X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাধারণ সব মানুষই তো ‘মফিজ’

গোলাম মোর্তোজা
১০ আগস্ট ২০১৬, ১৩:০০আপডেট : ১০ আগস্ট ২০১৬, ১৩:০৩

গোলাম মোর্তোজা বন্যা-খরা ক্ষুধায় কাতর উত্তরবঙ্গের একদল মানুষকে বাসের ছাদে তুলে দিয়েছিল টার্মিনালের দালাল ‘মফিজ’। সেই ধারা আর বন্ধ হয়নি। অর্ধেক বা তারও কম ভাড়ায় জীবনজীবিকার তাগিদে তারা ঢাকা এসেছিলেন।
দালাল ‘মফিজে’র লোক থেকে তারা নিজেরাই ‘মফিজ’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন। আর্থিকভাবে দরিদ্র, গ্রাম থেকে আসা বোকা (তাচ্ছিল্য অর্থে) মানুষদের পরিচিত হয়ে গেছে ‘মফিজ’। নাগরিক জীবনের প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত শিক্ষিতরা (যারা নিজেদের ‘এলিট’ ভাবেন) গ্রাম থেকে আসা দরিদ্র, সহজ-সরল মানুষগুলোকে ‘মফিজ’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। ‘মফিজ’ শব্দটিকে তারা প্রায় গালিতে পরিণত করেছেন। চুলে তেল দেওয়া কৃষকের মেধাবী সন্তানটি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ে ভর্তি হয়, শহরের সহপাঠীরা তাকে নিয়ে রসিকতা করে, নাম দেয় ‘মফিজ’। তুই তো ‘মফিজ’, আমি তো ‘মফিজ’ বনে গেলাম- এসব কথা শহরের মানুষেরা নানা সময়েই বলে থাকেন। ‘মফিজ’ নিয়ে আজকের আলোচনা।
১. আজ থেকে অনেক বছর আগে হরতাল-ধর্মঘট জাতীয় কোনও কারণে, আরিচা থেকে একবার ঢাকায় এসেছিলাম বাসের ছাদে উঠে। ঢাকা শহরের কিছু চিনতাম না, জানতাম না।
নগরের মানুষগুলোর মাঝে নিজেকে খুবই বেমানান মনে হতো। এই লেখা যারা পড়ছেন, তাদেরও অধিকাংশই গ্রাম থেকে এসেছেন, বা বাবা-চাচারা গ্রাম থেকে এসেছেন। প্রথম যারা ঢাকা শহরে এসেছেন তাদের সবার অভিজ্ঞতা এক রকম না হলেও, নানা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়তো অনককেই হতে হয়েছে। সেই অর্থে ঢাকা নগরেরও অধিকাংশ মানুষ যারা গ্রাম থেকে এসেছি, তারা প্রায় সবাই ‘মফিজ’।  এই ‘মফিজদেরই’ একটি অংশ এখন ‘এলিট’ হয়েছেন। নব্য ‘এলিট’রা গ্রাম থেকে আসা দরিদ্র, সহজ-সরল মানুষগুলোকে ‘মফিজ’ বলেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আর সেই চেহারায় দেখেন না। জীবন হিসেব করেন এখন থেকে, আজকে থেকে। তার কোনও অতীত নেই, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ আছে। ‘এলিট’রা চতুর-ধুরন্ধর, হিসেবি, ‘মফিজ’রা বোকা-সরল।
২. বোকা, সহজ-সরল ‘মফিজ’রা পরিবেশ অনুযায়ী চলতে পারেন না। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় নেন। বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করে ধুরন্ধর ‘এলিট’রা প্রশ্ন করেন না। নিরবতা পালন করেন। ‘মফিজ’রা প্রশ্ন করেন, প্রশ্ন করে কত বড় বিপদে পড়তে পারেন, তা বিবেচনায় রাখেন না।

হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ছাদে একজন জঙ্গি, দু’জন ‘এলিট’ হাসনাত করিম এবং তাহমিদ হাসিবকে নিয়ে পরামর্শ বা পরিকল্পনা করছেন। জঙ্গির গলায় ঝোলানো রাইফেল, তাহমিদের হাতে পিস্তল (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন মানুষ যেভাবে পিস্তল ধরেন সেভাবে ধরা), আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন হাসনাত করিম। এই তিনজনের এমন ছবি দেখে ‘মফিজ’দের মনে কিছু প্রশ্ন এসেছে। প্রশ্ন শুধু মনেই রাখছেন না, বোকা ‘মফিজ’রা তা বলে বা লিখেও ফেলছেন।

হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ তো ঘেরাও করে রেখেছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এত নিরুদ্বিগ্নভাবে এই তিনজন ছাদে কেন উঠলেন? তাদের কি ভয় ছিল না যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে স্নাইপার রাইফেল আছে?

কী কথা বলছিলেন তারা ছাদে? তাহমিদের হাতে অস্ত্র কেন? জঙ্গি বা সন্ত্রাসী বা প্রতিপক্ষ, আর যাই হোক হাতে তো অস্ত্র তুলে দেওয়ার কথা নয়! তাহলে কি তাহমিদ জঙ্গিদের সহযোগী? হাসনাত করিম কেন হামলার কয়েক মিনিটের মধ্যে মোবাইলে জঙ্গিদের অ্যাপস ডাউনলোড করলেন? হাসনাত করিম কি হামলা পরিকল্পনাকারী বা পরিচালনাকারীদের একজন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছবি তুললেন না কেন, ভিডিও করলেন না কেন?

‘মফিজ’দের মনে প্রশ্ন আসে, সাগর-রুনি হত্যার বিচার কেন হয় না? প্রকাশক দীপনের হত্যাকারীরা সনাক্ত হবে না, ধরা পড়বে না? বিচার পাবেন না দীপনের স্ত্রী -সন্তান -বাবা -মা?

তনু হত্যাকাণ্ডের এ কেমন তদন্ত? তনুর বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনদের কেন নাজেহাল করা হয়? তনুর মা যাদের কথা বলেন, তাদেরকে কেন তদন্তের আওতায় আনা হয় না? ময়নাতদন্তের নামে ডাক্তারা এসব কী বলেন, কেন বলেন?

এসপি বাবুল আক্তারকে নিয়ে কী চলছে? ত্বকী হত্যার চার্জশিট দেওয়া হয় না কেন, তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পরও? সাংবাদিক শামছুর রহমান, বালু, মানিক সাহা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কেন কোনও দিন হবে না, কেন বিচার পাবেন না পরিবার? কেন নিরীহ কলেজ ছাত্র লিমনের পায়ে গুলি করে তাকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়? কেন নিরপরাধ লিমনকে ভয়ঙ্গর সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টা? ক্রসফায়ারের গল্প ‘মফিজ’রা বিশ্বাস করেন না। জনগণ ধরে দেওয়ার পর জঙ্গি ফাহিম বা শিক্ষক হত্যায় অভিযুক্তদের কেন হত্যা করা হলো, প্রশ্ন করেন ‘মফিজ’রা?

‘মফিজ’রা জানেন না যে, প্রশ্ন করা যাবে না। প্রশ্ন করলে ‘এলিট’রা বিব্রত হয়, তাও তারা বোঝেন না। একটি প্রশ্ন বা একটি ছবি পুরো তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে, তা বোঝার মতো বুদ্ধি বোকা ‘মফিজ’দের নেই! তাই তারা প্রশ্ন করে বিপদে পড়েন, বিপদে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি করেন। ‘মফিজ’দের কথা, প্রশ্নে বুদ্ধির মারপ্যাঁচ থাকে না। সহজ-সরল প্রশ্নে নির্বোধের ছাপ দেখেন ‘এলিট’রা। ‘মফিজ’দের নির্বুদ্ধিতা দেখে ‘এলিট’রা বিস্মিত হন, ক্ষুব্ধ হন। মানুষ কী করে এত বোকা, এত সরল হতে পারেন!

৩. ‘মফিজ’রা কাটা চামচ দিয়ে মাছ বেছে খেতে জানেন না। কোন চামচটি কোন হাতে ধরতে হয় জানেন না। ‘মফিজ’রা জানেন না, খাওয়ার সময় কাটা চামচ আর প্লেটে ‘খটখট’ করে শব্দ হবে না। পানি পানের সময় শব্দ করা যাবে না। বেশি খাবার একবারে মুখে নেওয়া যাবে না, চাবাবেন কিন্তু শব্দ হবে না। চা পানের সময় ‘চুক চুক’ শব্দ করা যাবে না, তাও মফিজরা জানেন না। বাথরুম কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, ‘মফিজ’রা তা কোনোদিন শেখেননি। বাথরুমের মেঝে থাকবে শুকনো, কমোডের ওপর পানি ফেলা যাবে না, এসবের কিছুই তারা জানেন না। শহরের ‘এলিট’রা বোকা-সরল ‘মফিজ’দের আচরণে লজ্জিত হন, বিব্রত হন। পুলকিত হন নিজেদেরকে ‘এলিট’ ভেবে, ‘মফিজ’দের ‘ক্ষ্যাত’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন।

৪. আমরাও ‘মফিজ’দের কাতারেই পড়ি। অনেকের কষ্টের কারণ হয়ে দেশ-বিদেশ যাওয়া, দেখার সুযোগ হয়েছে। একই আমন্ত্রণে অনেক ‘এলিট’দের সঙ্গে দেশে-বিদেশে বড় বড় পার্টি, সেমিনারে যাওয়ার সুযোগ হয়। ‘এলিট’দের অনেককে কাছ থেকে দেখি।

‘এলিট’দের দেখে বিস্মিত হই! দেখি, ‘এলিট’দের অনেকে কোন ‘পানীয়’র গ্লাস কোন হাত দিয়ে, কয় আঙুল দিয়ে ধরতে হবে- তা জানেন না। জানেন না, কোন পানীয়’র পর কোন ‘পানীয়’ পান করা দৃষ্টিকটু। বাথরুমের কমোড-মেঝে ভিজিয়ে একাকার করে ফেলেন। ডান হাতের কাটা চামচ বাম হাতে ধরে, হাত দিয়ে মাংস ছিড়ে চামচে তুলে ‘চপচপ’ করে চাবাতে থাকেন। দেখি আর ভাবি, হে ‘এলিট’ পাঁচ সাত দশ বছর আগে, কোথায় ছিলেন?

বাড়িতে একটি বাথরুম ছিল? কাটা চামচ দেখেছিলেন কখনও? দুই মাইল হেঁটে, কাদা মাড়িয়ে খালি পায়ে স্কুলে যাননি, আপনার বাপ-চাচা-দাদারা লুঙ্গি কাছা দিয়ে স্কুলে যাননি? নিয়মিত হারিকেন জ্বালানোর কেরোসিন তেল কেনার পয়সা কৃষক বাবার ছিল না, বা অনেক কষ্টে সেই পয়সা জোগাড় করতেন, তা ভুলে গেছেন? আপনাদের কয়জনের বাবা -চাচারা  কোনোদিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন? রোদে পুড়ে, ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে উৎপাদন করা ধান বিক্রি করে যে বাবা আপনাকে পড়াশোনার জন্যে শহরে পাঠিয়েছিলেন, সেই কৃষক বাবা আজ আপনার কাছে ‘মফিজ’!

হ্যাঁ, ঠিকই বলছেন ‘গ্রাম থেকে উঠে আসা প্রাক্তন চাষা-ভূষা’ সবাই ‘মফিজ’!
৫. ‘মফিজ’রা শেয়ারবাজার, ব্যাংক লুট করেন না। সুন্দরবন ধ্বংস করেন না। অর্থের বিনিময়ে মানুষ হত্যা করেন না, হত্যা মামলা চাপা দেন না। ১৯৭১ সালে দেশের জন্যে রক্ত এই ‘মফিজ’রাই সবচেয়ে বেশি দিয়েছিলেন। দেশ ‘মফিজ’দের হাতে থাকলে ধুরন্ধর টাউট-বাটবার তৈরি হতো না!

দেশের আজকের এই উন্নয়নের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান 'মফিজ'দের। অবদান প্রবাসী 'মফিজ 'দের, গার্মেন্টস কর্মী 'মফিজ 'দের। আর জঙ্গি -দুর্নীতি -অনিয়ম অনৈতিকতা - অধপতনের জন্যে দায় আপনাদের, 'এলিট 'দের।

তথাকথিত স্বঘোষিত ‘এলিট’দের কথাগুলো মনে রাখা দরকার।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

আরও খবর: সন্দেহভাজন জঙ্গিরা কে কবে দেশ ছেড়েছে?

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ