X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

মওদুদ আহমদের বাড়ি সমাচার

চিররঞ্জন সরকার
০৯ আগস্ট ২০১৬, ১৩:১২আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০১৬, ২০:২৫

চিররঞ্জন সরকার বাড়ি যে কী জিনিস- যার বাড়ি নেই সেই কেবল বোঝে। দিন শেষে সবাই ঘরে ফেরে, ফিরতে চায়। ঘর মানে আশ্রয়, বাড়ি, ঠিকানা। বাড়ি-বাসা-ঘর-ঠিকানা-আশ্রয়-ভিটা যাই বলি না কেন, ওটা প্রত্যেক মানুষের জন্যই পরম কাঙ্ক্ষিত। অনেক ঘাড়ত্যাড়া ব্যক্তি বলতে পারেন, গৌতমবুদ্ধ তো ঘর ছেড়ে বনে গিয়েছিলেন। জঙ্গিরাও তো বাড়িঘর ছেড়ে অচেনা-অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমাচ্ছেন! এগুলো আসলে ব্যতিক্রম। বাড়ি-ঘর সবাই চায়। শুধু চায়ই না, সেটা যেন ভালো ‘বাসা’ হয়-এটাও চায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছিলেন, বহুদিন মনে ছিল আশা প্রাণের গভীর ক্ষুধা পাবে তার শেষ সুধা; …ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা করেছিনু আশা ।
তবে আমাদের দেশে রাজনীতিকরা নানা ফিকিরে বড় বড় বাসা বাগিয়ে নেন। এক টাকা, দুই টাকা প্রতীকী মূল্যে বিশাল এলাকাজুড়ে সুরম্য অট্টালিকা গড়ে অনেকই সুখে শান্তিতে বসবাস করেন। অনেকে ধরাও খান, কেউবা পার পেয়ে যান।
তবে আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষ আছেন যারা অন্যের ‘ভিটায় ঘুঘু চড়ানো’র বিদ্যায় ওস্তাদ। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে কম যায় না। এই সরকারের আমলে আদালতের নির্দেশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এর আগে ক্যান্টনমেন্টে দীর্ঘদিন অবৈধ ভাবে থাকা বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশের রাজনীতির আরেক বর্ণাঢ্য পুরুষ মওদুদ আহমদকেও গুলশানের একটি সুরম্য বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার প্রক্রিয়া চলছে। ইতিমধ্যে আদালতের নির্দেশ জারি হয়েছে। বাকিটা সময়ই বলবে!
দেশের রাজনীতিতে বহু অঘটনের নায়ক, দলবদলের মাস্টার, সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাড়ি-ছাড়া হবেন, সেটা বিশ্বাস করা সত্যিই কষ্টকর।
মওদুদ আহমদ একজন 'ঝানু খেলোয়াড়'। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় অ্যাডভোকেট ফরমান উল্লাহ খান প্রতিষ্ঠিত খেলাফত রব্বানীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশক্তির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা ছিলেন তিনি।  ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে লন্ডনে অবস্থানরত ব্যারিস্টার মওদুদকে পোস্টমাস্টার জেনারেল নিয়োগ করে মুজিবনগর সরকার। মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত ডাকটিকিট প্রকাশ ও শুভেচ্ছামূল্য বাবদ অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব নেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের ডাকটিকিট বিক্রি থেকে সংগ্রহ করা অর্থের মোটা অঙ্ক আত্মসাৎ করার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের সময় ব্যারিস্টার মওদুদের বিরুদ্ধে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার চর অভিযোগ এনে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের একান্ত আবেদনে বঙ্গবন্ধু তাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, মওদুদ পল্লীকবির জামাতা। তবে মওদুদের কাছ থেকে এই মর্মে লিখিত অঙ্গীকারনামা নেওয়া হয় যে, তিনি জীবনে কোনওদিন রাজনীতি করবেন না।  কিন্তু সে অঙ্গীকারনামা 'মওদুদনামায়' পরিণত হয়। পরবর্তী জীবনে তিনি কখনও কোনও অঙ্গীকার পালনের ধার ধারেননি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর ব্যারিস্টার মওদুদকে তার মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে নিয়েছিলেন। ইস্ট-ওয়েস্ট ইন্টারকালেক্টর প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে পরে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার পর জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার শেষভাগে মওদুদ ছিলেন সে-সময়কার বিএনপির বিদ্রোহী শিবিরে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক শাসনামলে গুলশানের বাড়িসংক্রান্ত মামলায় মওদুদের বাড়ি বাজেয়াপ্ত হয়। তিনি ১২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। অবশ্য এ-মামলার পরই ১৯৮৩ সালে এরশাদের সামরিক সরকারেরই মন্ত্রী হয়েছিলেন মওদুদ।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন মওদুদ আহমদ। বিএনপি সরকারের সময় ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানের কর্মসূচির বিরোধিতা করায় তাকে উপপ্রধানমন্ত্রী থেকে বরখাস্ত করা হয়। বেগম জিয়ার সঙ্গে ১৯৮৫ সালে কুমিল্লা সফর থেকে ফেরার সময় গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হন। ঢাকায় এসে তিনি বলেন, ‘এটা দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত ঘটনা। আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া ও স্বৈরাচার এরশাদ।’ হাসপাতালেও ভর্তি হন মওদুদ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনদিন পরই সেখান থেকে সরাসরি বঙ্গভবনে গিয়ে এরশাদ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বিগত ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার ইস্যুতে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। বিচারপতিদের চাকরির বয়স বাড়িয়ে হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা করার আইডিয়া আসে মওদুদের মাথা থেকেই। এর মাধ্যমে তিনি আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের পথে ঠেলে দেন। ক্যান্টনমেন্ট থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের মামলা চলাকালেও বিতর্কিত হন মওদুদ। চেয়ারপারসনের সেই দুঃসময়ে তিনি ছিলেন বিদেশে।
দল বদলে সিদ্ধহস্ত এ নেতা এরশাদ সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদ সরকারের পতনের আগ মুহূর্তেও এরশাদের পক্ষে সংবিধান এবং আইন দেখিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন মওদুদ। সর্বশেষ ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির টিকিটে এমপি হয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন। দেখা যাচ্ছে যে মুজিব-জিয়া-এরশাদ-খালেদা সরকারের খেদমত করেছেন দলবদলের রাজনীতির ঝানু খেলোয়াড় মওদুদ।  
বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে বিচার বিভাগকে তছনছ করেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ। আইনের মারপ্যাঁচে তিনি বিভিন্ন ভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। বিচারকদের বয়স বাড়িয়ে নিজের দলের লোককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করতে তিনি একটি আইন পাস করেন। তার বুদ্ধিতেই জোট সরকার বিচারপতি এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করে। তিনিই অযোগ্য লোকদের বিচারপতি নিয়োগ করেন। তবে জাল সনদধারী লোককে বিচারপতি নিয়োগ করে ন্যাক্কারতম ইতিহাসটি সৃষ্টি করেছেন মওদুদ। তার কারণেই বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়নি বলে দেশের মানুষ মনে করছেন।
বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সাব-রেজিস্ট্রার নিয়োগ ও বদলি, বিভিন্ন আদালতে বিচারক নিয়োগ, বদলি ও পদায়ন, কাজি নিয়োগ-সহ বিভিন্নভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে প্রতি মাসে বিপুল টাকা আয় করতেন মওদুদ। সবকিছু ম্যানেজ করে মুখে মিটি মিটি দুষ্ট হাসি আর আইনের কথা বলে যাবতীয় বেআইনি অপতৎপরতা চালিয়েছেন ব্যারিস্টার মওদুদ।
জীবনভর যিনি মানুষকে হাইকোর্ট দেখিয়েছেন, হাসতে-হাসতে কঠিন সব সর্বনাশা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেই মওদুদ সাহেবকে ধরা খেতে হলো বাড়ির মামলায়! দেশে আসলেই আইনের শাসন নেই! উল্লেখ্য, মওদুদ আহমদের এই বিখ্যাত বাড়িটির আয়তন মাত্র ১ বিঘা ১৩ কাঠা। ১৯৬০ সালে ডিআইটির কাছ থেকে প্লট বরাদ্দ পান পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ এহসান। ১৯৬৫ সালে প্লটের নিবন্ধন হয় এহসানের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে। তারপর তারা ঘর তুলে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এহসান স্ত্রীসহ ঢাকা ছেড়ে চলে যান। এরপর তারা আর ফেরননি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যাক্ত সম্পত্তির তালিকাভূক্ত হয়। এরপরই প্রিয় মানুষ পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের জামাতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যিনি বাংলাদেশের প্রথম পোস্টমাস্টার জেনারেল ছিলেন তিনি বাড়িটি দখল করে নেন। ১৯৭৩ সালে মওদুদ আহমদ ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে ভুয়া আমমোক্তারনামা তৈরি করে প্লাজার ভাড়াটিয়া হিসেবে বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন।
এরপর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৮০ সালে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ উপপ্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দিতে সক্ষম হন এবং মাত্র ১০০ টাকা মূল্য দেখিয়ে তার নামে প্লটটি বরাদ্দ নেন। পরে এই বাড়ি আইনি ভাবে দখলে রাখার জন্য ব্যারিস্টার সাহেব তার ভাইয়ের নামে, নিজের নামে করার জন্য নানা জালিয়াতির আশ্রয় নেন। চলে দীর্ঘ আইনি লড়াই। এই হলো ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদের বাড়ির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
আমরা মওদুদ আহমদকে সালাম জানাই, তার বিরল প্রতিভার জন্য। এতো ভদ্রভাবে এতো বেশি মিথ্যাচার, এতো বেশি অনাচার, ভ্রষ্টাচার, এতো বিচিত্র আদর্শের দলের নেতা হওয়ার, এতোবার মন্ত্রী থাকার কৃতিত্ব পৃথিবীতে অন্য কেউ কখনও দেখাতে পেরেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। সালাম জানাই তাদেরও, যারা সব কিছু জেনেশুনে এই মওদুদ আহমদদেরই বার বার দলে টানেন, নেতা এবং মন্ত্রী বানান। সালাম জানাই তাদের, যারা এই মওদুদদেরই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠান। ধন্য আমার দেশ, ধন্য দেশের নেতা। কবি ঠিকই বলেছিলেন 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!' সত্যিই তাই!

পুনশ্চ: ফেসবুকে আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধু মওদুদ আহমদের বাড়ি নিয়ে এক মহাদার্শনিক উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।' এটাই চিরন্তন সত্য। ধর্মের কল বাতাসে নড়বেই!
হবেও বা! নড়ুক, নড়তে থাকুক!

লেখক: কলামিস্ট

আরও পড়তে পারেন: সুনসান মওদুদের বাড়ি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে বিভিন্ন জেলায় নামাজ আদায়
বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে বিভিন্ন জেলায় নামাজ আদায়
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর বোল্ট
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর বোল্ট
রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ার লিগে ওয়ান্ডারার্স 
রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ার লিগে ওয়ান্ডারার্স 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ