X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নোবডি কিল্‌ড মিতু

আহসান কবির
২১ জুলাই ২০১৬, ১৫:২৩আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৬, ১৫:৩৩

আহসান কবির এই লেখাটা অসময়ের। এই লেখাটা পুলিশের এসপি বাবুল আক্তার এবং তার নিহত স্ত্রী মাহমুদা মিতুকে ঘিরে। পুরনো একটা রাশিয়ান কৌতুক দিয়ে লেখাটা শুরু করা যেতে পারে। মেজর সাহেব সকালে ক্লাস নিতে এসে দেখলেন ক্লাসের এক কোণে সিগারেটের শেষ অংশ জ্বলছে। তিনি রেগে গেলেন। জানতে চাইলেন কে খেয়েছে সিগারেট? কার এতো বড় সাহস? ক্লাসে উপস্থিত সৈন্যরা কেউ কোনও কথা বললো না। পেছন থেকে এক সৈন্য মিনমিনে গলায় বললো- স্যার দাবিদার কেউ নাই। আপনি চাইলে শেষ সুখটানটা দিতে পারেন!
মেজর সাহেব আরও রেগে গেলেন। ক্লাস না নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাকে জানালেন। সন্ধ্যা নাগাদ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন জানালো ক্লাসের সব সৈন্যকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এর ভেতর এগারোজন স্বীকার করেছে তারা প্রত্যেকে ওই সিগারেটটা খেয়েছিল!!
এদেশে মাঝে মধ্যেই গণগ্রেফতারের ঘটনা ঘটে। এদের মধ্যে অনেকেই স্বীকারোক্তি দেয় যে তারা অপরাধ করেছিল! কিন্তু দেশের আম পাবলিক কেন যেন সেসব বিশ্বাস করে না, উল্টো তাদের জজ মিঞার কথা মনে পড়ে যায়। সে কারণে তাদের সন্দেহপ্রবণ মন আরও বেশি সন্দেহের দোলাচলে থাকে। সন্দেহ কিংবা প্রশ্নমালা এক সুতোয় গাঁথলে যা দাঁড়ায় তা এমন-
এক. পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার সাহসী ও চৌকস পুলিশ অফিসার ছিলেন। সুনীল গাঙ্গুলী লিখেছিলেন- ভালোবাসার পাশে একটা অসুখ শুয়ে থাকে। আর সুন্দরের ভেতর (বিপ্লবের বুকে যেমন প্রতি বিপ্লব) অজান্তেই নাকি বেড়ে উঠতে পারে অসুন্দরের কোনও বীজ! সন্দেহ বা প্রশ্ন হচ্ছে এই, সত্যি সত্যি কি বাবুল আক্তার ভাড়াটে খুনি দিয়ে তার প্রিয়তম স্ত্রীকে খুন করিয়েছিলেন? মিতু হত্যাকাণ্ডের পর কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছিল, একদা বাবুল আক্তার নাকি শিবিরের ক্যাডার ছিলেন! হায়! এই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতার কোনটা সত্য? কোন সত্য বিশ্বাস করে বেড়ে উঠবে বাবুল আক্তারের সন্তানেরা?
দুই. শেক্সপিয়র বলেছিলেন, খুন করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে কারও নামে বদনাম ছড়িয়ে দেওয়া! এরপর খুন হয়ে গেলে নাকি মানুষ মনে মনে ভাবে খুন করা ঠিকই তো আছে! পত্রিকার পাতায় কিংবা অনলাইন নিউজে অথবা টেলিভিশনের খবরে সেই বদনামও ছড়ানো হয়েছে! আগে ছড়ানো হয়েছিল বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা মিতু পরকীয়ার সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন! সে কারণে নাকি বাবুল আক্তার তাকে খুন করাতে পারেন!
চট্টগ্রামের দামপাড়ার এক ব্যবসায়ীর কথা বলা হয়েছিল, তার আসল পরিচয় কী? তিনি কি আসতেন বাবুল আক্তারের কাছে? কেন আসতেন? মিতুর সঙ্গে কি বাসাতেই পরিচয়? তার রাজনৈতিক পরিচয় কী? যদি বলা হয় চট্টগ্রামে বাবুল আক্তার যে বাসায় থাকতেন সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে, তাহলে? এটা কি বাবুল আক্তারের ভাড়া বাসা না কেনা? নাকি কোনও কাঁচ কোম্পানি তাকে এটা উপহার দিয়েছিল? হায়! জানি না, ঘটনা এমন কেন! চারিদিকে এতো সন্দেহ কেন?
তিন. হিটলার কিংবা স্ট্যালিনের শাসনামলে যখন তখন পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন যে কাউকে তুলে নিতে পারতো, বিনা বিচারে মেরে ফেলতে পারতো। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলে সরকার দিনের পর দিন কী কী আইনের কাজ করেছে? জঙ্গি কিংবা হরতাল কার্যক্রমে গ্রেফতার বরাবরই বিরোধী দলের ওপর দিয়ে যায় এমন একটা কথা প্রচলিত হয়ে গেছে! এটা নাকি যে কোনও সরকারের আমলে বিরোধী দলের নিয়তি। সেই বাস্তবতায় কি বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ? একজন চৌকস পুলিশ অফিসারকে যেভাবে বাসা থেকে তুলে নিয়ে রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল সেটা কতোখানি সম্মানের? স্বাভাবিক কেউ কি ঘটনাটা স্বাভাবিকভাবে নেবে? সেই জিজ্ঞাসাবাদের ফলাফল কী? বাবুল আক্তার কি কোনও না কোনওভাবে তার স্ত্রীকে খুন করিয়েছেন? কেন এবং কীভাবে? সোহাগী জাহান তনুর মতো এদেশের সব মানুষ সত্য ঘটনাটা জানতে চায়। হু কিল্‌ড তনু অ্যান্ড হু কিল্‌ড মিতু?
চার. ছোটকালে মিথ্যেবাদী রাখালের গল্প আমরা পড়েছি। বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে বলে চিৎকার দিয়ে লোকজন জড়ো করে রাখাল এক ধরনের তামাশা করতো, মজা দেখতো। কিন্তু সত্য সত্য যেদিন বাঘ এসেছিল সেদিন রাখালের ডাকে কেউ ছুটে আসেনি! পুলিশ জঙ্গি বা আসামি সন্দেহে অনেককে গ্রেফতার করে, পত্রপত্রিকা টেলিভিশনে সেসব বার বার প্রচারিত হয়। তারপরও মানুষের মনের সন্দেহ দূর হয় না। বাঘ এসে রাখালকে খেয়ে ফেলার মতো আসামিরা খুন করে যায় তাদের টার্গেটকে। পুলিশ জানিয়েছিল মিতু হত্যার সঙ্গে জড়িত কমবেশি সবাইকে তারা গ্রেফতার করতে পেরেছে। মিতু হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ওয়াসিম, নবী, রাশেদ শাহজাহান, মুছা ও তার ভাই সাকু, এহতেশামুল হক ভোলা এবং ভোলার সহযোগী মনিরকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছিল। ৫ জুলাই (২০১৬) ভোরে নবী ও রাশেদ, যারা সরাসরি মিতু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছিল, সেই দুইজন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে! পুলিশ কী কারণে এই দুইজনকে বন্দুকযুদ্ধের নামে মেরে ফেললো?
নবী ও রাশেদের স্বজনরা অভিযোগ করেছিলেন- নবী ও রাশেদ মিতু হত্যাকাণ্ডের পরপরই গ্রেফতার হয়। যদিও পুলিশ এটা পরে স্বীকার করে। কিন্তু বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাটা ঘটানো হলো কার স্বার্থে? নবী ও রাশেদ কি বাবুল আক্তারের সোর্স ছিলেন কখনও? বাবুল আক্তারের সঙ্গে কি তাদের কোনও চুক্তি বা লেনদেন হয়েছিল? দেশবাসী যেন কোনওদিন জানতে না পারে সে কারণে কি নবী ও রাশেদকে পৃথিবীছাড়া করা হলো?
পাঁচ. একাধিক পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হোতা মুছা। এমন খবরও বেরিয়েছে যে মুছাকে মিতু হত্যাকাণ্ডের পর পরই গ্রেফতার করা হয়েছে। সে এখন কোথায়? তার সঙ্গেও কি বাবুল আক্তারের কোনও চুক্তি বা লেনদেন হয়েছিল? তার সঙ্গেও কি পুলিশ বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটাবে? সরকার কি কোনও কারণে তথ্য গোপন করতে চাইছে? নাকি বাবুল আক্তারকে সেভ রাখাই সরকারের আসল সিদ্ধান্ত?
ছয়. বাবুল আক্তার কি পুলিশের চাকরিতে আছেন? যদি তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করতেই চান তাহলে পুলিশ সেটা গ্রহণ করছে না কেন? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। বাবুল আক্তার তার শ্বশুরের বাড়িতেই থাকছেন। তিনি কি সেখানেই থাকবেন নাকি দেশের বাইরে চলে যাবেন? সরকার কি তাকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেবে? বাবুল আক্তারের নীরব থাকা, তাকে নিয়ে সরকারের নীরবতা বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই কি উসকে দেবে না?
সাত. মিতু হত্যাকাণ্ডের পর সরকার যা করেছে, তা ছিল চোখে পড়ার মতো। মানুষ ভেবে নিয়েছিল বাবুল আক্তার সৎ(?) এবং চৌকস(!) বিধায় পুলিশ তার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। মাহমুদা মিতু হত্যার পর বাবুল আক্তারের কান্না এবং তার বেদনাহত মুখভঙ্গি বহু মানুষের চোখের জলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেউ কি তখন কল্পনা করতে পেরেছিল যে বাবুল আক্তার নিজেই এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারেন? জঙ্গিরা বাবুল আক্তারের ওপর প্রতিশোধ নিতে (বাবুল আক্তার কি নিজেই এই তথ্য ছড়িয়েছিলেন?) মিতুকে খুন করতে পারে এই ধারণার বশবর্তী হয়ে সরকার সারাদেশে ক্রাশ প্রোগ্রাম নেয় এবং হাজারও লোককে গ্রেফতার করা হয়। এদের ভেতরে নাকি জঙ্গিরাও ছিল। কয়েক জনকে ক্রসফায়ারেও নেওয়া হয়। তারপর খুনের সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা কয়েকটি পত্রিকা ও অনলাইনে ছাপা হলে মানুষ আসলে কোনটা বিশ্বাস করবে সেটা নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। নাকি সরকার এই দ্বান্দ্বিক অবস্থা জিইয়ে রেখেই তার অন্য কোনও উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়?
খুব সাধারণভাবে যে প্রশ্ন মানুষের মনে জেগেছে সেটা হচ্ছে এই- বাবুল আক্তারের জন্য আইন কি আলাদা? যদি আলাদা আইন না হয়, তাহলে মাহমুদা মিতু হত্যাকাণ্ডে বাবুল আক্তার জড়িত কিনা সেটা পুলিশকেই বলতে হবে। জড়িত থাকলে খুনের অভিযোগে বাবুল আক্তারকে বিচারের মুখোমুখি করাতে হবে, সেক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করার অধিকার হারাবেন বাবুল আক্তার। পরকীয়ার ঘটনার জের ধরে যদি এতো কিছু ঘটে তাহলে বাবুল আক্তারের শ্বশুরেরও অনেক কিছু জানা থাকার কথা। আশা করি তিনি তার মেয়ে হত্যার বিচার চাইবেন!!

আর যদি বাবুল আক্তার জড়িত না থাকেন তাহলে সম্মানের সঙ্গে তাকে পুলিশের চাকরিটা ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়াটা খুবই জরুরি!
বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখাটা লিখতে গিয়ে জেসিকার কথা মনে পড়ছিল। সংসারের স্বচ্ছলতার জন্য ভারতীয় এই মেয়েটা মদের বারে কাজ করতো। একদিন মদের বার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এক ধনী লোকের পুত্র এসে মদ চেয়েছিল। জেসিকা বলেছিল বার বন্ধ হয়ে গেছে। ধনীপুত্র গুলি করে মেরে ফেলেছিল তাকে। জেসিকার পরিবার বিচার পায়নি। ধনীপুত্র খালাস পেয়ে গিয়েছিল। দুঃখ করে তখন অনেকেই বলেছিলেন, নো বডি কিল্‌ড জেসিকা!
পরে অবশ্য নতুন করে বিচার শুরু হয় আর ধনীপুত্র পায় যাবজ্জীবন শাস্তি। জানি না আমাদেরকেও বলতে হবে কিনা- নোবডি কিল্‌ড তনু। নোবডি কিল্‌ড মিতু!!

লেখক: রম্যলেখক

আরও খবর: ‘আমার লগ ছাড়ি দেও, আমি আল্লাহর নামে আছি’

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ