X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

যা বলতে চাই

সালেক উদ্দিন
২৪ জুলাই ২০১৬, ১৫:২৭আপডেট : ২৪ জুলাই ২০১৬, ১৬:৩১

সালেক উদ্দিন গুলশান-শোলাকিয়া হত্যাকাণ্ড দুটি এখন বাড়িতে-অফিসে-ঘাটে-মাঠে-বাজারে আড্ডায় রাজনীতির একমাত্র আলোচ্য বিষয়। আর সেটা হওয়ারই কথা। কেননা গুলশানে আচমকা এমন একটা ঘটনা ঘটলো, যা এদেশের মানুষ আগে কখনও দেখেনি। আমাদের পুলিশ বাহিনীরও যা মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে জুলাইয়ের ১ তারিখে জন্ম নিল গুলশান ট্র্যাজেডি উপাখ্যান। আর সেই ট্র্যাজেডির ঘা শুকানোর আগেই ঈদের দিনে ঘটলো শোলাকিয়ার ঘটনা।
এসব কারা করছে, এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ বলছেন আইএস-এর কথা। কেউ কেউ এদেশে আইএস-এর অস্তিত্বই স্বীকার করছেন না। বলছেন এসব দেশীয় জঙ্গিদের কাজ। কেউ ধারণা করছেন দেশীয় জঙ্গিরা আইএস-এর মদদে এই হামলা চালিয়েছে। আবার আইএস সম্পর্কেও আমরা বিভিন্ন জনের বিভিন্ন কথা শুনছি।
সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত সাংবাদিক হারুন উর রশিদের লেখা  ‘আইএস নিয়ে উল্টো খবর’ শিরোনামের কলামে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ‘আইএস-এর নেপথ্যে কারা’ সংক্রান্ত কিছু সংবাদ তুলে ধরা হয়েছে। এতে ব্রিটেনের লেবার পার্টির সদস্য বব ক্যাম্পবল অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ আইএসকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড বলেছেন, ইরাকযুদ্ধের পর দেশটির সেনাবাহিনী থেকে বাথ পার্টির সমর্থকদের সরিয়ে দেওয়ার মার্কিন পরিকল্পনাই আইএস-এর উত্থান ঘটিয়েছে। কানাডিয়ান গ্লোবাল রিসার্চ বলেছে, আইএস মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থারই সৃষ্টি আর সহযোগিতা করছে ইসরায়েলের মোসাদ। সিরিয়া বিদ্রোহে আইএস পশ্চিমা সামরিক জোটের সৈনিক হিসেবে কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো-ইসরায়েল তাদের প্রছন্নভাবে সমর্থন জুগিয়েছে।
ইরাকে বেসামরিক নাগরিকদের আইএস হত্যাকাণ্ডকে ব্যবহার করা হয়েছে মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের প্রেক্ষাপট তৈরিতে। ২০১৪ সালে ইউকিলিকস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির যে নথি ফাঁস করে তাতে দেখা যায়, তা আইএস-এর খলিফা আবু বকর বাগদাদি যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থারই তৈরি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক প্রতিবেদনে বলেছে আইএসকে যে ২০টি দেশ সামরিক রসদ সরবরাহ করে তার মধ্যে তুরস্ক ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রই প্রধান।
সাংবাদিক হারুন তার লেখায় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কিছু সংবাদ তুলে ধরেছেন। তিনি বিশ্লেষণ না করলেও বিশ্বাস না হলে ওই সব সাইটে ঢুকে পাঠকদের তা পরখ করে নেওয়ার কথা বলেছেন। তার এই কথায় কয়েকটি ওয়েব সাইটে গিয়ে আমিও এর সঠিকতা যাচাই করে যা পেলাম, তার শুধু সারাংশটুকু ওপরে উল্লেখ করলাম। এর বিশ্লেষণ আমিও করলাম না। কারণ তথ্যগুলোর কোনটা যে সত্য আর কোনটা যে সত্যের অপলাপ, তা আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ধরার কথা নয়। ধরছেও না।
গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর সভা সমাবেশ সংবাদ সন্মেলনে মন্ত্রী মহোদয়রা  যা বলছেন, তা নিয়ে আমার ক্ষুদ্র মনে যে প্রশ্নগুলো এসেছে, এই লেখা আপাতত সেটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।
রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত জননিরাপত্তা ও  আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মতবিনিময় সভায় মন্ত্রী মহোদয়রা যা বললেন তার মর্মার্থ হলো, গুলশান হামলার আগে এ বিষয়ে সব ধরনের গোয়েন্দা তথ্য সরকারের কাছে ছিল। এর পেছনে  কারা মদদ দিয়েছে তাও সরকারের জানা আছে। তাই ঘটনার তিন মিনিটের মাথায় পুলিশ সদস্য এসআই ফারুক সেখানে যান। তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর কমিশনার জানতে পেরে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থলে যেতে বলেন।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে গুলশান হামলার আগে সে বিষয়ে সব ধরনের গোয়েন্দা তথ্য যদি সরকারের কাছে থেকেই থাকে, তবে সরকার মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্যে সেখানে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল? সেই নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে কিভাবে ৫/৬ জন অস্ত্রধারী যুবক গুলশানের রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে এমন হত্যাযজ্ঞ চালালো?
মত বিনিময় সভায় মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের কাছে সব তথ্য আছে,  কারা মানুষ হত্যা করার মতো ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে জড়িত। তাদের ব্যাপারে সব জানি আমরা। আমরা কঠোর হতে চাই না, শান্তিপ্রিয় মানুষ শান্তি চাই। তাই আপনারা যারা পথভ্রষ্ট হয়েছেন তারা পথে ফিরে আসুন’।
মন্ত্রী মহোদয়ের ‘আপনারা যারা পথভ্রষ্ট হয়েছেন তারা পথে ফিরে আসুন’ আহ্বানটি ভালো লেগেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ হত্যার মতো ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে কারা জড়িত তা যদি তিনি জেনে থাকেন তবে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাচ্ছেন না কেন? এদেশের মানুষ সেই ঘৃণ্য অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চায়।
‘আমরা কঠোর হতে চাই না, শান্তিপ্রিয় মানুষ শান্তি চাই’—দেশের এমন দুর্দিনে মন্ত্রী মহোদয়ের এমন মহানুভবতা এদেশের মানুষ কামনা করে না।
‘একসময় মাদ্রাসার ছাত্রদের জঙ্গিরা টার্গেট করে তাদের অপকর্মে লিপ্ত করতো। ফলে আমরা সেখানে ব্যাপকভাবে নজরদারি করি এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা যেন ভুল পথে পা না বাড়ায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে আমরা সক্ষম হয়েছি। এখন মাদ্রাসা থেকে সরে গিয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে তাদের জীবনকে বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এখন আমরা এখানে অনেক বেশি সচেতন হয়েছি’।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একথার পরিপ্রেক্ষিতে যে কথা বলা প্রয়োজন তা হলো, মাদ্রাসার ছাত্রদের জঙ্গিরা টার্গেট করতে পেরেছিল কেন? কারণ মাদ্রাসার ছাত্ররা এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়ে এই ভেবে যে দেশে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তাদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুযোগ নেই, জজ ব্যারিস্টার হওয়ার সুযোগ নেই’ অফিস আদালতে চাকরি করার সুযোগ নেই। মাদ্রাসা থেকে পাস করার পর তাদের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি মসজিদের খতিব হওয়া, না হয় মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়া আর তা না হতে পারলে গ্রামেগঞ্জে ওয়াজ মাহফিলে বক্তৃতা দিয়ে মিলাদ পড়িয়ে জীবিকা ধারণ করা। ফলে হতাশাগ্রস্ত এই ছাত্রদের ধর্মান্ধতার জাল ফেলে শিকার করা জটিল কোনও বিষয় নয়। অথচ যারা ধর্মের আলোকে আলোকিত হচ্ছিল তাদের বিপথগামী করা সবচেয়ে কঠিন কাজ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের বৈষম্যের কারণে এটা আর কঠিন থাকেনি।
শিক্ষাক্ষেত্রের এই বৈষম্য দূর করা অতি প্রয়োজন। প্রয়োজন মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন। প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন মেডিকেল মাদ্রাসা, ইঞ্জিনিয়ারিং মাদ্রাস, ক্যাডেট মাদ্রাসা, আইন মাদ্রাসা ইত্যাদি। বর্তমানে মাদ্রাসায় আরবি ও উর্দু ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক রয়েছে। বাংলা ইংরেজির অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। মাদ্রাসায় আরবির পাশাপাশি বাংলা ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। দেশপ্রেম জাগ্রত করার প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ থাকতে হবে।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নিশ্চয়ই বিষয়টি ভেবে দেখছেন। কারণ বর্তমানে আমাদের দেশের মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম নয়। দেশের ভবিষ্যৎ তাদের ভবিষ্যতের ওপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল।
সবশেষে যে কথা বলতে চাই তা হলো, দেশকে জঙ্গির হাত থেকে, অরাজকতার হাত থেকে রক্ষার জন্যে এখন ইংরেজি মাধ্যম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ওপর যে নজরদারি করা হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরে যে জঙ্গি বিরোধী কমিটি গঠন করা হচ্ছে, জঙ্গি সংগঠন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে পুরস্কার ঘোষণা করা হচ্ছে, নিখোঁজদের খোঁজ করা হচ্ছে, জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে সেসব সরকারি উদ্যোগের জন্যে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে একই সঙ্গে একথাটিও বলতে চাই এর কোনওটিই স্থায়ী সমাধান নয়, ঘায়ের ওপর মলম লাগিয়ে আপাতত ঘা শুকাবার প্রয়াস মাত্র। মলমে বাইরের ঘা শুকায় ঠিকই কিন্তু নির্মূল হয় না বরং একসময় তা ক্যানসার রূপে বের হয়ে আসে।
দেশে বিরাজমান বর্তমান ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য এখন প্রয়োজন অরাজকতা সৃষ্টির নেপথ্যে কারা—এর প্রকৃত সত্য খুঁজে বের করা। বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমে ও গবেষণায় আইএস-এর স্রষ্টা পৃষ্ঠপোষক ও অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে যে সব দেশের  নাম এসেছে তাদের সম্পর্কে সতর্ক ও কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করা এবং জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সত্যিকারের জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। সত্যিকারের জাতীয় ঐক্যের কথা বলছি একারণেই যে, সরকারি দল ও জোটের মানুষদের নিয়ে যে ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে সেটা জাতীয় ঐক্য নয়। এ ব্যাপারে আমরা এমন ঐক্য চাই যা হবে সরকারি বিরোধী নিরপেক্ষ সকলের সমন্বয়ে সত্যিকারের জাতীয় ঐক্য যার লক্ষ হবে এক ও অভিন্ন। এই ঐক্যের জন্য প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকেই। জাতির ক্রান্তিকালে এমন ঐক্যের বড় বেশি প্রয়োজন।   

লেখক: কথাসাহিত্যিক

আরও খবর: যে কারণে গুলশান-বনানী থেকে রাজনৈতিক কার্যালয় সরানোর পক্ষে আ. লীগ, বিপক্ষে বিএনপি-জাপা

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ