X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গিবাদে হেরে যাবে বাংলাদেশ?

আমীন আল রশীদ
০৬ আগস্ট ২০১৬, ১২:১০আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০১৬, ১৩:১০

আমিন আল রশীদ গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি এবং কল্যাণপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত ১৪ জঙ্গির লাশ এখনও গ্রহণ করেনি তাদের পরিবার।
গুলশানে অপারেশন থান্ডার বোল্টে নিহত ৫ জঙ্গির লাশ এখনও রয়েছে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের হিমঘরে। আর কল্যাণপুরে অপারেশন স্টর্ম-২৬- এ নিহত ৯ জঙ্গির লাশ আছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে। পুলিশ মহাপরিদর্শক জানিয়েছেন, কেউ লাশ না নিলে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হবে।
গুলশানে হামলার পর ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় নিহত জঙ্গির জানাজাও কেউ পড়েনি। একজনমাত্র আলেম নিয়ম রক্ষার জন্য তার জানাজা পড়েছেন। দেশের ইতিহাসে একজন মানুষের জানাজা পড়ার আর কোনও উদাহরণ সম্ভবত নেই।
কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়িতে নিহত জঙ্গি আব্দুল্লাহ ওরফে মোতালেবের পরিবার জানিয়েছে, আব্দুল্লাহর লাশ তারা চায় না। এমনকি গ্রামবাসীও চায় না আবদুল্লাহর লাশ দাফন হোক তাদের এলাকায়।
প্রথমে জানা গিয়েছিল, কল্যাণপুরে নিহত ৯ জঙ্গির মধ্যে একজনের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারায়। তার নাম সাব্বিরুল হক। তখন সাব্বিরের বাবা পুলিশকে জানিয়েছিলেন, ওই ঘটনায় নিহতদের মধ্যে যদি সত্যি তার ছেলে থাকে, তাহলে তিনি ছেলের লাশ তো নেবেনই না, বরং সংবাদ সম্মেলন করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইবেন। যদিও পরে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে সাব্বিরুল নামে কেউ নেই।
এসব ঘটনা এটিই প্রমাণ করে যে, জঙ্গিদের তাদের পরিবারও ঘৃণা করে। তারা তাদের লাশও নিতে চায় না। এই ঘটনা আমাদের এ কারণে আশাবাদী করে যে, ইসলামের নামে হোক আর যে নামেই হোক, দেশের মানুষ কোনও ধরনের জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ সমর্থন করে না। নিজের সন্তানও যদি বিপথে যায়, তাহলে বাবা মাও তাকে আর গ্রহণ করতে চান না। সুতরাং আপাতত আমরা এটি ধরে নিতে পারি যে, এই ভূখণ্ডে জঙ্গিবাদ বিজয়ী হবে না।
কিন্তু এই যুদ্ধে জয় খুব সহজও নয়। কারণ জঙ্গিবাদের শেকড় অনেক গভীরে। একদিনে কেউ জঙ্গি হয়ে ওঠে না। এক মাসের প্রশিক্ষণ বা ৫টি বই পড়েই কেউ নিজের জীবন বাজি রেখে মানুষ মারার খেলায় মেতে ওঠে না। মুসলমান মাত্রই বেহেশতে যেতে চাইলেও, এত সহজে কেউ বেহেশতে যাওয়ার লোভে সশস্ত্র হয় না। বিশেষ করে মানুষ খুন করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কেউ চট করে রাজি হয় না। এর জন্য যে দীর্ঘ পথপরিক্রমা তৈরি করা হয়েছে, সেই শেকড় উপড়ে ফেলা নিঃসন্দেহে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

তবে এটা ঠিক, নিহত জঙ্গিদের লাশ গ্রহণ না করা এবং পরিবারের একজন সদস্যের এমন বিপথে যাওয়ায় অন্য সদস্যদের লজ্জিত হওয়ার ঘটনা জীবিত জঙ্গিদের কাছে সম্ভবত এরকম একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছে যে, তারা আসলে ভুল পথে রয়েছে। কেননা, যদি সত্যিই তারা ইসলাম কায়েম বা বেহেশতে যাওয়ার লোভে মানুষ মারার এই উন্মাদ খেলায় মাতে, তাহলে খোদ পরিবারের কাছেই তারা ঘৃণার পাত্র হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর পরে তার সম্মানজনক দাফনও হচ্ছে না। সেইসঙ্গে পুরো পরিবার সমাজের কাছে অসম্মানিত হচ্ছে। যদি জীবিত জঙ্গিরা এই ঘটনাগুলো সত্যিই দেখে থাকে, আশা করা যায় তাদের চিন্তায় পরিবর্তন আসবে। কেউ হয়তো এই মরণখেলা ছেড়ে দিয়ে পরিবারে ফিরে আসবে। কেউ হয়তো নিজের ভুল স্বীকার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা দেবে।

কিন্তু এসবই আমাদের প্রত্যাশার কথা। বাস্তবতা হয়তো একদমই এরকম নয়। কেননা, গোয়েন্দাদের ধারণা, এই জঙ্গিদের এমন সব ওষুধ খাওয়ানো হয়, যা তাদের মন থেকে মানবিকতা, শুভবুদ্ধি আর সব ধরনের ভীতি দূর করে দেয়। ফলে তারা তখন শুধু মানুষ মারতেই পছন্দ করে। চাপাতি দিয়ে সে একজন নারীর গলায় কোপ দিচ্ছে নাকি তার বাবার বয়সী কোনও বৃদ্ধের-সেই বুদ্ধিবিবেচনাবোধ তার থাকে না। সুতরাং নিহত জঙ্গিদের লাশ দিনের পর দিন হিমঘরে পড়ে আছে বলে কিংবা তাদের কোনও সতীর্থর জানাজা পড়ার মতো কোনও লোক পাওয়া যায়নি বলে যে অনুতাপ বা দুঃখবোধ তাদের ভেতরে জাগ্রত হওয়ার কথা- তা হয়তো হচ্ছে না। সুতরাং যারা জঙ্গিবাদের পথে আছে, যারা ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে, মানুষের ভিড়ে, অন্য শহরে বা গ্রামে প্রস্তুত হচ্ছে আরও বড় কোনও হামলার জন্য- তাদের প্রতিহত করাই এখন চ্যালেঞ্জ।

এটি এখন একটি যুদ্ধ। মানবিকতার সঙ্গে অমানবিকতার যুদ্ধ। মানুষের সঙ্গে পশুর যুদ্ধ। প্রকৃত ধর্মের সঙ্গে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা'র যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সঙ্গে স্বদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সৈনিক এখন কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই নয়, বরং এই যুদ্ধের সৈনিক এখন সারা দেশের মানুষ।

যে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, এখন প্রকৃত অর্থেই সেই ঐক্যের কোনও বিকল্প নেই। এখানে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির কোনও সুযোগ নেই। এটি বিএনপি-আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় থাকার লড়াই নয়। এটি পুরো জাতির এবং সারা দেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন। কারণ ভেতরে ভেতরে কত হাজার জঙ্গি তৈরি হয়ে আছে, কতগুলো আত্মঘাতি দল তৈরি হয়ে আছে, কত হাজার মারণাস্ত্রের মজুদ করা হয়েছে, কতগুলো হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছে, কবে কোথায় কিভাবে এই হামলা হবে-তা আমরা জানি না। গোয়েন্দাদের কাছে হয়তো অনেক তথ্য আছে। আবার অনেক তথ্য নাও থাকতে পারে। কেননা জঙ্গিরা যে কত চৌকস এবং ভয়ংকর, তারা যে কত আধুনিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত, কত অর্থবিত্ত তাদের পেছনে বিনিয়োগ করা হয়েছে- তার কিছুটা আন্দাজ হয়তো করা গেছে গুলশান হামলায়।

সুতরাং এটি অনেক বড় যুদ্ধ। এই ‍যুদ্ধে বাংলাদেশকে জিততেই হবে। এই লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এখন প্রতিটি নাগরিক যোদ্ধা। প্রতিটি নাগরিক গোয়েন্দা। প্রত্যেকে সতর্ক। কারও একটু অসতর্কতায়, অবহেলায় বড় কোনও দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে বাংলাদেশ। অতএব আগে ঘর সামলান। আপনার পরিবারের সন্তান কোথায় যায়, কী করে, কার সঙ্গে ফোনে কথা বলে, কী পড়ে, ইন্টারনেটে কী করে- এসবকিছু নজরদারির বিকল্প নেই। কারণ ভেতরে ভেতরে আসলেই কত হাজার তরুণ জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিয়েছে, কী পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ তারা মজুদ করেছে- তা আমাদের অজানা। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এই দেশ জঙ্গিবাদের কাছে হেরে যাবে- সেটি আমাদের কাম্য নয়।

লেখক: সাংবাদিক

আরও খবর: সরদার কালোনি: যেখানে অভিযান চালায় না পুলিশ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ