবেন নাকি লিবিয়ায় গাদ্দাফী- সেই সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা তো সে দেশের জনগণের; সেখানে সুন্নি সরকার থাকবে নাকি শিয়া-সেই সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিকও জনগণ। যুক্তরাষ্ট্রের এ নিয়ে মাথাব্যথা কেন?

যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু নিজেকে সারা পৃথিবীর মানবাধিকার ও নিরাপত্তার ‘সোল এজেন্ট’ বলে দাবি করে, সেহেতু সে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে খুন করে এবং তারপর সেখানে সমস্যার ডিম ভেঙে নতুন সমস্যার ডিম পাড়ায়। একই অবস্থা লিবিয়া ও মিশরে। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে যখনই কোনও সন্ত্রাসী হামলা হয়, তৎক্ষণাৎ তাতে উদ্বেগ জানায় যুক্তরাষ্ট্র। খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেন। ফলে এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের যেকোনও বিষয়েই যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কনসার্ন। কিন্তু এই কনসার্নের মূল কারণ কী এই যে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ভালো বন্ধু অথবা উন্নয়নের অংশীদার? সম্ভবত তা নয়।

বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রেরও এই উদ্বেগের বড় কারণ সুবিধাজনক ভৌগলিক অবস্থান- যে সুবিধা কাজে লাগাতে চায় আইএসও। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ পৃথিবীর অর্থনীতির নেতৃত্ব যদি চীন ও ভারতের হাতে চলে যায়; এশিয়ার এই পরাক্রমশালী দুটি দেশ যদি পুরো বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে- সেটি নতুন কোনও স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করবে কি না,যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এখন থেকেই সেটি হিসাব করছে। ফলে এই অঞ্চলে নিজের নজরদারি তথা আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশকে তার প্রয়োজন।

এ কারণে বাংলাদেশে একটি নৌঘাঁটি করতে পারলে তার খুব সুবিধা। ফলে যেকোনও সন্ত্রাসী হামলার পরই যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার প্রস্তাব দেয় এবং কিছু ঘটনার পরে তাদের গোয়েন্দা বাহিনী এফবিআই বাংলাদেশ ঘুরেও গেছে। অর্থাৎ কোনও না কোনও অজুহাতে বাংলাদেশে নিজেদের সৈন্য রাখতে পারলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক বেশি সুবিধার।

এখানে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি বড় স্বার্থ হলো ধর্মীয়। অর্থাৎ মুসলমানদের হাত থেকে পবিত্রভূমি জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের নামে একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপজুড়ে যে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ চলেছে, যেভাবে মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছে, তার রেশ এখনও মানুষের মগজে রয়ে গেছে। অতএব সারা বিশ্বে খ্রিস্টানদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং আইএস –এর মতো চরপন্থি সংগঠনগুলো যাতে কোনও পাল্টা ক্রুসেড শুরু করতে না পারে, সে বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্ব উদ্বিগ্ন। সুতরাং শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের যে প্রান্তেই ইসলামের নামে এরকম কোনও সংগঠন মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র তাতে উদ্বিগ্ন হবেই।     

৪.

এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে আইএস ও ইউএস উভয়ের যে স্বার্থ তা রক্ষা করার সুযোগ করে দিচ্ছে কে? কেননা কোনও দেশেই জঙ্গিবাদ বিস্তৃত হতে পারে না, যদি সেখানের জনগোষ্ঠী বা স্থানীয় রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা না পায়।

বিএনপি জামায়াত যদি মনে করে যে, দেশ অস্থিতিশীল হলে, সরকার নড়বড়ে হলে তার সুবিধা, অতএব জঙ্গিদের জন্য দরজা খুলে দিলাম- সেটি বিএনপির জন্য যেমন আত্মঘাতি, তেমনি সরকার যদি মনে করে যে, দেশে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড না ঘটলে বিএনপি-জামায়াতকে জঙ্গিবাদের দোসর বলে আখ্যা দিয়ে তাদের দমন করা যাবে না- সেটিও আত্মঘাতি এবং সম্ভবত এখন আমরা সেই আত্মঘাতি সময়ই পার করছি।

আইএস ও ইউএস-এর স্বার্থ রক্ষার পেছনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যর্থতাও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেননা একদিকে তারা বলে সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে। অথচ সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গায়ই জঙ্গি হামলা হয় আবার সেই পরিস্থিতি উত্তরণে খোদ সেনাবাহিনী তলব করতে হয়।

তবে এতকিছুর পরেও আশার কথা হলো, বাংলাদেশের জনগণ জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদকে কখনোই সমর্থন করেনি। এখানে ধর্মীয় রেষারেষি নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। ফলে মাদারীপুরে একজন শিক্ষককে হত্যা করতে গিয়েও জনগণের হাতে ধরা পড়ে যায় একজন জঙ্গি। এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। এই শক্তি যতদিন থাকবে, ততদিন বাংলাদেশকে সিরিয়া বা ইরাক বানানো কঠিন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি ব্লেম গেম বন্ধ না হয় এবং আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীগুলো যদি আরও শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ না হয়-তাহলে জনগণের ওই শক্তিও আখেরে ব্যর্থ হবে।

লেখক: সাংবাদিক

আরও খবর: জামায়াত জাতীয় ঐক্যের অল্টারনেটিভ কেন?

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ