X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাঘের পিঠে সওয়ার হলেন এরদোয়ান

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২১ জুলাই ২০১৬, ১২:৫৯আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৬, ১৩:১১

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী গত শুক্রবার ১৫ জুলাই তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। সামরিক বাহিনীর সম্পূর্ণ সমর্থন না থাকায় অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হয়ে গেছে। ১৯৬০, ১৯৭১, ১৯৮০ সালেও তুরস্কে তিন বার সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল। তবে ওই তিনটি অভ্যুত্থান সফল ছিল। তুরস্কে সেনাবাহিনীর অবস্থান খুবই মজবুত, তাদের জনপ্রিয়তাও রয়েছে। তবে কিছু সেনাবাহিনীর লোক বিচ্ছিন্ন হয়ে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছে বলে এবার সফল হতে পারেনি। সেনাবাহিনী প্রধানকে সেনা ছাউনিতে আটক রেখে সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করাটাই বোকামি হয়েছে।
২০০৩ সালে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হন। তখন থেকেই সামরিক বাহিনীর সঙ্গে এরদোয়ানের স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। এরদোয়ান সব সময় সামরিক বাহিনীর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উত্থাপন করে থাকেন। ২০১০ সালে ৪০ জন সামরিক অফিসারকে গ্রেফতার করে তাদের বিচার করেছিলেন। এ ৪০ জন অফিসারের মাঝে একজন জেনারেল আর চারজন এডমিরাল ছিলেন। নতুন তুরস্কের জনক ছিলেন কামাল পাশা। নব্য তুর্কিদেরও নেতা ছিলেন কামাল পাশা। নব্য তুর্কিরা ছিল সেনাবাহিনী থেকে আসা কিছু যুবক অফিসার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্র শক্তি যখন তুরস্ককে নিজেদের মাঝে ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছিল তখনই নব্য তুর্কির দল প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিল কামাল পাশার নেতৃত্বে। সফলও হয়েছিলেন। এজন্য তুর্কিরা তাকে আতাতুর্ক বা পিতা বলে ডাকে।
ওই সময় তুর্কিদের সুলতান ছিলেন ওয়াহিদুদ্দীন। তিনি ছিলেন মিত্রশক্তির হাতের পুতুল। মিত্রশক্তি সুলতান ওয়াহিদুদ্দীনকে দিয়ে কামাল পাশাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। তুরস্কের মোল্লার দল খলিফা ওয়াহিদুদ্দীনের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন এবং তারা ‘খলিফা সেনা’ গঠন করে কামাল পাশাকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছিলেন। বিষয়টা অনেকটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তথাকথিত ইসলামপন্থীদের রাজাকার, আল-বদর বাহিনী গঠনের মতো ছিল। তুরস্কের মোল্লারা ঘোষণা করেছিল যারা কামাল ও তার সমর্থকদের হত্যা করতে পারবে তারা ইহলোকে পুরস্কার ও পরলোকে পুণ্যের অধিকারী হবে।
দীর্ঘ সময়ব্যাপী খলিফা সেনাদের সঙ্গে নব্য তুর্কিদের যুদ্ধ হয়েছিল। এটা ছিল গৃহযুদ্ধ। নব্য তুর্কিদের জন্য সেটা ছিল খুবই কঠিন সময়। কারণ ধর্মের অনুশাসন ছিল সম্পূর্ণভাবে তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু কামাল পাশার একটা মাত্র কথা ছিল- 'হয়তো জিতবো, না হয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো'। এক আমেরিকান সাংবাদিক কামালকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনারা জাতীয়তাবাদীরা যদি হেরে যায় তখন কী করবেন? কামাল বলেছিলেন, ‘জীবন ও স্বাধীনতার জন্য চরম আত্ম-উৎসর্গ করতে পারে যে জাতি- সে হারে না। হারলে বুঝতে হবে সে জাতি বেঁচে নেই।' শেষ পর্যন্ত কামাল পাশা জিতেছিলেন এবং নব্য তুর্কি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কামাল পাশা তুর্কি সেনাবাহিনী গড়ে ছিলেন সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী লোকজন নিয়ে। তুরস্কের সৈন্য বাহিনী এখনও কামাল পাশার ধর্মনিরপেক্ষবাদে উজ্জীবিত। যখনই কোনও শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িতে জড়িত হন তখনই সেনাবাহিনী এর প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
এরদোয়ান তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গঠন করেছিলেন ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা নেকমতিন এরবাকনের ছত্রছায়ায়। এ দলটি অতি ইসলামপন্থী হওয়ায় সেনাবাহিনীর ইচ্ছানুসারে বেআইনি ঘোষিত হয়। এই পার্টির লোকগুলো প্রথমে ভার্চু পার্টি গঠন করেন পরে নাম পরিবর্তন করে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি গঠন করা হয়। বর্তমান এ পার্টিই ক্ষমতাসীন এবং এরদোয়ান প্রেসিডেন্ট। আসলে এরদোয়ান হচ্ছেন ‘খলিফা সেনার’ উত্তরসূরি। তার মূল দল ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির স্রষ্টা নেকমত্তিন এরবাকন ছিলেন ইকওয়ানুল মুসলিমিনের আদর্শে বিশ্বাসী এবং তিনি ক্যাডার ভিত্তিক দল হিসাবে ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টি গঠন করেছিলেন। এরবাকন খুবই দক্ষ সংগঠক ছিলেন এবং জনপ্রিয়ও ছিলেন। তিনি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ওয়েলফেয়ার পার্টি হতে পর্যায়ক্রমে এসে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির রূপ নিয়েছে। এরদোয়ানও জনপ্রিয় লোক। তার সুসংগঠিত পার্টির কারণে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে নিমিশে হাজার হাজার লোক জমায়েত করতে পেরেছেন।

এরদোয়ান দুইবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তুরস্কের শাসনতন্ত্র তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনও ব্যবস্থা না থাকায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি প্রেসিডেন্ট হন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি শাসনতন্ত্র সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার পদ্ধতি থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতিতে রূপান্তর করে ফেলেন। অনেকের অভিযোগ তিনি এখন কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছেন। বুদ্ধিজীবী মহল এখন চেষ্টা করছেন তার বিরুদ্ধে একটা সফল গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত করার। উদারপন্থী কোনও বুদ্ধিজীবীরই সমর্থন এরদোয়ানের প্রতি নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে এরদোয়ান পাহাড়ের ওপর প্রেসিডেন্ট হাউস তৈরি করেছেন। এটি পরিসরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভবন হোয়াইট হাউসের চেয়ে বড়। ১ হাজার কক্ষ বিশিষ্ট। ৯১৬ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে এ প্রসাদখানা তৈরি করতে। এটাকে অনেকে ভালো চোখে দেখেনি। অনেকে বলেছেন সুলতান এরদোয়ানের রাজ প্রাসাদ। ইস্তাম্বুল এবং আনকারার বুদ্ধিজীবীদের অভিযোগ আইএস-এর প্রতি এরদোয়ানের দুর্বলতা রয়েছে। আইএস ইরাকের তেলক্ষেত্র থেকে তেল উত্তোলন করে প্রতিদিন নাকি তুরস্কের ওপর দিয়ে বিদেশিদের কাছে তেল বিক্রি করে। তুরস্ক দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে এরদোয়ান ও তার মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার এরদোয়ান সামরিক বাহিনীকে ছাকনি দিয়ে ছাকবার সুযোগ পেয়েছে। এর মাঝে নাকি শুধু নয় হাজার পুলিশ গ্রেফতার করেছে। বহু সৈন্যবাহিনীর অফিসারও গ্রেফতার করেছে। পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা অভিযোগ করেছেন গ্রেফতার হওয়া সৈন্য ও পুলিশের ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হচ্ছে তা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য তারা এরদোয়ানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ছয় লাখ আশি হাজার সদস্য বিশিষ্ট তুরস্কের সেনাবাহিনী, যারা ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির আবহাওয়ায় গড়ে উঠেছে তাদেরকে এরদোয়ান রাতারাতি পাগড়ি পরিয়ে মোল্লা বানাতে পারবেন না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তাকে সম্মিলিত বাহিনীর দ্বিতীয় অভ্যুত্থান মোকাবেলা করতে হবে। যা মোকাবেলা করার ক্ষমতা এরদোয়ানের নেই। এরদোয়ানকে বুঝতে হবে তাকে এ ব্যর্থ অভ্যুত্থান বাঘের ওপর তাকে সওয়ারি বানিয়ে ছেড়েছে। যে কোনও ভুল পদক্ষেপ তাকে বিধ্বস্ত করে ফেলবে। তুরস্কের সেনাবাহিনী ‘জানিসারি’ সেনাবাহিনীর উত্তরসূরি, যাদেরকে ইউরোপের ধর্মপ্রণায়ন খ্রিস্টানেরা ‘ঈশ্বরের চাবুক’ বলে অবহিত করতো। এসব কিছু ভুলে গেলে এরদোয়ান তলিয়ে যাবেন।

অভ্যুত্থানের পর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে মাঠে নেমেছেন এটাও বাড়াবাড়ি। এরদোয়ানের দল রাজনীতির ইসলাম নিয়ে এ সময় অতি উৎসাহী হলে পশ্চিমা বিশ্বেরও প্রতিরোধের মুখে পড়বেন। অভ্যুত্থান প্রতিরোধের প্রথম আহ্বান আসে আনকারা এবং ইস্তাম্বুলের মসজিদের মাইক থেকে। এ আহ্বান সারারাত অব্যাহত থাকে। এখন এরদোয়ানের সব শক্তিই ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। বেশি বাড়াবাড়িতে জড়িত হলে এরদোয়ানের রাজনৈতিক ইসলাম এবং সৈন্যবাহিনীর ধর্মনিরপেক্ষবাদ এর মাঝে একটা সংঘাত এগিয়ে আসার সম্ভবনা তৈরি হবে, যা তুরস্কের জন্য মঙ্গল হবে না।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 আরও খবর: ‘তুরস্কের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার কথা আগে থেকেই জানত যুক্তরাষ্ট্র’

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১৪ পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি
টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১৪ পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি
১৮ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন বিসমাহ মারুফ 
১৮ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন বিসমাহ মারুফ 
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ