X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

১৫ ও ২১ আগস্ট: এদেশের রাজনীতির অন্ধকার দু’টি দিন

মাসুদা ভাট্টি
২১ আগস্ট ২০১৬, ১৩:০৩আপডেট : ২১ আগস্ট ২০১৬, ২০:৩৬

মাসুদা ভাট্টি বাংলাদেশে কথাটি প্রায়ই শোনা যায়, বিশেষ করে রাজনীতির দর্শক যারা, তারাই বলে থাকেন মূলত কথাটি। কেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনও রাজনৈতিক সুসম্পর্ক নেই, কেন এক দলের নেতা আরেক দলের নেতার মুখদর্শন করেন না, সামান্য সৌজন্য বিনিময়ও করেন না, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। বলা বাহুল্য এ জন্য শেখ হাসিনার দিকেই দোষের পাল্লাটা ইচ্ছে করে খানিকটা ঝুঁকিয়ে দেন। তবে এর চেয়েও মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এবং শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে এক পাল্লায় ওজন করার ঠিকাদারও কিন্তু কম নেই। কিন্তু তাতে সত্য কি বদলাবে?  
আজ একুশে আগস্ট, এই লেখাটি যখন লিখছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এই দিনটির ভয়াবহতার নিন্দা করছেন। বলতে দ্বিধা নেই যে, এটি খুবই ইতিবাচক যে, বাংলাদেশে বহুলভাবে এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডের বিরুদ্ধে একটি সংগঠিত জনমত তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার বিপরীতেও কিছু মানুষ রয়েছে, যারা মনে করে যে, ২১ আগস্টে শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়াটা আসলে ঠিক হয়নি। একদল মানুষ এও বিশ্বাস করে যে, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগেরই কাজ। এই মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটা মানুষদের সম্পর্কে যত কম বলা যায়, ততটাই মঙ্গল। কিন্তু প্রশ্ন তুলতেই হয় যে, ২১ আগস্ট যদি সত্যিই ঘটতো তাহলে কী হতো? কিংবা তার আগে আরেকটা প্রশ্ন তোলা জরুরি যে, ২১ আগস্ট ঘটানোর পেছনে উদ্দেশ্য কী ছিল এবং কারা সেটা করেছিল?দশ বছরেরও অধিককাল পার হয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাস ও গতিপথ বদলে দিতে পারতো যে ঘটনা, সেটি ঘটেনি। ঈশ্বরে বিশ্বাসীরা স্বীকার করেন যে, একমাত্র ঈশ্বরই বাংলাদেশকে সেদিন বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এর মানে এই নয় যে, শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন বলে বাংলাদেশ রক্ষা পেয়েছে, কিন্তু একথা তো স্বীকার করতে হয় যে, সেদিন যদি সত্যি সত্যিই শেখ হাসিনা রক্ষা না পেতেন তাহলে আজ যে বাংলাদেশ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা হয়তো দেখতে পেতাম না। কারণ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে, তা আরও দীর্ঘায়িত হতো। তাতে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা এদেশের কপালে প্রায় জুটেই গিয়েছিল, আমরা সেখান থেকে ফিরে এসেছি।
তার চেয়েও বড় কথা হলো, এদেশে একটি রাজনৈতিক ধারা সম্পূর্ণ ভাবেই বিলীন হয়ে যেত, সেটি আর কিছুই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক ধারাটিই।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে যে চেষ্টাটির উদ্বোধন হয়েছিল ২১ আগস্টে সে প্রচেষ্টার দাঁড়ি টানার চেষ্টা হয়েছে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কেবল বঙ্গবন্ধু-শূন্যই হয়নি, পরিণত হয়েছে জ্ঞানহীন, মেধাহীন, সংস্কৃতিহীন, স্বাধীনতাহীন একটি উদ্ভট শাসন ও শোষণের দেশে, যেখানে হাতে অস্ত্র থাকলে ক্ষমতা দখল করা যায়, ক্ষমতায় বসে রাষ্ট্রের টাকায় রাজনৈতিক দল খোলা যায় এবং নির্বাচনের নামে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় যাওয়া যায় আর ধর্মকে ব্যবহার করা যায় যেমন ইচ্ছে তেমন। এরপর যদি ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে জেলের ভেতর নির্মম হত্যার শিকার হওয়া জাতীয় চার নেতার কথা বলেন, তাহলে বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশ সেদিন নেতৃত্বশূন্য হয়েছে এবং সেদিন জেলের ভেতর আসলে এদেশের রাজনীতিকেই হত্যা করা হয়েছে।


এরপর যারা এদেশে রাজানীতি করেছে তাদের অধিকাংশই মূলত খর্বাকায়, অমানুষের দল। কিন্তু শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতির নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর থেকে রাজনৈতিক মানুষের আকার একটু হলেও বদলাতে শুরু করে। একথা আমাদের জ্ঞানীগুণীজন কখনও স্বীকার করেন না। কিন্তু সত্য হলো, শেখ হাসিনা রাজনীতিতে আসার পরই একটু একটু করে রাজনীতি আবার সাধারণ মানুষের কাছে ফিরে আসতে শুরু করে, মানুষ একটু হলেও নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবতে শেখে। আর এটাই ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ওদের জন্য, যারা ২১ আগস্ট ঘটিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে, আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে রাজনীতিকে আবার ১৫ আগস্টের পরের জায়গায় নিয়ে গিয়ে সাধারণ মানুষের হাত থেকে রাজনীতি কেড়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করেছিল।
শেখ হাসিনার রাজনীতি নিয়ে অনেক সমালোচনা আমার নিজেরও রয়েছে, কিন্তু আজকে একথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা জরুরি যে, তার রাজনীতিতে ফিরে আসা বাংলাদেশের জন্য যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। নাহলে যে খর্বাকায় ও শোষণতন্ত্রের হাতে বাংলাদেশ বন্দি হয়ে পড়েছিল তাতে আজকে হয়তো এরকম কোনও লেখা আমার পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল না, হয়তো বাংলাদেশকে আজকে সত্যিই পাকিস্তানের পরিণতি বরণ করে নিতে হত। যেখানে ভয়ঙ্কর মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশ শাসনের ভার থাকতো অস্ত্রধারী, পেশিধারী আর কালো টাকার মালিকদের হাতে। মজার ব্যাপার হলো, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন বলেই কিন্তু খালেদা জিয়াকে বিএনপির নেতৃত্বে বসানো হয়েছিল। না হলে এই দলের নেতৃত্বও যেত লুটেরাদের হাতে। যাদের কথা আগেই বলেছি। এর পরবর্তী রাজনীতির দিকে তাকান, যে অধিকার শেখ হাসিনাকে রাজপথে নেমে, গুলি মাথায় নিয়ে, দলের মিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দেওয়ার মাধ্যমে এমনকি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার শিকার হয়ে অর্জন করতে হয়েছে, খালেদা জিয়া কোনও রকম আন্দোলন-সংগ্রাম না করেই তার ফল ভোগ করেছেন। সেদিক বিবেচনায় খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন ‘বাই ডিফল্ট’ নেত্রী। আমি বিশ্বাস করতে চাই না যে, খালেদা জিয়া ২১ আগস্ট হামলার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত। কিন্তু তার সরকারের আমলেই যেহেতু এই ঘটনা ঘটেছে, সেহেতু তিনি এর দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু ধরুন, যদি আমরা প্রশ্ন তুলি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াবহ ঘটনার মৌলিক সুবিধা আসলে কে পেয়েছে? তাহলে চোখ বুঁজে উত্তর আসবে- কেন, জেনারেল জিয়াউর রহমান ও তার পরিবার। আর তাইতো জেনারেল জিয়া খুনিদের কেবল আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া নয়, তাদের মাথায় করে রেখেছেন দীর্ঘদিন। সে ধারাবাহিকতা থেকে তার স্ত্রীও মুক্ত নন।
খালেদা জিয়া চাইলেই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কারণ, ততদিনে তার রাজনীতিতে এই খুনিদের আর কোনও প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু তিনি তা করেননি, উল্টো খুনিদের তিনি সংসদে নিয়ে গিয়েছেন, বসিয়েছেন নিজের পাশে, খুনিদের পরিবারকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সুযোগ ও সুবিধা। একুশে আগস্টের ঘটনাও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এই ঘটনা কেবল খালেদা জিয়ার শাসনামলে ঘটেছে তাই-ই নয়, এই ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে, এই ঘটনাকে বিতর্কিত করতে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন, যাকে আসলে অপব্যবহার বলাটাই সঙ্গত।
আবারও বলি, ২১ আগস্টে খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে বিশ্বাস করতে চাই না, কিন্তু অবিশ্বাসও বা করি কী করে? প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া এই ঘটনার শেকড় খুঁজে বের করতে পারতেন, চাইলেই। কিন্তু তিনি তা না করে সংসদে যখন তার দলীয় সাংসদরা শেখ হাসিনার ভ্যানিটি ব্যাগে গ্রেনেড খুঁজছেন, তিনি তখন মুচকি মুচকি হেসেছেন, তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নির্দেশে জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছে তিনি নিশ্চুপ থেকেছেন। আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রত্যক্ষভাবে যেমন জিয়াউর রহমান উপকৃত হয়েছেন, তেমনই শেখ হাসিনার কিছু হলে খালেদা জিয়া উপকৃত হবেন, এমনটাই তিনি বিশ্বাস করেছেন হয়তো। আজ যখন একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তখন অনেক সত্যই উন্মোচিত হচ্ছে এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, জেনারেল জিয়ার সুযোগ্য পুত্র তারেক রহমান এই হামলার পেছনে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন। এখনও যেহেতু বিচারকার্যটি প্রক্রিয়াধীন, তাই এ বিষয়ে মন্তব্য না করি। কিন্তু যে কথাটি বলতে চাই তা হলো- আমাদের কি এখনও একথা বুঝতে বাকি আছে যে, ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট আসলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় দু’টি কালো অধ্যায় এবং এই কালো অধ্যায় দুটি আসলে এদেশের রাজনীতির নিয়ামক?
পঁচাত্তরের পর একুশ বছর আমাদের দেশের রাজনীতির বলতে গেলে ‘আইয়্যামে জাহিলিয়া’র কারণ এই সময়ে কোনওভাবেই এদেশের গণমানুষের রাজনীতি ছিল না। জোর করে ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কাউকে রাজনীতির বাইরে রাখাটা কখনোই শুভকর হতে পারে না। অনেকেই বলবেন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই রাজনীতির আলোকিত যুগ হয়? না, সেকথা মোটেও বলছি না, বরং আগেই বলেছি যে, শেখ হাসিনার রাজনীতি নিয়ে অনেক সমালোচনাই আমার রয়েছে কিন্তু একথা বিশ্বাস করি যে, এদেশে গণমানুষের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার অবদান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই, সেদিক দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি গণমানুষকে সত্যিকার অর্থেই ক্ষমতাবান করে। এর উল্টোটা ঘটে যখন রাজনীতি আওয়ামী লীগের বাইরে চলে যায়। এমনকি আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলেও দেশে রাজনীতি থাকে, কারণ আওয়ামী লীগের আমলে ১৫ আগস্ট বা ২১ আগস্টের মতো ভয়ঙ্কর কোনও ঘটনা ঘটানো হয় না রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে তাকে শিকার হতে হয় ২১ আগস্টের মতো ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার।
এদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামীবিরোধী রাজনীতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এখানেই। এই মৌলিক পার্থক্যটুকু বুঝতে আমাদের অনেকেরই কষ্ট হয়। কিন্তু তাতে সত্যটা বদলায় না কোনওভাবেই। আমি জানি, আমার এই লেখার অনেক সমালোচনা আছে কিন্তু কেউ কি এই পার্থক্যের বিষয়টির বিপরীতে কোনও সত্য আমাকে বলতে পারবেন? পারবেন না। একপক্ষ আরেকপক্ষকে ক্ষমতা থাকতে হত্যা করতে চাইবে, ক্ষমতার বাইরে থাকলেও নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইবেন তারপরও আরেক পক্ষকে হাসিমুখে তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে হবে, রাজনীতি করতে হবে- এই আব্দার একটু ‘মামাবাড়িরই’ হয়ে গেলো না? যতদিন অবধি না এদেশে ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্টের করা পাপের জন্য একটি পক্ষ নিঃশর্ত ক্ষমা চাইবে, যতদিন না তারা উপলব্ধি করবে যে, এদেশে রাজনীতি করতে হলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতে হবে অবৈধ ও ষড়যন্ত্র করে কাউকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা আসলে গণতান্ত্রিক রাজনীতি হতে পারে না, ততদিন এদেশের রাজনীতি আসলে মোটা দাগেই বিভক্ত থাকবে। তার মধ্যে সবচেয়ে কালো দাগ দু’টি হবে ১৫ ও ২১ আগস্ট।

লেখক: কলামিস্ট

[email protected]

লেখক: মুফতি হান্নানের জবানিতে হামলা: ​টার্গেট শেখ হাসিনা, ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে দফায় দফায় সভা

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ