X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভাইরা বোনদের বাঁচায় নাকি মারে?

তসলিমা নাসরিন
১৭ জুলাই ২০১৬, ১৭:০০আপডেট : ১৭ জুলাই ২০১৬, ১৭:৪৫

তসলিমা নাসরিন কান্দিল বালোচ নামের এক পাকিস্তানি মডেল মেয়েকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে তার ভাই। তার কোনও শত্রু নয়, অচেনা কোনও ধর্ষক নয়, তার ভাই, পাড়াতুতো নয়, পাতানো নয়, আপন ভাই। মেয়েদের সবচেয়ে বেশি মারে এরাই, এই আত্মীয়রাই বা কাছের মানুষরাই, এই বাবা, ভাই, স্বামী বা প্রেমিকরাই। পুরুষদের মারে তাদের শত্রুরা। আর মেয়েদের মারে মেয়েদের সবচেয়ে আপন লোকেরা।
মেয়েদের এরা মারে কারণ এরা মনে করে মেয়েরা এদের 'জিনিস'। মেয়েরা এদের পছন্দ মতো না চললে এরা মেরে ফেলতে পারে। এরা বিশ্বাস করে মেয়েদের যা খুশি তাই করার অধিকার এদের আছে। এরা চাইলে মেয়েদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে, মেরেও ফেলতে পারে। মেয়েদের বাঁচা মরা ভালো থাকা মন্দ থাকা সব এদের ওপর। কান্দিল বালোচ তার ভাই-এর পছন্দে চলেনি। নিজের পছন্দে চলেছে। সে কারণেই ভাইয়ের রাগ। সে কারণেই মেরে ফেলা।
পুরুষদের কিন্তু এই সমস্যাটা নেই। তাদের কিন্তু মা, বোন, স্ত্রীদের পছন্দ অনুযায়ী চলার দরকার হয় না। তারা নিজের পছন্দ মতোই চলে। তাদের বাঁচা-মরা কিছুই নির্ভর করে না মেয়েদের ওপর। বোনের পছন্দে না চললে বোনেরা তাদের মেরে ফেলে না।
কান্দিল বালোচ আমেরিকার কিম কারদাশিয়ানের মতোই। শরীর দেখিয়ে নাম করেছে। কিম যা ক'রে কোটি টাকা রোজগার করে  আমেরিকায়, একই জিনিস করে কান্দিলকে খুন হয়ে যেতে হয় পাকিস্তানে। কান্দিল বালোচের সাত লাখ ফেসবুক ফলোয়ার আর  তেতাল্লিশ হাজার টুইটার ফলোয়ার ছিল। তার জনপ্রিয়তা ছিল, হোক না সে সস্তা জনপ্রিয়তা। সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করলে কি তার বাঁচার অধিকার থাকে না?
মেয়েরা তাদের শরীর দেখালে, শরীর নিয়ে কিছু লিখলে, শরীরের ছবি আঁকলে লোকে বলবেই মেয়েরা এসব করেছে ‘সস্তা জনপ্রিয়তার’ জন্য। একই কাজ করলে পুরুষকে কিন্তু এই দোষ দেওয়া হয় না। ‘সস্তা জনপ্রিয়তা’– এই শব্দদ্বয় মেয়েদের দোষ দিতে গেলেই মূলত ব্যবহার করা হয়। ভাবটা এমন, মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে জনপ্রিয়তা অর্জন যদি করতেই হয়, শুধু 'দামী জনপ্রিয়তা'ই অর্জন করতে হবে। সস্তা টস্তা চলবে না। কোন জনপ্রিয়তা সস্তা, কোনটা দামী – তা নির্ধারণ করবে পুরুষ। মেয়েদের শরীর দেখিয়ে যে জনপ্রিয়তাটা জোটে, সেটা কিন্তু পুরুষদের কারণে। পুরুষরা পছন্দ করে বলে। অথচ পুরুষরাই কিন্তু জনপ্রিয় হওয়ার দোষ মেয়েদের দেয়, মেয়েদের জনপ্রিয় করার দোষ সেই পুরুষদের দেয় না, যারা ওই মেয়েদের জনপ্রিয় করে। এ অনেকটা মেয়েদের যারা বেশ্যা বানায়, তাদের মতো। তারাই নিজেদের স্বার্থে মেয়েদের বেশ্যা বানায়, তারাই বেশ্যা গমন করে, অথচ বেশ্যা হওয়ার দোষটা নির্লজ্জভাবে মেয়েদের দেয়। বেশ্যা হওয়া মেয়েদের তারা আবার ঘৃণা করতেও  ভোলে না।

কান্দিল বালোচের জনপ্রিয়তা পাকিস্তানি পুরুষদের মধ্যেই ছিল। তাকে ঘৃণা করার লোকের অভাব ছিল না। বিছানায় শোয়া ওর ছবি দেখবো, ওর স্তন আর উরু দেখবো, ওর সৌন্দর্য দেখবো, সুখ  পাবো, ওকে স্পর্শ করার জন্য পাগল হবো কিন্তু ওকে ঘৃণা করবো। কান্দিলের ভাইয়ের আর কিছু না থাক, ওই ঘৃণাটা ছিল। 

সামাজিক নিয়ম নীতি আচার আচরণ কান্দিল মানেনি বলেই ঘৃণা। কান্দিলের ভাই ওয়াসিম কান্দিলকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। নিজেই স্বীকার করেছে যে করেছে, বলেছে, পরিবারের সম্মান রক্ষা করার জন্য নাকি হত্যা করেছে। ওই এক ঘটনা, ওর পরিবারের সম্মানটা কান্দিলের স্তনে আর উরুতে লুকিয়ে ছিল। যেইনা কান্দিলের কাপড় তার উরু আর স্তন থেকে সামান্য সরেছে, ওমনি গোটা পরিবারের সম্মানটা তার উরু আর স্তন থেকে কর্পূরের মতো উড়ে গিয়েছে।

কান্দিল গানও গাইতো। কান্দিলের প্রতিভা নিয়ে গর্ব করা উচিত ছিল ওয়াসিমের। কিন্তু গর্বের বদলে সে অপমানিত বোধ করেছে। পাকিস্তানের নারীবিরোধী সমাজ কান্দিলকে নিয়ে গর্ব করতো না, তাকে নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগতো। ওই সমাজে বোরখা পরা মেয়েরা, পুরুষের দাসী মেয়েরা, বোবা বধির হয়ে থাকা মেয়েরা, আত্মসম্মানবোধহীন মেয়েরা ‘ভালো মেয়ে’ হিসেবে গণ্য হয়, বাকি সব মেয়েই ‘খারাপ মেয়ে’। কান্দিল ছিল খারাপ মেয়ের তালিকায়। এই তথাকথিত ‘খারাপ মেয়েরা’ই কিন্তু সমাজ বদলায়, সমাজে বিবর্তন আনে, এই খারাপ মেয়েদেরই কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। এই খারাপ মেয়েরাই মেয়েদের সম্মান আর স্বাধীনতা আদায়ের জন্য বড় এক বিপ্লব। নারী-আন্দোলনের প্রচুর সংস্থা সংগঠন আছে, ওসবের ভালো মেয়েরা একশ বছরে যা করতে পারে না, তা এক বছরেই খারাপ মেয়েরা করতে পারে। এ কি কম কথা?

কান্দিল বালোচ লিখেছিল, ‘অল্প বয়সেই  জীবন আমাকে শিখিয়েছে অনেক, সেই কিশোরী থেকে স্বনির্ভর নারী হওয়ার পথটি আমার কখনই মসৃণ ছিল না।' লিখেছিল, 'নারী হিসেবে আমাদের সব নারীর জন্য লড়া উচিত। প্রত্যেক নারীর পাশে প্রত্যেক নারীর দাঁড়ানো উচিত।' খুব জরুরি কথা বলেছে কান্দিল। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে নারীরা কি কান্দিলের পাশে দাঁড়িয়েছে? কান্দিলের হত্যার প্রতিবাদে কি মুখর হয়েছে নারীরা? দুনিয়ার তাবৎ বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে পুরুষরা দাঁড়ায়, তারা কি কান্দিলের পক্ষে রাস্তায় নেমেছে? নাকি কান্দিলের জনপ্রিয়তা সস্তা ছিল বলে তারা ঘেন্না করেছে পাশে দাঁড়াতে, রাস্তায় নামতে?

সমাজের 'সম্মান' রক্ষার্থে পাকিস্তানের লাখ লাখ নারীবিদ্বেষী পুরুষ কান্দিলকে মনে মনে খুন করেছে, আর পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে কান্দিলকে সত্যিকারের খুন করেছে তার মায়ের পেটের ভাই ওয়াসিম। কান্দিল বালোচ আমাকে টুইটারে ফলো করতো। এ খবরটি জেনে আমি সম্মানিত বোধ করছি। নিশ্চই আরও অনেকে সম্মানিত বোধ করেছে কান্দিলের মতো সৎ ও সাহসী মেয়ে সংস্পর্ষে এসে।

শত শত পাকিস্তানি মেয়ে প্রতি বছর 'অনার কিলিং'-এর শিকার হচ্ছে। আমি আসলে এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে অনার কিলিং বলতে চাই না। আমি একে বলতে চাই নারী হত্যা। খুব পরিকল্পিতভাবেই  প্রতিভাময়ী, বুদ্ধিদীপ্ত মেয়েদের, লড়াকু মেয়েদের, আত্মসম্মানবোধ প্রচুর এমন মেয়েদের, মাথা উঁচু করে চলা মেয়েদের সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে। এদের দেখে ভয় হয় পুরুষদের। না জানি এরাই পুরুষতন্ত্রকে সমাজকে থেকে ঝেটিয়ে বিদেয় করে। না জানি এরাই পুরুষদের দাসি হওয়ার বদলে প্রভু বনে যায়। এই সর্বনাশকে কেউ ডেকে আনতে চায় না। তাই বিনাশ চলছে এর। যখনই খবর বেরোয় মেয়েদের খুন করেছে বাবা, ভাই, স্বামী—অধিকাংশ মানুষ চুপ করে থাকে। ব্যাপারটা এমন—‘ওদের জিনিস ওরা খতম করেছে, আমাদের তাতে কী? আমাদের নাক গলানো সম্পূর্ণই অনুচিত।' আর কবে মানুষ বুঝবে যে মেয়েরা কারও ব্যাক্তিগত সম্পত্তি নয়, কারও কেনা জিনিস নয়।

কান্দিলের বাবা শুনেছি পুলিশের কাছে নিজের ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তার ছেলেই যে তার মেয়েকে খুন করেছে, তা তিনিই বলেছেন, খুনের বিচারও চেয়েছেন। এ চমৎকার ব্যাপার। সমাজে কান্দিলের ভাইয়ের মতো পুরুষ দরকার নেই, কান্দিলের বাবার মতো পুরুষ দরকার।

আর সমাজে কান্দিল বালোচের মতো সহস্র নারী দরকার, যারা সমাজের পুঁতিগন্ধময় পুরুষতন্ত্রকে মোটেও পুছবে না। এবং যা ইচ্ছে করে তাই করে বেড়াবে।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ