X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সন্ত্রাসের বিপরীতে পোপ

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৪ আগস্ট ২০১৬, ১৩:৫৮আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০১৬, ১৪:২৭

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী গত ২৬ জুলাই ফ্রান্সের পশ্চিমা অঞ্চলে দু’জন হামলাকারী ছুরি নিয়ে একটা গির্জায় হামলা চালিয়েছে। তারা ওই গির্জার ক্যাথলিক যাজককে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করে। এরপর গলা কেটে যাজককে তারা হত্যা করে। এ হত্যার দায় স্বীকার করেছে আইএস। ইউরোপ জুড়ে মুসলমান রয়েছে। দু’ একটা এলাকা ছাড়া কোথাও মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। ফ্রান্সে মুসলমানেরা দ্বিতীয় সংখ্যাগুরু গোষ্ঠী। ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এবং তারা ক্যাথলিক খ্রিস্টান। ফ্রান্সের লোক সংস্কৃতি পরায়ণ। আবার শান্তিবাদীও।
ইউরোপীয় সভ্যতা গঠনে ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবীদের অবদান নগণ্য নহে। সম্ভবতো তাই এখনও তারা কোনও মুসলমানকে অপমান করেননি। কোনও মুসলমানের উপাসনালয়ে আগুন দেননি। যদি এ ঘটনা ভারতে হতো তবে মুসলমানেরা টের পেতো কত ধানে কত চাল। এ প্রসঙ্গে ইউরোপীয় মুসলমানদের একটা কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন, গত শতাব্দীর প্রথমদিকে ইউরোপে ইহুদি সম্প্রদায় জ্ঞানে, বিজ্ঞানে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায় হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তাদের জনগোষ্ঠীও ইউরোপে কম ছিল না, শুধু জার্মানিতেই ইহুদির সংখ্যা ছিলো ৭০ লাখ। ইউরোপের বেশ কয়েকটা দেশের অর্থবিত্তের নিয়ন্ত্রণ ছিল ইহুদি সম্প্রদায়ের হাতে। মুসলমানেরা এখনও ইউরোপে সে অবস্থার এক শতাংশও অর্জন করতে পারেনি। ইহুদি সম্প্রদায় তাদের সমৃদ্ধির কারণে কোনও কোনও রাষ্ট্রে তাদের প্রতিপত্তি খাটানোর চেষ্টা করেছিল।
জার্মানিরা বলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিরা মিত্রশক্তিকে সাহায্য করেছিল। জার্মানিরা জাতে আর্য। তাদের ধমনীতে ক্ষত্রীয় রক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার নির্বিচারে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা করেছিল, অবশিষ্ট ১০ লাখ ইহুদি রাশিয়া সহ-বিভিন্ন রাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্সে এ যাবৎ তিনবার আক্রমণ চালানো হয়েছে।
অসংখ্য লোক নিহত হয়েছে। ব্রাসেলসেও হামলা করা হয়েছে। জার্মানিতেও হামলা হয়েছে। সর্বত্র মনের আনন্দে আইএস তার দায় স্বীকার করেছে। জার্মানির হামলার পরও তাদের চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন- এ হামলার পরও উদ্বাস্তু অভিবাসনের ব্যাপারে জার্মানির সিদ্ধান্তে কোনও পরিবর্তন আনা হবে না।
ভালো মানুষের আচরণকে কোনও সম্প্রদায় যদি ভালো আচরণ দিয়ে মোকাবিলা না করে অন্য পথে পা বাড়ায় তবে তাদের জন্য ইহুদির চেয়েও নির্মম পরিণতি অপেক্ষা করছে বলে মনে হয়। অথচ ইহুদিদের মতে মুসলমানেরা সম্প্রদায়গতভাবে কোনও দোষের কাজে সম্পৃক্ত নয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু যুবক পদভ্রষ্ট হয়ে এ সমস্ত অমানবিক ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়েছে। পথভ্রষ্ট এসব যুবকদের কারণে আজ সমগ্র বিশ্বে মুসলমান সম্প্রদায়কে সন্দেহের চোখে দেখছে।
আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মুসলমানদের আমেরিকায় অভিবাসন বন্ধ করে দেবেন। তিনি এমনও বলেছেন যে মুসলমানদেরকে মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। কয়েকজন পথভ্রষ্ট যুবকের জন্য সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায় ধীরে ধীরে প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। অথচ প্রাচীন সভ্যতাগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর মুসলিম সভ্যতায়ই ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিশ্বকে আলোর পথ দেখিয়েছে।

আজ সেই মুসলিম সমাজেই ভালো ডাক্তার নেই, ভালো ইঞ্জিনিয়ার নেই- ভালো কোনও বিজ্ঞানী নেই। ভালো কোনও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নেই অথচ অর্থবিত্তে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যে  হত দরিদ্র তাও নয়। মুসলিম যুবকেরা যা নেই তা হওয়ার চেষ্টা না করে এ ধ্বংসাত্মক পথে পা বাড়ানো কেন?

মুসলিম সমাজের জন্য এ পথ আত্মহননের পথ। দু’জন যাজক হত্যা করে, তিনজন পুরোহিত হত্যা করে আর চারজন বৌদ্ধ মঠের অধ্যক্ষ হত্যা করে তারা কি বিশ্বব্যাপী ইসলাম কায়েম করতে পারবে! নাকি তারা মুসলিম সম্প্রদায়কে অন্য সব ধর্মাবলম্বীর টার্গেটে পরিণত করছে?

যাদের তারা হত্যা করছে তাদেরও যুব সম্প্রদায় আছে। তারা যদি আমার মওলানা, আমার উপাসনালয় ধ্বংসের পায়তারা করে তবে তাতো এক ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। দেড়শত বছরব্যাপী এক সময় খ্রিস্টান আর মুসলমানদের সঙ্গে ধর্মযুদ্ধ হয়েছিল। দেড়শত বছরের এ যুদ্ধে লাভ হয়েছিল কি? লাখ লাখ খ্রিস্টান আর মুসলমান ধর্মান্ধতার বলি হয়েছিল মাত্র।
ঠুনকো ব্যাপার নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিরোধের সূচনা হয়। ফ্রান্সে যাজক হত্যার ব্যাপারটা পষ্ণদশ ষষ্টদশ শতাব্দীর ব্যাপার হলে এতোদিন ধর্মযুদ্ধ আরম্ভ হতো। একবিংশ শতাব্দীতে এসে খ্রিস্টান সমাজে ধর্মের বিষয়ে যৌক্তিক পরিপক্কতা অর্জন করেছে। শুধু হিন্দু আর মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে সে পরিপক্কতার অভাব রয়েছে এখনও প্রচুর।

খ্রিস্টান সমাজের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের (তারাই সারা বিশ্বে সংখ্যাগুরু) ধর্মগুরু হচ্ছেন পোপ। সারা ক্যাথলিক বিশ্বের তিনিই অধ্যাত্মিক নেতা। আগে তিনি বসতেন ইতালির কানোসায়। একবার রোম সম্রাটকে পোপ তার সঙ্গে দেখা করার হুকুম দিয়েছিলেন। সম্রাট নগ্ন পায়ে বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে মাহামান্য পোপের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ইতিহাসে তাকে ‘জার্নি টু কেনোসা’ বলে। এতই প্রতিপত্তি ছিল পোপের।
এখন পোপের সদর দফতর হচ্ছে ভ্যাটিকান সিটি। তাও ইতালির মাঝে। রাজধানী রোমের অনতিদূরে। বর্তমান মহামান্য পোপ হচ্ছেন ফ্রান্সিস। তিনি গত বুধবার ২৮ জুলাই পোল্যান্ডে যাওয়ার পথে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফ্রান্সে ক্যাথলিক গির্জার ৮৫ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ যাজক হত্যার বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হয়ে তিনি বলেছেন,  ধনবৈষম্যের শিকার হয়ে কিছু হতাশাগ্রস্ত যুবক এ হত্যাকাণ্ডটা ঘটিয়েছে। ইসলাম ধর্মে নরহত্যা করার কোনও অনুমতি নেই।
সত্যিই মহামান্য পোপ ইউরোপের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের রোশানল থেকে ইউরোপের মুসলমান সম্প্রদায়কে রক্ষা করলেন। হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকরা তাকে বহু উসকানিমূলক প্রশ্ন করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘দেখুন প্রত্যেকদিন ইতালিতে দেখি প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে খুন করছে, ভাই ভাইকে হত্যা করছে, পিতা পুত্রকে হত্যা করছে, অথচ তারা সবাই ক্যাথলিক দীক্ষায় দীক্ষিত। যদি খুন সম্পর্কে আমি মুখ খুলি তবে আমাকে প্রত্যেক খুন সম্পর্কে কথা বলতে হবে। আর এটাতো বিপদজনক।’
প্রাচীনকালে ক্যাথলিক খ্রিস্টানেরা বাড়িতে মেহমান আসলে পায়ে পানি ঢেলে মেহমানকে অভ্যর্থনা জানাতো। মহামান্য পোপ ফ্রান্সিস সিরিয়ার উদ্বাস্তু যখন ইউরোপে যাওয়া আরম্ভ করেছিল তখনও উদ্বাস্তুদের পায়ে পানি ঢেলে স্বাগতম জানিয়েছিলেন।
আর বলেছিলেন- তারা ‘ইউরোপের মেহমান’।  মহৎ লোকের আদর্শ মহান হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে পোপ একটি বই লিখেছেন। তিনি ধনবৈষম্য সম্পর্কে লিখতে গিয়ে গরিবের পক্ষে সওয়াল করেছেন। তিনি বলেছেন ধনবৈষম্য অনৈশ্বরিক।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]
আরও খবর: লন্ডনের রাসেল স্কয়ারে ছুরিকাঘাতে নিহত ১, আহত অন্তত ৫

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ