X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

আস্থার সংকট, কারণ নির্ণয় ও জঙ্গি নিয়ন্ত্রণ

গোলাম মোর্তোজা
৩০ জুলাই ২০১৬, ১৩:৩১আপডেট : ৩০ জুলাই ২০১৬, ১৪:২৭

গোলাম মোর্তোজা জঙ্গি বিষয়ে গত ছয় সাত বছরে আমরা কিছু কথা শুনেছি।
ক. জঙ্গিদের আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার ক্ষমতা নেই। ব্যবস্থা নিয়ে তাদের দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে।
খ. আইএস, আল কায়েদার সমন্বয়কারীসহ জঙ্গিদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ. দেশে আইএস বা আল কায়েদা নেই।
মোটামুটিভাবে এই কথাগুলো বলেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এভাবেই চলছিল। এর মধ্যে ঘটে গেল গুলশান ট্র্যাজেডি। তারপর কল্যাণপুর অভিযান। নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে জঙ্গিবাদ। ইতিহাস নয়, সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে কিছু কথা।
১. সেই সমস্যাটি সমাধান করা সহজ হয়, যে সমস্যাটি পরিষ্কারভাবে জানা থাকে। বিএনপি-জামায়াতের সময়ের পরে আবার জঙ্গিবাদের উত্থান হলো কেন? নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়াতে দুর্বলতা ছিল। জঙ্গি বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে দুর্বলতা দৃশ্যমান ছিল। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যেমন থাকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমও তেমনই হয়। জঙ্গিবাদের সাম্প্রতিক উত্থানের এই দৃশ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এককভাবে দায়ী করার কোনও সুযোগ নেই। মূল দায় নিতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে।
২. জঙ্গিবাদ শুধু আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা নয়। সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় রাজনৈতিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রেক্ষিতে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে, সরকার এসব কথা শুধু মুখে বলেছে। বাস্তবে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার জন্যে রাজনীতি করেনি। ফলে বিভিন্ন নীতি-আদর্শের জঙ্গিরা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। যেমন- হেফাজতের সঙ্গে জামায়াতের নীতিগত বিরোধ আছে। জামায়াত-হেফাজত উভয়েই বিরোধ দূরে সরিয়ে রেখেছে, ভেতরে ভেতরে কাছাকাছি অবস্থান করার নীতি মেনে চলছে।

জামায়াতের অর্থ এক্ষেত্রে একটা ভূমিকা রাখছে। সরকার জামায়াতের বিরুদ্ধে কঠোর, হেফাজতের প্রতি নমনীয়। জামায়াত তার কাজ হেফাজতের মাধ্যমে করার কৌশল চালিয়ে গেছে। নীতিগত তীব্র বিরোধ থাকলেও, কৌশলে তাবলিগ জামায়াতের ভেতরেও ঢুকে গেছে জামায়াত। যেহেতু জামায়াত এখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে না, তাবলিগের সঙ্গে মিশে কাজ করছে। তাবলিগ জামায়াত একটি নির্বিরোধী ধর্মীয় সংগঠন। তাবলিগ জামায়াত কারোরই সন্দেহের মধ্যে নেই। এই সুযোগটি নিয়েছে জামায়াত। আরও অনেক ছোট ছোট ধর্মীয় দল, দৃশ্যমানভাবে যাদের সঙ্গে জামায়াতের বিরোধ আছে, অর্থ সহায়তা দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছে তাদের। ফলে জামায়াত কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে না পারলেও, নানা কৌশলে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।

৩. যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর সময়ে তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মরিয়াটিকে জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার করে জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ড বা শাস্তি দেওয়া হলে, শিবিরের মিলিট্যান্ট অংশকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। এ কারণে আমেরিকা যাতে সরকারকে চাপ দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার থেকে বিরত রাখে। উইকিলিকসের মাধ্যমে এই তথ্য ফাঁস হয়েছিল। শিবিরের সেই মিলিট্যান্ট অংশও নানা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে মিশে গিয়ে থাকতে পারে। বর্তমান জঙ্গিদের অর্থ-অস্ত্র-ট্রেনিংয়ে তাদের ভূমিকা থাকতে পারে।

আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তো নয়ই, গোয়েন্দা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এসবের পরিষ্কার কোনও তথ্য আছে বলে মনে হয় না। মূলত তথ্যের দুর্বলতার কারণেই বর্তমান সময়ে জঙ্গিবাদ ভয়ঙ্করভাবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে।

৪. হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা দৃশ্যমান হয়েছে। রাজনীতিতে জঙ্গি বিষয়ক কথা বেড়েছে, দৃশ্যমান কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। জঙ্গিবাদ বিষয়ে গবেষণাহীন প্রচলিত ধারণার ভিত্তি করে কথা চলছে।

বিশেষজ্ঞ নাম নিয়ে যারা কথা বলছেন, তাদের কাছেও কোনও গবেষণা নেই। সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেওয়া যে কাউকেই আমরা বলছি ‘নিরাপত্তা বিশ্লেষক’। সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা হয়ে যাচ্ছি ‘সমাজবিজ্ঞানী’ বা বিশ্লেষক। সত্যিকারের সমাজবিজ্ঞানীরাও কথা বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতোই। এত বছরে তারা নিজেরাও গবেষণা করে দেখেননি, কেন জঙ্গিবাদের ভয়ঙ্কর পথে ধাবিত হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। গবেষণা করে কারণ নির্ণয়ের কথা আমরা বহুবার বলেছি। কেউই সে পথে হাঁটেননি।

সম্প্রতি মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ডা. মেঘলা সরকার বলেছেন, ‘জঙ্গিবাদের কারণ নির্ণয়ের জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি গবেষণা সেল গঠন করা দরকার।’

আমরা মনে করি, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দারিদ্রের কারণে মাদ্রাসা শিক্ষার ছেলেরা জঙ্গি হয়েছে, হুর-পরির জন্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চবিত্তের সন্তানরা জঙ্গি হচ্ছে- এই দুটোই খুব স্থূল আলোচনা। বাস্তবতা বিবর্জিত, সমাজ-ক্ষতিকর আলোচনা। জঙ্গিবাদ কোনও সরল অঙ্ক নয়। এত সবলিকরণ করে কারণ জানা যাবে না। গবেষণা করে কারণ নির্ণয় করতে হবে, যদি আমরা সত্যি সত্যি জঙ্গিবাদের অভিশাপমুক্ত হতে চাই।

৫. জঙ্গিবাদের ভয়ে আতঙ্কিত জনপদ। জঙ্গি ভয় থেকে মুক্ত আমাদের হতেই হবে। সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করবে, কাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হলে, কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। প্রশ্ন করা কোনও অপরাধ নয়।

প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, ক্ষিপ্ততা দেখানো কোনও সমাধান নয়। মানুষের ভয় তখনই দূর হবে, যখন জনমানুষের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আস্থা বাড়বে। আস্থা নেই সেটা বলব না, আস্থা যে অনেক কম- তা স্বীকার করতেই হবে।

অভিযান অপরিহার্য। মেস বা বাড়ি তল্লাসীতে আপত্তি করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে, নাগরিকরা যেন নাজেহাল বা হয়রানির শিকার না হন। কোনও কোনও মেস বাড়িতে তল্লাসীর সময় ভয় দেখিয়ে মালিকদের কাছে অর্থ দাবি করা হচ্ছে, এই অভিযোগ যেন সত্যি হওয়ার সুযোগ না পেয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান প্রফেশনালি চললে, জনগণের ভয় কমে আসবে। একদিকে অভিযান আরেক দিকে রাজউক কর্তৃক গুলশান-বনানী-বারিধারা অঞ্চলের দোকান-রেস্টুরেন্ট হোটেল উচ্ছেদ, জনমনে ভয় আতঙ্ক দুটোই বৃদ্ধি করছে।

সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত দরকার, তাৎক্ষণিক বিশৃঙ্খলা সিদ্ধান্ত, আরও ক্ষতিকর হবে। বহু মানুষের চাকরি-কর্মসংস্থান হুট করে বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। কয়েক লাখ ব্যাচেলার শিক্ষার্থী মেস করে থাকে এই নগরে। পুলিশি অভিযান চলছে, বাড়িওয়ালারা তাদের মেস ছাড়ার নোটিশ দিচ্ছেন, নতুন করে কেউ বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন না তাদের। তারা এখন কী করবে? প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব অবশ্যই সরকারের কাছে থাকতে হবে।

৬. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। তাদের মধ্যে জঙ্গি অল্প কয়েকজন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী জঙ্গি, সবাই নয়। এই জঙ্গি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পাওয়া যাবে। জঙ্গি তৈরি করা হিযবুত তাহরীরের সেই নেতাদের ধরেন, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে জঙ্গি বলবেন না।

আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে জঙ্গি, এর অর্থ এই নয় যে- সব আওয়ামী লীগ নেতার ছেলেই জঙ্গি। এরপর বিএনপি নেতার ছেলের জঙ্গি পরিচয় প্রকাশ হলেই, সব দায় বিএনপির ওপর চাপানো যাবে না।

স্বীকার করতে হবে, জঙ্গিবাদ সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এখন সবচেয়ে জরুরি ভিত্তিতে জানা দরকার, জঙ্গিরা সংখ্যায় ও শক্তিতে কেমন। তাদের সংখ্যা -শক্তি কম দেখানো যেমন ঠিক না, কোনও কারণে বাড়িয়ে দেখানো হয়ে গেলেও, তা ক্ষতিকর।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে জঙ্গি ইমেজে পরিচিতি করে, শিক্ষার্থীদের আবার দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, দেশের জন্য ইতিবাচক নয়। আগে যারা ভারতে পড়তে যেত, এখন তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, আবার যেন আমরা তাদের ভারতে পাঠানোর পরিবেশ তৈরি না করি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি চালু করতে হবে, এটা আরেক রকমের বোকামি এবং পাগলামি। সম্পূর্ণরূপে ছাত্র রাজনীতির পক্ষে থেকেই এ কথা বলছি। বর্তমান সময়ে ছাত্রলীগ এক ভয়ঙ্কর সংগঠন। তার কর্মকাণ্ডে কোথাও ‘ছাত্র রাজনীতি’ নেই। তাদের কেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাণ্ডব চালানোর সুযোগ করে দেওয়া হবে?

ছাত্র রাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে এনে তারপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির কথা ভাবতে হবে।

৭. বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির কাছ থেকে আর একটু দায়িত্বশীল রাজনীতি প্রত্যাশিত। জাতীয় ঐক্যের ডাকই তার একমাত্র কাজ নয়। ‘এরা জঙ্গি কিনা, জীবিত কেন ধরা হলো না’- এ জাতীয় প্রশ্ন অবান্তর। আবার গণমাধ্যম থেকে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না, এমন ভাবনাও অবান্তর।

জনমানুষের মনে আসা প্রশ্নগুলোর থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার নীতি নিতে হবে। অতীতের কর্মকাণ্ডের দুর্বলতা চিহ্নিত করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, অবশ্যই আরও সক্ষম হয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস করি।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভুল সিদ্ধান্ত না নিলে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি-সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করে, জনমানুষের আস্থা অর্জন করতে নিশ্চয়ই সক্ষম হবে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

আরও খবর: দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে যা করছে সরকার

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ