X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশকে চিনতেন তিনি...

শুভ কিবরিয়া
১১ আগস্ট ২০১৬, ১৭:৪৫আপডেট : ১১ আগস্ট ২০১৬, ১৭:৫৯

শুভ কিবরিয়া বাঙালির ভক্তি প্রবণতা অসাধারণ। সে যখন কাউকে ভক্তি করা শুরু করে তখন কোনও যুক্তি নিয়ে আলোচনা করে না। আবার যখন কাউকে শত্রু মনে করে তখন শত্রু বধেই সে নিবিষ্ট থাকে। কাজেই আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসে আমরা যাদের পছন্দ করি সেইসব বীরদের নিয়ে তৈরি হয় অনেক অপ্রয়োজনীয় মিথ। আবার অপছন্দের নায়কদের আমরা শত্রু বানিয়ে খুঁজতে থাকি অসহ্য সব দোষ। এর বাইরে আবার যুক্ত হয় বৈষয়িক ভাবনার তরল সব উপাত্ত। কাউকে পূজা করলে যদি ব্যক্তিগত বৈষয়িক প্রতিষ্ঠার সুযোগ মিলে তবে নিবেদনে বাঙালি শ্রেষ্ঠ। কাউকে শত্রু বানিয়ে প্রচারণা চালালে যদি বৈষয়িক লাভ আসে, তবে তা যত অন্যায্যই হোক না কেন বাঙালির তাতে আপত্তি নেই। বাঙালির এই প্রবণতাকে একধরনের ভাবপ্রবণতাই বলা চলে। বাঙালির এই ভাবপ্রবণতার চাপ বঙ্গবন্ধুর জীবন আলোচনাতেও পড়েছে।
দুই.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) -এর জীবনকে আমরা তাই একমাত্রিক ভাবে দেখতে চেয়েছি। অথচ তিনি ছিলেন এই ভূ-খণ্ডের জল-কাদায় বেড়ে ওঠা একজন বহুমুখীন মানুষ। রাজনীতির মানুষ হিসেবে নানান চড়াই-উৎরাই পেরুতে হয়েছে তাকে। রাজনীতিতে একজন নেতাকে যা যা করতে হয়- আলোচনা, আন্দোলন, সমঝোতা, লড়াই তার সবকিছুই তিনি করেছেন। কখনও সুদিন এসেছে, কখনও দুর্দিন মেনে নিয়েই রাজনীতির পথে অবিচল থেকেছেন। এই রাজনীতিই তাকে শীর্ষস্থানে নিয়ে গেছে কিন্তু কখনই ভোলেননি মানুষের কথা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানুষের কথাই ভেবেছেন। এ রকম একটা ঘটনার কথা বর্ণনা করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইয়ে-
‘১৯৭৪ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর কাছে আমরা শিক্ষা কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করতে গেলাম। সভাকক্ষে এসে আসন গ্রহণ করে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সভার পরে আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করে যাই।... আমি যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, তখন সেখানে শিক্ষামন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।...
...আমি সেই অবকাশে জানতে চাইলাম, তিনি কেমন আছেন। কিছুকাল আগে তিনি মস্কোতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার দেশে প্রত্যাবর্তনের পরে আমার সঙ্গে এই প্রথম দেখা। আমার প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, তিনি খুব ভালো নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে মস্কো থেকে চলে এলেন কেন? তিনি বললেন, ‘আমি এমন একজন প্রধানমন্ত্রী যাকে ভাইস চ্যান্সেলর ঘেরাও হলেও তাকে উদ্ধার করতে যেতে হয়। মস্কোতে থাকতে খবর পেলাম, সূর্যসেন হলে সাতজন ছাত্র খুন হয়েছে। তখন চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে চলে এলাম।’ বললাম, ‘আপনি বিশ্রাম নিন না কেন? এখানে না পারেন, সপ্তাহান্তে ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যান।’ তিনি বললেন, ‘দেশে কোথাও গিয়ে বিশ্রাম হবে না। যেখানে যাবো, সেখানেই লোকজন ভিড় করবে।’ বললাম, ‘লোকজনকে দেখা দেবেন না।’ এবার তার চোখে পানি এসে গেল। বললেন, ‘লোককে খেতে দিতে পারি না, পরতে দিতে পারি না, দেখাও যদি না দিতে পারি, তাহলে আমার আর থাকলো কী?’ আমি এবারে অপ্রস্তুত হলাম।’

তিন.

বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানান ঘটনা, কাহিনী জানলে বোঝা যায় এই মানুষটি কী বিপুল পরিমাণ মমত্ব আর ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধেছিলেন এই মাটি আর মানুষকে। এ রকম একটা ঘটনার বয়ান দিয়েছেন সাংবাদিক এবিএম মূসা তার ‘মুজিব ভাই’- নামের গ্রন্থে। ... ‘ফেনীর মরহুম রুহুল আমিনকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ভুসির ব্যবসা করত বলে তার নামই দিয়েছিলেন তিনি ‘ভুসি’। আমি তখন সংসদ সদস্য। এলাকায় গেলেই আমার কাছে ভ্যানভ্যান করত, ‘আমার কিছু হলো না, দেশ ও দলের জন্য এত কিছু করেছি, সর্বশান্ত হয়েছি। মুজিব ভাই প্রধানমন্ত্রী হলেন অথচ আমি কিছুই পেলাম না।’ এত সব ঘ্যানর ঘ্যানর শুনে বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘চলো, তোমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যাই। যা বলার তাকেই বলো।’

ঢাকায় এলো ভুসি, বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধু তাকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘ওরে আমার ভুসি আসছে’ বলে হইচই করে উঠলেন। ভুসি মাখনের মতো একেবারে গলে গেল। বঙ্গবন্ধু যতই বলেন, ‘কেমন আছিস, কোনও অসুবিধা নেই তো’, ভুসি ততই খালি তোতলায় আর বলে, ‘ভা-ভা ভালোই আছি। ক-ক কোনও অসুবিধা নেই।’ বঙ্গবন্ধু তার পরিবার, এলাকার, দেশের অবস্থার খোঁজখবর নিলেন, আধা ঘণ্টা পরে ভুসিকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। রেগে বললাম, ‘কী হলো, এত প্যানপ্যানানি গেল কই, কিছুই তো বললে না, চাইতে পারলে না!’ ভুসি আমতা আমতা করে বলল, ‘কী করব, নেতাকে দেখে যে সবই ভুলে গেলাম’।’

চার.

বঙ্গবন্ধুর বন্ধুভাবাপন্নতা ছিল বিস্ময়কর। ভিন্নমতাবলম্বী বন্ধুদের এখন আমরা যেরকম নির্মূল করতে উদ্ধত হই রাজনৈতিক প্রতিহিংসায়, বঙ্গবন্ধু নিজে ছিলেন তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বিপরীত ধারায় অবস্থান করতেন আজীবন তার বন্ধু ডা. এম এ করিম। তাজউদ্দীন আহমদেরও অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন  ডা. করিম । বঙ্গবন্ধুর বন্ধুবাৎসল্যের একটা ঘটনার  বর্ণনা দিয়েছেন ডা. এম এ করিম তার ‘ঢাকা সেন্ট্রাল জেল। নানা রঙের দিনগুলো’ বইয়ে-

‘একদিন তাজউদ্দীন এসে বলল, শেখ মুজিব তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছে। দুদিন আমি বলেছি তোমাকে পাইনি এবার যদি একথা বলি আর বিশ্বাস করবে না। এই টেলিফোন নাম্বার রেখে গেলাম পারলে যোগাযোগ করো। তাজউদ্দীন যখন এতো করে বলেছে তখন শেখকে টেলিফোন না করে আর পারলাম না। টেলিফোন করতেই শেখের টিপ্পনি কাটা কথা। কিরে, বিপদে পড়েছিস বুঝি। বললাম বিপদে না পড়লে কী আর তোমাকে ফোন করেছি। বললেন, কোথায় আছিস? বললাম, আমার স্থায়ী ঠিকানা কিশোর মেডিক্যালে। শেখ বললেন, এখনই চলে আয়। বললাম কোথায়? বললেন সেক্রেটারিয়েটের পাশে ওখানে এলেই বুঝবি। সেক্রেটারিয়েটের কাছে যেতেই দেখি সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছে গাজী গোলাম মোস্তফা। একসাথে জেলে থেকেছি। বলল, ওস্তাদ, আপনারে নেবার জন্য বড় ওস্তাদ আমাকে পাঠিয়েছে। বললাম, চলো। সেক্রেটারিয়েটে ঢুকতে এক পুলিশ অফিসার আমার ব্যাগ চেক করতে চাইলে গাজী বলল, ব্যাটা আমার চাকরি খেতে চাস? চিনিস কে? আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিজে হাঁটতে শুরু করল। গাজীর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে পুলিশ অফিসার আমাদের সাথে এলো। তখন গাজী গোলাম মোস্তফাও বড় এক হোমরা-চোমরা নেতা, রেডক্রসের চেয়ারম্যান।

মুজিব সেক্রেটারিদের নিয়ে মিটিং করছিলেন। আমার আসার কথা শুনে সেক্রেটারিদের বললেন- আধা ঘণ্টার জন্য বিরতি, চা খান, আমার এক পুরনো বন্ধু এসেছে ওর সঙ্গে দেখা করে আসি। বহুদিন পরে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা। তিনি তখন জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী কত কী। কিন্তু শেখ মুজিব তেমনি আছেন। বললেন, কিরে তুই যে একবারও দেখা করতে এলি না ব্যাপার কী বলত? বললাম, আমার প্রয়োজন থাকলে তো আসব। জিজ্ঞেস করল কেমন আছি। বললাম, ভালো। তারও কুশল জিজ্ঞেস করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কিসের মিটিং চলছিল? বললেন, যারা শহীদ হয়েছে প্রত্যেককে দু’হাজার টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মিটিং। কত টাকা লাগবে জিজ্ঞেস করলে সেক্রেটারি বলল, আট কোটি টাকা। কিন্তু ইতোমধ্যে ৩০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। আরও ৩০ কোটি টাকা লাগবে। এখন যেখানে একজন মারা গেছে সেখানে নাকি বলছে পাঁচজন মারা গেছে। এখন এসব টাকা এমনিভাবে সব হাতিয়ে নিচ্ছে। অনেক কিছুই আলাপ হলো শেষে আমি বললাম, সামনে তো ইলেকশন অন্তত ভালো পঞ্চাশজন বিরোধীদলীয় সদস্যদের সংসদে আসতে দিও, ভালো হবে। শেখ তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন কিসের ভালো হবে বলতো? তুই কি আমার থেকে বাংলাদেশ বেশি চিনিস? আমি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছি, আমি সবগুলোকে চিনি। ওরা আমার কাছ থেকে গোপনে এসে টাকা নিয়ে যায়। টাকাও দেব, সিটও দেব তা কোনোদিন হয়? হয় সিট, নয় টাকা। আমি বললাম, তুমি যেটা ভালো বুঝবে করবে। আমার বলার ছিল বললাম।’

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

আরও খবর: গুলশান হামলায় বেঁচে যাওয়া ভারতীয় নাগরিক সাত প্রকাশের জবানবন্দি

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হেরে গেলেন নিপুণ, মিশা-ডিপজল প্যানেলের বড় চমক
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনহেরে গেলেন নিপুণ, মিশা-ডিপজল প্যানেলের বড় চমক
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ