X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

কিছু মিডিয়া মানুষকে বোকা বানাবার চেষ্টা করে

তসলিমা নাসরিন
২২ আগস্ট ২০১৬, ১১:৫৭আপডেট : ২২ আগস্ট ২০১৬, ১২:২২

তসলিমা নাসরিন কিছু কিছু মিডিয়া মানুষকে জেনেশুনে বোকা বানাবার চেষ্টা করে। তারা কিন্তু সফলও  হয়, মানুষকে বোকা বানায়ও। কিছুদিন আগে হাসনাত, রোহান আর তাহমিদের ছবি ছাপিয়েও যে বলার চেষ্টা করেছে তাহমিদ নির্দোষ, হাসনাতও নির্দোষ –ওদের বডি ল্যাংগোয়েজ প্রমাণ করে ওরা নির্দোষ --- তাহমিদ ভালো ছেলে, লক্ষ্মী ছেলে ---এসব কি মানুষকে বোকা বানাবার জন্য নয়? তাহমিদের হাতে ছিল অস্ত্র। ওই অস্ত্র নাকি জঙ্গিরা তাকে দিয়েছে ধরার জন্য, ভেতরের গুলি নাকি বের করেই ওটা দিয়েছিল। তাহমিদের বলা কথাগুলোকে বেশ হাইলাইট করা হয়েছিল। কারণ, বোকা বানাবার চেষ্টা করা হয়েছিল। মিডিয়ার কিছু লোক সত্যি সত্যি ভাবে পাবলিককে যা খাওয়ানো হবে তাই খাবে, আম জনতা জাস্ট ভেড়ার পাল ছাড়া কিছু নয়।
কিন্তু আম জনতার মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে। কোনও জঙ্গি কি কোনও জিম্মির হাতে অস্ত্র দেয়? আম জনতা এর  উত্তর জানে। উত্তর হচ্ছে, দেয় না। পিস্তল থেকে বুলেট নাকি বের করে নেওয়া হয়েছিল। যদি বুলেটই বের করে নিয়ে থাকে তবে তাহমিদের হাতে ওই পিস্তলটি দেওয়ার প্রয়োজন কী ছিল? ওতে যদি বুলেটই না থাকে, তাহলে তাহমিদ পিস্তলটিকে ওভাবে এক হাতে ধরে, আরেক হাতে গার্ড দিয়ে রেখেছিল কেন? নিচের দিকে মুখ করে রেখেছিল, যেন অসতর্ক অবস্থায় গুলি বেরিয়ে না যায়। এ তো দুধের শিশুও বুঝতে পারে। শরীরী ভাষা বোঝার জন্য ইন্ডিয়া ফোর্ডকে আনা হয়েছে! তাদের বর্ণনায়, মাথায় সামান্য ঘিলু আছে, এমন যে কেউ বুঝবে যে যথেষ্ট গোঁজামিল আছে। আমরা সাধারণ পাবলিক কি বুঝতে পারিনি ছাদে দাঁড়িয়ে পেছনে দু’হাত রেখে আয়েশি ভঙ্গিতে আলাপরত জঙ্গি রোহান পিস্তল হাতের তাহমিদ আর হাসনাতকে মোটেও জিম্মি বলে ভাবছিল না, নিজেদের লোক বলে ভাবছিল?
আসলে গুলশানের ঘটনাটায় জিম্মি বলে কেউ ছিল না। জিম্মি তখনই মানুষকে করা হয়, যখন কিছুর দাবি করা হয়। দাবি না মানা হলে জিম্মিগুলোকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। জঙ্গিরা সত্যিকার অর্থে কোনও কিছুর দাবি জানাতে যায়নি রেস্তোরাঁয়। গিয়েছিল মানুষ খুন করতে। রেস্তোরাঁয় ঢোকার আধঘণ্টার মধ্যেই নাকি সব খুন টুন সেরে নিয়েছে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলে পালিয়ে যেত। শেষ অবধি বেঁচে থেকে দেখছিল কী হয়। নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছিল, পুলিশ যখন ঘিরে আছে, মৃত্যু ছাড়া গতি নেই, জান্নাতে যাচ্ছে নিশ্চিতই ছিল, জান্নাতে যাওয়ার আগে কিছু ভালো খাওয়া-দাওয়াও সেরে নিয়েছিল। রীতিমত চিংড়ির মালাইকারি!
মুসলমান আর বাংলাদেশি হলে ওরা মারবে না বলেছিল। তবে ফারাজ, ইসরাত আর আম্বিতাকে কুপিয়ে মারলো কেন? এরা তো বাংলাদেশিও ছিল, মুসলমানও ছিল। মাথা ঢাকাটা বড় ব্যাপার ছিল হয়তো! মাথা ঢাকার জন্য দুটো কাপড় জোগাড় করতে পারতো নিশ্চয়ই। ফারাজের তো মাথা ঢাকার ব্যাপার ছিল না। ফারাজ তো নিশ্চয়ই দু’তিনটে সুরাও মুখস্ত বলতে পারতো, ফারাজকে মারলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তরও মিডিয়া এভাবে দিয়েছে যে মুক্তি পাওয়ার পরও ফারাজ তার দুই বান্ধবীকে না নিয়ে বেরোতে চায়নি বলে বেরোয়নি। মেয়ে দুজনের সঙ্গে ফারাজকেও তাই খুন করেছে জঙ্গিরা। আমরা ফারাজকে হিরোর আসনে বসিয়েছি। কিন্তু সে যে হিরো, এর আরও কিছু প্রমাণ চাই। মিডিয়া বলেছে বলেই কেন মেনে নিতে হবে আমাদের? সুযোগ পেয়েও মৃত্যুর গুহা থেকে বের হয় না, এমন মানুষ পৃথিবীতে প্রায় নেই বললেই চলে।

হাসনাত আর তাহমিদকে কোনও বাহিনীই উদ্ধার করেনি। ওদের বাঁচিয়ে দিয়েছে জঙ্গিরা। জঙ্গিদের মিত্র বলেই বাঁচিয়েছে। পরবর্তী জঙ্গি হামলা পরিচালনা করার জন্যই হয়তো বাঁচিয়েছে। 

হাসনাত আর তাহমিদ যে নিজেরাই জঙ্গি, তা আমরা সাধারণ মানুষরা বুঝতে পারছি কিন্তু বিশেষজ্ঞরা পারছেন না। ওদের নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য কত ছল চাতুরীর আশ্রয়ই না নেওয়া হয়েছে। শক্তিমান অনেকেই নেপথ্যে কাজ করছে। ‘ফ্রি তাহমিদ’ ফ্যান পেজের চেয়েও অনেক শক্তিমান। কোরিয়ান লোকটির করা ভিডিও আর যুগান্তরে ছাপা হওয়া হলি আর্টিজানের প্রতিবেশি কারও তোলা ছবি না পেলে হয়তো হাসনাত আর তাহমিদকে হিরো হিসেবে ট্রিট করা হতো। বুদ্ধি করে, স্ট্রাগল করে জঙ্গিদের কবল থেকে বেঁচেছে, এ কী চাট্টিখানি কথা! জনগণ ফুলের মালা দিতো।

ইন্ডিয়া ফোর্ড নামের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এক্সপার্ট যে মিথ্যে বলছে, তা কমন সেন্স আছে এমন যে কেউ বুঝতে পারে। শেষ অবধি প্রমাণ হলো যে হাসনাতই সে-রাতে জঙ্গিকাণ্ড পরিচালনা করেছে। হাসনাতই ম্যাসেজ করেছিল নিবরাসকে হোলি আর্টিজানে রাত আটটার দিকে দলবল নিয়ে চলে আসতে। আমি ভাবছি, একটা লোক কী করে তার স্ত্রী সন্তানের সামনে এতগুলো খুন পরিচালনা করলো। শুধু গুলি করে মেরেই যেখানে শান্ত হয়নি, জবাই করেছে সবাইকে। স্ত্রী সন্তানের চোখের সামনেই সব করেছে সে। হাসনাত তার স্ত্রী সন্তানকেও জঙ্গি বানাতে চায়, আইসিসের সবচেয়ে বর্বর নেতাও হয়তো হাসনাতের মতো এত বর্বর নয়। আর হাসনাতের বাপ, যে দুদিন পর পর হাসনাত নির্দোষ হাসনাত নির্দোষ বলে ‘ঘেউ ঘেউ’ করে, ওকে ধরা যায় না? ও ব্যাটাই হয়তো ইন্ডিয়া ফোর্ডকে টাকা খাইয়েছে ভুল রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। তাহমিদের বাপ তো তাহমিদকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য দিকে দিকে টাকা ঢালছে। তাহমিদ গিটার বাজাচ্ছে, গান গাইচ্ছে এমন ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যেন কেউ গান গাইলে জঙ্গি হতে পারে না! হাসনাতের স্ত্রী তো খুনের সাক্ষী হয়েও হাসনাতকে নির্দোষ বলেছে। ওকেও তো জেলে ভরা উচিত। ও জেলের বাইরে থেকে আরেকটা হলি আর্টিজান ঘটিয়ে ফেলতে পারে। ট্রেইনিং তো পেয়ে গেছে সে রাতে।

অনেকে বলছে, হাসনাত আর তাহমিদ জঙ্গি বটে, কিন্তু এদের হাতে টাকা আছে, অনেক ক্ষমতাবান লোক এদের বন্ধু, স্বজন। এরা জেলে গেলে দু’দিন পর বেরিয়ে আসবে। যদি এরা বেরিয়ে আসে, তাহলে দেশ নিয়ে যে ক্ষীণতম আশা জেগেছে, সেটিও মুখ থুবড়ে পড়বে। সরকার জঙ্গি দমনে খুব সামান্য হলেও সম্প্রতি তৎপর হয়েছে, এটি যেন শুরুতেই শেষ না হয়ে যায়। জঙ্গি নেই, এমন একটি দেশে সবাই বাস করতে চায় জানি। সকলে নিরাপত্তা চায়। ভোটের জন্য দেশের সরকার এতকাল ইসলামকে ব্যবহার করেছে, মুসলিম মৌলবাদকে আস্কারা দিয়েছে। এবার জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিলে দেশটা ধ্বংস হতে কিছু আর বাকি থাকবে না। ধ্বংসস্তূপের ওপর গদি রেখে বসলে খুব কি আরাম পাওয়া যায়? যদি পাওয়া যায়, তবে বলবো, এও ঠিক জঙ্গিদের মতোই, রক্তাক্ত লাশের ওপর মাছ ভাত খেয়ে তৃপ্তি হওয়ার মতই।

লেখক: কলামিস্ট

আরও খবর: ‘সব শেষ করেছি, কিছু আর বাকি নাই’

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ