X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘যে পিতা সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে ভয় পায়, আমি তাকে ঘৃণা করি’

প্রভাষ আমিন
০৪ আগস্ট ২০১৬, ১৩:২৭আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০১৬, ১৩:৪০

প্রভাষ আমিন কবিরা আসলেই ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। গত সপ্তাহে আমাদের ছেড়ে গেছেন ‘হাজার চুরাশির মা’ মহাশ্বেতা দেবী। তার ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্য আমাদের ছেড়ে গেছেন আরও আগেই, ২০১৪ সালে। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত তার কাব্যগ্রন্থ ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’র নাম এবং নাম কবিতার প্রথম দুটি লাইন কী অদ্ভুত প্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে এখনকার বাংলাদেশে, ‘যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়, আমি তাকে ঘৃণা করি’। এই কবিতা এখন কেমন নির্মম সত্য। বাংলাদেশ যেন আজ সত্যি সত্যি মৃত্যু উপত্যকা।
এই বাংলাদেশে আজ সত্যি সত্যি একজন পিতা সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে ভয় পাচ্ছেন বা সন্তানের প্রতি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায়, এটা অস্বাভাবিক। এখানে পারিবারিক বন্ধনটা এতই দৃঢ়, সন্তান যতই অপরাধ করুক, পিতা-মাতা তাকে ফেলে দেয় না। বাবা একটু রাগ করে থাকলেও মা ঠিকই সন্তানের পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু এখন মায়েরাও বলছেন, যে সন্তান নির্বিচারে নির্মমভাবে মানুষ খুন করে, তার মুখ তারা দেখবেন না। কতটা লজ্জা, কতটা গ্লানি, কতটা ঘৃণা বুকে থাকলে- একজন মা এমনটা বলতে পারেন; ভাবতেই আমি শিউরে ওঠি। গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনায় নিহত ৬ জনের লাশ এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সিএমএইচের মর্গে পড়ে আছে। কল্যাণপুরের ঘটনায় ৯ জঙ্গির লাশ পড়ে আছে ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে। এই জঙ্গিদের অনেকের বাবা-মা জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু সন্তানের লাশ নিতে আগ্রহ দেখাননি।
অনেক আগে থেকেই আমাদের সন্তানেরা লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছিল। র‌্যাবের সর্বশেষ তালিকায়ও ৬১ তরুণের নিখোঁজ হওয়ার খবর আছে। কিন্তু এ নিয়ে আগে পরিবারের পক্ষ থেকে তেমন উচ্চবাচ্য করা হয়নি। কেউ কেউ স্রেফ জিডি করেই দায়িত্ব সেরেছেন। সামাজিক অপমানের ভয়ে কেউ সন্তান হারানোর কথা কাউকে জানাতে চাননি। ফেরাতে পারেননি, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই জানতেন, তার সন্তান বিপথে চলে গেছে। তাই চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির পর পাল্টে গেছে গোটা দেশের পরিস্থিতি। হলি আর্টিজানের জঙ্গিদের পরিচয় প্রকাশের পর টনক নড়েছে সবার। এখন লাপাত্তা তরুণদের ফিরিয়ে আনতে ব্যাপক তোড়জোর শুরু হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নানারকম টোপ দেওয়া হচ্ছে। অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বানানো নানা তথ্যচিত্র প্রচারিত হচ্ছে বিভিন্ন টিভিতে। একটি বিজ্ঞাপন তো বেশ হৃদয় ছোঁয়া- মাকে আলিঙ্গন করে বেরিয়ে যায় যে তরুণ, তাকে পাওয়া যায় পুলিশের হাতে। সে মায়ের বেদনার্ত অভিব্যক্তি জল ঝরিয়েছে অনেকের চোখে। তবে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া তরুণদের ফিরিয়ে আনতে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে একটি ছবি।
শোলাকিয়ায় নিহত জঙ্গি আবিরের জানাজার ছবি
ঈদের দিন শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে হামলা করতে গিয়ে নিহত আবিরের নামাজে জানাজার ছবি এটি। পরিবার তো তার লাশ নেয়ইনি। জানাজায়ও অংশ নেয়নি কেউ। ইমাম একা একা জানাজা পড়েছেন। হায়, এই বিভ্রান্ত তরুণরা ইসলামের নামে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে ঘর ছেড়েছে। কিন্তু তাদের জানাজায় কোনও মুসলমান অংশ নিতে এগিয়ে আসে না, না পরিবার, না স্বজন, না বন্ধু-বান্ধব।
ইসলামে পিতা-মাতার স্থান অনেক ঊর্ধ্বে। সেই ইসলামের নামে কেউ যখন পিতা-মাতাকে ছেড়ে, সামাজিকভাবে তাদের হেয় করে, খুন করতে যায়; সেটা কোনোভাবেই ইসলামের জন্য হতে পারে না। এই বিভ্রান্ত তরুণরা ঘৃণা ছাড়া আর কিছু পায় না, পাবেও না কোনোদিন।
তবে কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার সঙ্গে আমি একমত নই। আমি বিভ্রান্ত তরুণকে ঘৃণা করি। কিন্তু যে পিতা সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে ভয় পায়; তাকে আমি ঘৃণা নয়, করুণা করি। সন্তানকে দেখে রাখতে পারেননি বলে, তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কিইবা করার আছে। আমি জানি, আমরা ঘৃণা করি আর করুণা করি; তাদের বেদনার উপশম করতে পারবো না। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ নাকি পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারি। কিন্তু সেই লাশ কখনও কখনও এতটাই ভারি হয়ে যায়, বহন করার সাধ্য থাকে না কারও।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না- কবির এই অভিব্যক্তির সঙ্গেও আমি একমত নই। যতই মৃত্যু উপত্যকা হোক, এই দেশ আমারই। এই দেশ, এই বিশ্বকে নিরাপদ করতেই হবে আমাদের। পালিয়ে যায় কাপুরুষরা। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই উপাধি পেতে চাই না আমরা। নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে একমত না হলেও, একমত হতে চাই সুকান্ত ভট্টাচার্যের সঙ্গে-
‘চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

আরও খবর: মুদি দোকানি থেকে দুর্ধর্ষ জেএমবি সদস্য!

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে ট্যাংক লরিতে নতুন ব্যবস্থা আসছে
চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে ট্যাংক লরিতে নতুন ব্যবস্থা আসছে
সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে ঐতিহ্যকে নষ্ট করতে দেবো না: নাছিম
সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে ঐতিহ্যকে নষ্ট করতে দেবো না: নাছিম
চলতি মাসেই বঙ্গবাজারে বহুতল মার্কেটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন  
চলতি মাসেই বঙ্গবাজারে বহুতল মার্কেটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন  
টানা দাবদাহের পর রাজধানীতে স্বস্তির বৃষ্টি
টানা দাবদাহের পর রাজধানীতে স্বস্তির বৃষ্টি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ