X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

হে নিখোঁজ তরুণ তোমরা ফিরে এসো!

চিররঞ্জন সরকার
২২ জুলাই ২০১৬, ১২:৪৭আপডেট : ২২ জুলাই ২০১৬, ১২:৫২

চিররঞ্জন সরকার আগে শিশু, বৃদ্ধ কিংবা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিরা অনেক সময় হারিয়ে যেত বা নিখোঁজ হতো। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে, মাইকিং করে, আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশী সবাই মিলে খুঁজে সেই হারানো ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হতো । নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে পেয়ে পাড়াসুদ্ধ মানুষের সে কী আনন্দ! পুরো এলাকায় তখন আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। মানুষটি হিরো বনে যেত। শুধু শিশু, বৃদ্ধ কিংবা প্রতিবন্ধিই নয়, অনেক সময় অভিভাবকদের শাসনের কারণে অভিমানী কিশোররাও বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যেত। তখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বের হতো: যেখানেই থাক, বাবা তুমি শিগগির ফিরে এসো। তোমাকে না দেখে অনাহারে থাকতে থাকতে তোমার মা আজ শয্যাশায়ী! এভাবে কত আবেগ-অনুভূতি ভরা সেই সব ‘ফিরে এসো’র বিজ্ঞাপন আমাদের অনেককেই বাষ্পরুদ্ধ করত।
তবে যুগে যুগে অনেকেই গৃহত্যাগ করেছে। মুনীঋষিরা তো ঘর-ছেড়ে বনে গিয়ে তপস্যা করেই সিদ্ধি লাভ করেছেন। গৌতম বুদ্ধও একদিন ঘর ছেড়ে ছিলেন। এক সময় বিপ্লবীরা দলে দলে ঘর-পালিয়েছে। নকশাল জমানায় তো তরুণ-যুবরা দলে দলে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যেত।
কালের বিবর্তন ঘটলেও ঘর ছাড়ার বা নিখোঁজ হওয়ার প্রবণতা কিন্তু এখনও খুব একটা কমেনি। এই যন্ত্রপ্রযুক্তির যুগে বৃদ্ধরা আগের মতো ‘হারায়’ না বটে। তবে নারী-শিশুরা এখনও হারিয়ে যায়, মানে পাচার হয়। ইদানীং নকশাল আমলের মতো তরুণ-যুবরা আবারও নিখোঁজ হতে শুরু করেছে। তারা হামেশাই ঘর ছাড়ছে। দাগা কিংবা ছ্যাঁকা খেয়ে, অথবা বাবা-মার সঙ্গে ঝগড়া-অভিমান করে নয়, তারা ঘর ছাড়ছে ‘জিহাদ’ করার মানসে। আগের তরুণরা আড্ডা মারতো, এখনকার এই ‘নিখোঁজ’ তরুণরা মানুষ মারে!

এই নিখোঁজ তরুণরা যে ‘নিখোঁজ’ সেটা আমরা কেউ খুব-একটা জানতাম না। সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর আমরা জানলাম, যে আমাদের ভবিষ্যৎ ‘নায়কেরা’ অনেকেই বাড়ি থেকে লাপাত্তা হয়ে ‘জঙ্গি নায়ক’ হয়েছে! গুলশানে যারা হামলা চালিয়েছিল তাদের অনেকেই বেশ কিছুদিন ধরে নিখোঁজ ছিল। আইএস তাদের সাইটে হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করার পর পরিবার তাদের অবস্থানের কথা জানতে পারে।

ওদিকে ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের আধা কিলোমিটারের মধ্যে বোমা হামলায় দুই পুলিশ সদস্যসহ চারজন নিহত এবং কমপক্ষে ১২ জন আহত হন। শোলাকিয়া ঈদ জামাতে হামলাকারী নিহত ব্যক্তির নাম আবির আহমেদ। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) শিক্ষার্থী আবির রহমান গত আট মাস ধরে নিখোঁজ ছিল।

সারাদেশে এমন অন্তত কয়েক শ তরুণ নিখোঁজ রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি র‌্যাব ২৬২ জন নিখোঁজের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সেই তালিকায় ডাক্তার, প্রকৌশলী ও পাইলটের পরিচয় পাওয়া গেছে। এছাড়াও ওই তালিকায় রয়েছে, গানের শিল্পী, পোশাক শ্রমিক, রাজমিস্ত্রী ও মাদরাসা শিক্ষার্থীসহ অন্তত ৯টি পেশার মানুষ। এসব নিখোঁজের ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। অনেক অভিভাবক মান-সম্মান ও হয়রানির ভয়ে নিখোঁজ সন্তানের কথা প্রকাশ করছেন না। এই নিখোঁজ তরুণদের অধিকাংশই জঙ্গি মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে উঠছে। তারা মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্ট জঙ্গি সংগঠন আইএসের সমর্থক বনে যাচ্ছে। আইএস শুধু একটি সংগঠনই নয়, একটা ভাবাদর্শও বটে। এর কোনও ভৌগোলিক সীমারেখা নেই এবং যার আকর্ষণ সারা পৃথিবীর মুসলমান তরুণদের মধ্যে ক্রমশ বাড়ছে। মোহের বশে তরুণরা ‘চললাম’ বলেই চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে? ইউরোপ-আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। ইহুদী-নাসারা, বিধর্মী ‘কাফের’দের কোতল করে ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করতে। তাদের বোঝানো হচ্ছে যে, ধর্মই আসল, ধর্মই সব। ধর্মের জন্য সবার আগে দরকার ধর্মরাষ্ট্র। আর এ জন্য দরকার জিহাদ। তাদের আরও বোঝানো হচ্ছে যে, ধর্মের জন্য এই ‘যুদ্ধ’, এ যুদ্ধে বাঁচলে ‘গাজি’, আর মরলে ‘শহীদ’। যত বেশি ‘বিধর্মী-কাফের’ হত্যা করা যাবে, তত নেকি বা পুণ্য। এ ‘যুদ্ধে’ মারা পড়লে থাকছে শহীদ হওয়ার মওকা। আর পরকালে হুর-পরীসহ নিশ্চিত জান্নাত। তাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে লোভনীয় সব অফার। কত স্বপ্ন, কত কী! এসব ধর্মীয় বোল-চাল দিয়ে তাদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে। তাদের বোঝানো হচ্ছে, ধর্মের জন্য তোমরা মানুষকে মেরে-কেটে কুমড়োর মতো ফালা ফালা করো। এগুলো দেখে ‘কাফেররা ভয় পাবে। বিধর্মীরা ‘সিদা’ হয়ে যাবে। আর ধর্মহীনরা ‘করণীয়’ সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করবে।

টিভি-মোবাইল-ইন্টারনেট নির্ভর এ যুগের তরুণরা যন্ত্রের মতই মগজহীন। ওদের যা শেখানো হচ্ছে, তাই শিখছে। কোনও প্রশ্ন নেই, চ্যালেঞ্জ নেই, আনুগত্য আর বিশ্বাস আছে শুধু। ওরা একবারও ভাবেনা, যা চাচ্ছে, যেভাবে চাচ্ছে, তা কখনও এভাবে মিলবে কি-না!

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একটি পুরনো কৌতুক। এক তরুণের মাথা ফেটেছে। সে ডাক্তারের কাছে গেছে চিকিৎসার জন্য। ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগাতে ডাক্তার জানতে চায়, মাথা কীভাবে ফাটলো? তরুণের উত্তর- সেন্ডেল দিয়ে ইট ভাঙার চেষ্টা করছিলাম। ভাইয়া বলল, ওরে ওভাবে হবে না। মাথাটা একটু ব্যবহার কর।

তারপর মাথা দিয়ে ইটটা ভাঙার চেষ্টা করলাম। আর তাই এই দশা!

আমাদের তরুণরা যাদের কথায় নাচছে, তাদের কথায় আদৌ নাচা উচিত কি-না তা একবারের জন্যও তলিয়ে দেখছে না। তারা ধর্মযুদ্ধের নামে যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করছে, সেটা এক ভয়াবহ সিদ্ধান্ত। ওরা ভালো-মন্দ ন্যায়-অন্যায় না বুঝে ‘জিহাদের’ নামে সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে। ওরা জানে না, এতে শুধু হিংসাই বাড়াতে পারে, আর বাড়াতে পারে স্বদেশ আর স্বজাতির দুর্গতি। ওরা পারে অসহায়কে নির্মমভাবে মারতে, করুণ ভাবে মরতে, অনাথ হতে, পঙ্গু হতে, মা-বাবা-দেশ সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে রিফিউজি হতে, পুরো পরিবারকে দুঃখের সাগরে ভাসাতে, ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে।

হে নিখোঁজ তরুণ, হে যুব, একবার ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখ, নিরীহ মানুষ মেরে কী লাভ? গুলশানে, হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় এতগুলো নিরীহ মানুষকে মেরে কী হলো বল তো ধর্মযুদ্ধের? ধর্ম কি তাতে লাভবান হলো? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে বাঙালিরা আছে, তারা কি এই ঘটনার পর শান্তি-স্বস্তি-মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকতে পারবে? তাহলে কেন এই পৈশাচিকতা?

এভাবে খুচিয়ে খুচিয়ে জাপান, ইতালি, ভারত আর স্বদেশের ২০টি তাজা প্রাণকে বধ করে তোমরা কী পেলে? পৈশাচিকতার সর্বোচ্চ স্তরে উত্তরণ? আলবৎ! বড়দের ক্ষমতার খেলায় তোমরা কী নির্বোধের মতই না প্রাণ নিলে এবং দিলে! এর পর তো লজ্জা থাকে না, বেদনা থাকে না, আবেগের একটা দানাও আর পড়ে থাকে না। সবচেয়ে কোমল, সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মিঠে এমন কিছুকে দুমড়ে-মুচড়ে দলা পাকিয়ে মাড়িয়ে যেতে পারলে বাকি হৃৎপিণ্ডে এমন আর কিছুই থাকে না যা দিয়ে তৈরি করা যায় পিছুটান, যা দিয়ে তৈরি করা যায় মন, যা দিয়ে তৈরি করা যায় মানবিকতা। তোমাদের আমরা কী বলবো? তোমরা কোন সে সমাজের জন্য বলি হচ্ছ?

ওই যে আবির, যে শোলাকিয়ায় হামলা চালাতে গিয়ে নিহত হয়েছে, তার জানাজায় একটি কাকপক্ষীও অংশ নেয়নি। এই কি মানবজন্ম? তাই আবারও বলি, বাবারা, সোনারা, তোমরা পিশাচদের সঙ্গ ত্যাগ করে মানবতায় ফিরে এসো। ঘরে ফিরে এসো। এসে দেখো, এখানে জীবন কত সুন্দর। মা-বাবার স্নেহ, ভাইবোনের আদর, আত্মীয়দের মমতা, বন্ধুদের ভালোবাসায় মেশানো যে জীবন-এর চেয়ে বড় কিছু কি কোথাও আছে?

দেখো, তোমাদের মা সারাজীবন ফুঁপিয়ে কেঁদে মরে। সারাক্ষণ কাকুতি-মিনতি করে বাবুটা, একটি বার ফিরে আয় না, সারাদিন খেলতে দেব বাবা। টিভি দেখবি? তাই দেব মানিক আমার। এক বার মা’র কথা শোন। কম্পিউটার গেম খেললেও কিছুটি বলব না। এক বার ফিরে আয়। দুধ না খেলেও বকব না, পড়াশোনা না করলেও বকব না। বোনের সঙ্গে ঝগড়া করলেও বকব না। কেবল মা’র কাছে আয়। আমি আমার মধ্যে লুকিয়ে রেখে দেব সোনা তোকে!

ফিরে এসো সোনা, বাবা-মার মুখের দিকে চেয়ে। তোমরা না ফিরলে বাবা-মা যে মা সারা জীবন বালিশের নিচে তোমার নীল শার্টটা নিয়ে শোবে প্রতিটা রাত। ওটাকে জড়িয়ে ধরে এপাশ-ওপাশ করবে, কিন্তু ঘুমুতে পারবে না। অ্যালবামে তোমার ছবির দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যাবে, তাকে কি স্বস্তি দেবে না? জিহাদের জন্য আত্মদান কি তোমাদের মা-বাবার সারাজীবনের চোখের জলের চেয়ে বড় হতে পারে?

তোমাদের তেজ, শক্তিকে কেন অপাত্রে দান করছ? এ যুগে কি খুন করে বা খুন হয়ে ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়?  একবারও কি তোমরা ভেবে দেখেছ, আইএস কারা সৃষ্টি করেছে? কারা তাদের অস্ত্র-অর্থ দিচ্ছে? এগুলো হচ্ছে ধনী দেশগুলোর হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার এক মোক্ষম হাতিয়ার । তাদের দেখানো পথে তোমাদের চলতে হবে কেন? ইসলামতো শান্তির ধর্ম; তাহলে তোমরা কেন অশান্তির পথ বেছে নেবে? তাই বলছি, ওরে অবুঝ সোনারা, তোমরা ফিরে এসো। যেও না ওই স্বার্থান্ধদের দলে। ওরা তোমাদের ভুলভাল বুঝিয়ে জাহান্নামের টিকেট ধরিয়ে দিচ্ছে, ‘আশরাফুল মাখলুকাত’হয়ে তোমরা কেন জাহান্নামের টিকেটটা অগ্রিম বুকিং দেবে? হে আমার প্রাণপ্রিয় সন্তানেরা, তোমরা ফিরে এসো ঘরে, দেশে, আমাদের সবার হৃদয়ে। আমরা যে ব্যাকুল হয়ে বসে আছি তোমাদেরই প্রতীক্ষায়!

লেখক: কলামিস্ট

আরও খবর: জেএমবির একটি বড় অংশ আইএসের নামে হামলা করছে বাংলাদেশে

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ