X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ছাত্র রাজনীতির বিষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়

প্রভাষ আমিন
১৮ জুলাই ২০১৬, ২০:০৬আপডেট : ১৯ জুলাই ২০১৬, ০০:৩০

প্রভাষ আমিন কিছু একটা ঘটলেই আমরা শর্টকাট সমাধান খুঁজি। সেই সমাধানটা প্রায়ই হয় মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো। এতদিন আমরা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের জন্য মাদ্রাসা ছাত্র আর গ্রামের গরিব পরিবারের সন্তানদের দায়ী করে আরামে তাদের গালিগালাজ করে দিন কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু গুলশানের ঘটনার পর এই ধারণায় প্রবল একটা ধাক্কা লাগে। সেই ধাক্কা এতটাই প্রবল যে, আমাদের মধ্যবিত্তসুলভ আয়েশের কাচের ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এখন আমরা ব্যাকুল হয়ে গেছি, কিভাবে আমাদের সন্তানদের রক্ষা করা যায়। গরিবের সন্তান আইএস হোক, জঙ্গি হোক আমাদের সন্তান না হলেই হলো।
গুলশান এবং শোলাকিয়ার ঘটনায় অংশ নেওয়া জঙ্গিদের অনেকে দেশের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি নাম আসছে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে নানা সমালোচনা আছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা, উচ্চ টিউশন ফি, মানসম্মত ক্যাম্পাস না থাকা ইত্যাদি অভিযোগের অন্ত নেই। এই ব্যাঙের ছাতার ভিড়েও নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছিল। কিন্তু এখন সে সুনামে ধস নেমেছে। এটা ঠিক, কয়েকজন ছাত্র জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত হলেই পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ী করা উচিত নয়। আর সব জঙ্গিই যে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাও হয়তো ঠিক নয়। হিযবুত তাহরীরের প্রধান সমন্বয়ক মহিউদ্দিন তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাই বলে তো আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ী করা যাবে না। ব্যক্তির দায় কখনও প্রতিষ্ঠানের নয়।
তবে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এত সহজে পার পাবে না। কারণ তাদের জঙ্গি সম্পৃক্ততা বহুমুখী এবং পুরনো। রাজীব হায়দার নিহত হওয়ার ঘটনায়ও নর্থ-সাউথের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা ছিল। জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক অভিযুক্ত। এবার গুলশান এবং শোলাকিয়ার ঘটনার পর আবার এসেছে নর্থ-সাউথের নাম। নিবরাস, আবির তো ছাত্র ছিলই, এমনকি সেদিন হলি আর্টিজানে সপরিবারে উপস্থিত থেকেও নিরাপদে বেরিয়ে আসা নর্থ-সাউথের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে নিয়েও নানা সন্দেহ ডালপালা মেলছে। এমনকি জঙ্গিদের বাসা ভাড়া দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে নর্থ-সাউথের প্রো-ভিসি অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহসানকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। সব মিলিয়ে নর্থ-সাউথকে সন্দেহ করার যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে।

দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ভূত আছে সর্ষের মধ্যেই। নর্থ-সাউথের উদ্যোক্তাদের মধ্যেই সমস্যা আছে। প্রতিষ্ঠানটির পাঠাগার, প্রেয়ার রুম নিয়েও সমস্যা আছে। তবে নর্থ-সাউথকে কেন্দ্র করে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু ব্যাপারটা খুব ভয়ঙ্কর। জঙ্গি সমস্যার শেকড় আরও অনেক গভীরে। হুট করে ইংলিশ মিডিয়াম আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা হবে আত্মঘাতী।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি চালুর দাবি উঠেছে। গত রোববার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকারের একাধিক মন্ত্রী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতবিনিময় সভায় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এই দাবি তুলেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি রাজনীতিমুখী মানুষ। রাজনীতির একশ’টা, হাজারটা সমস্যা আছে। কিন্তু রাজনীতিই আমাদের শেষ আশ্রয়। আমরা যত সমালোচনাই করি, রাজনীতিবিদরাই দেশ চালান, নীতি নির্ধারণ করেন। ‘আমি রাজনীতি ঘৃণা করি’ এই মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম দেশের জন্য খুব বিপদজনক। তাহলে কি আমরা নিজেরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকবো আর জেনেশুনে দুর্বৃত্তদের হাতে দেশটা লিজ দিয়ে দেবো? রাজনীতিমুখী মানুষ হিসেবে আমার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি চালুর দাবির প্রতি সমর্থন জানানো উচিত। কারণ সুস্থ ছাত্র রাজনীতি একজন মানুষের মধ্যে নেতৃত্বগুণের বিকাশ ঘটায়, তাকে দায়িত্বশীল করে তোলে, দেশপ্রেমিক করে তোলে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি চালুর প্রবল বিরোধিতা করছি। বর্তমানে দেশে ছাত্র রাজনীতির নামে যা চলছে, তা নিয়েই আমার প্রবল আপত্তি। সেই বিষ আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে দিতে রাজি নই। এমনিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিষ ঢুকেছে। সবাই মিলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সেই বিষমুক্ত করতে হবে। নতুন কোনও বিষ দিয়ে তাকে আরও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না।

বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র আন্দোলনের গৌরবজনক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের যে নতুন অভিযাত্রা শুরু হয়েছে, তার পর থেকেই শুরু হয়েছে ছাত্র রাজনীতির পচন। এরশাদের স্বৈরাচারী আমলেও ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক আমলে ডাকসু নির্বাচন আর হয়নি। নির্বাচন হয় না বিভিন্ন বিশ্ববিবিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র সংসদেও। ফলে নেতৃত্বের পাইপ লাইনটা আমরা আটকে রেখেছি। সুস্থতার পাইপ লাইনটা বন্ধ করে আমরা অসুস্থতার আমদানি করেছি অবাধে। এরশাদের আমলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান ছিল। তখন আমরা জানতাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের উত্তর পাড়া ছাত্রদলের দখলে আর দক্ষিণ পাড়া ছাত্রলীগের। হলে হলে আলাদা ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য ছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় পা রাখার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে এককেন্দ্রিক। এখন যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, ক্যাম্পাসে শুধু তাদের তৎপরতাই থাকে। বাকিরা রীতিমত নিষিদ্ধ। যেমন এখন ছাত্রলীগের একক নিয়ন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস। ছাত্রদলের কোনও অস্তিত্ব নেই। আবার যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল তখন ছিল উল্টো চিত্র। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি বদলে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল।

ছাত্র রাজনীতির এখন কোনও লক্ষ্য নেই। ভাষার দাবি, শিক্ষার দাবি, স্বৈরাচার পতনের দাবি, সমাজ বদলের দাবি- এমন কোনও মহৎ উদ্দেশ্য নেই তাদের সামনে। অবশ্য একেবারে কোনও লক্ষ্য নেই তা বলা যাবে না। এখন ক্ষমতাসীনদের ছাত্র সংগঠনের মূল লক্ষ্য দ্রুত বড়লোক হওয়া, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা। সবাই না হলেও ছাত্রনেতাদের এখন মূল কাজ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মূল দলের নেতাদের হয়ে লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন হলের সিট বরাদ্দ দেয় ছাত্রলীগ নেতারা। যেহেতু অন্য সংগঠনের কেউ নেই, তাই ছাত্রলীগই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেরা নিজেরা কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। সেই কোন্দল কখনও কখনও প্রাণঘাতী সংঘর্ষেও পরিণত হয়। গত কয়েক বছরে ছাত্রলীগ তাদের যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে, তা তাদের তাদের দীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যে কালিমা লেপন করেছে। কখনও কখনও ছাত্রলীগকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন নয়, বোঝা মনে হয়।

এই যখন দেশের ছাত্র রাজনীতির অবস্থা, তখন কখনও কখনও ছাত্র রাজনীতিই বন্ধের দাবি ওঠে। এই অবস্থায় এই বিষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকানোর কোনও মানে নেই। ছাত্র রাজনীতি চালু করলেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জঙ্গিমুক্ত হয়ে যাবে, এমন ধারণা যদি কেউ করেন তাহলে ভুল করবেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট সচেতন। কিছু দিন আগে ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের সচেতনতা এবং সৃজনশীলতার প্রমাণ রেখেছে। তাদের দাবি আদায় হয়েছে, কিন্তু একটিও গাড়ি ভাঙেনি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, প্রচলিত ধারার ছাত্র রাজনীতি থাকলে, সে আন্দোলনে সাংঘর্ষিক হতো। তাই মাথা ব্যাথার জন্য মাথা কেটে ফেলার কথা না ভেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আরও সচেতন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের ক্যাম্পাসে নজরদারি আরও বাড়াতে পারে, যাতে সন্দেহজনক কোনও তৎপরতা চলতে না পারে। আর প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারের নিয়ম মেনে আলাদা ক্যাম্পাস করতে হবে। সেখানে মাঠ থাকবে। পাঠ বহির্ভূত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। সাংস্কৃতিক জাগরণের মাধ্যমেই জঙ্গিবাদের এই বিষ থেকে মুক্ত করতে হবে আমাদের তারুণ্যকে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভ্যাটেই মিলবে রাজস্ব, অথচ ভ্যাট বাড়াতে অনীহা
ভ্যাটেই মিলবে রাজস্ব, অথচ ভ্যাট বাড়াতে অনীহা
বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে
গ্লোবাল স্কিলস ফোরামে বক্তারাবাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ