X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

তুরস্কে আইএসের ১২ বছরের শিশুবোমা!

চিররঞ্জন সরকার
২৫ আগস্ট ২০১৬, ১৩:৫৮আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০১৬, ১৪:০১

চিররঞ্জননিজেকে প্রাণদণ্ড দিতে প্রস্তুত, তাকে কারাদণ্ডের আদেশ শুনিয়ে কী লাভ? প্রশ্নটি বহু দিনের। তালেবান, আইএস, আল শাবাব, বোকো হারাম, আলকায়েদা প্রভৃতি জঙ্গিগোষ্ঠীর লাগার আত্মঘাতী তৎপরতা প্রশ্নটিকে অনেক বড় করে তুলেছে। সম্প্রতি তুরস্কে জঙ্গি সংগঠন আইএসের বর্বরতায় আবারও বিশ্ববাসী হতচকিত হয়ে পড়েছে! ১২ বছরের এক শিশুই মানববোমা। কুর্দিদের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ৫১ জনের প্রাণ নিয়েছে সে। তুরস্কের এই ঘটনার পেছনে ইসলামিক স্টেটের দিকে আঙুল তুলেছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি জানিয়েছেন, হয় সে নিজেই বোমাটি ফাটিয়েছে, নয়তো অন্য কেউ তার গায়ের বোমাটি রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে ফাটিয়েছে।
তুরস্কে কুর্দিদের বিরুদ্ধে আইএসের বিরাট ক্ষোভ। কারণ তারা আইএসের বিরুদ্ধে লড়ছে। তাই কুর্দি পরিবারের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়ে আইএস প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে। এই বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। বর ও কনে-সহ আহত হন ৯৪ জন। এরদোয়ান হামলাকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যারা হামলা করেছে তাদেরকে আমরা একটাই কথা বলতে চাই-তোমরা কখনও সফল হবে না।’ কিন্তু সত্যিই কী তাই? আইএস তো হামলা চালিয়েই যাচ্ছে। নিরীহ মানুষের রক্তে তাদের ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অলীক স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বীভৎস হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে। কিশোর-যুবরা এতদিন তাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল, এখন শিশুদেরও তারা ব্যবহার করছে তাদের পৈশাচিক মারণযন্ত্রে! আর কত রক্ত আর মৃত্যুর পর আমরা বলতে পারব, আইএস সফল নয়?
এখন তো খবর মানেই যেন আইএস৷ কোনোদিন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য, কোনোদিন হয়তো ইরাক বা সিরিয়ায় কোনও অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য। আইএস বিখ্যাত হয়ে উঠেছে মূলত নিষ্ঠুরতার জন্য। শত্রুপক্ষ এবং নিরীহ মানুষের মনে আতংক ছড়াতে তারা এমন বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে যা আগে কেউ করেনি। জবাই করে ভিডিও প্রচার, পুড়িয়ে মারা, বাবার সামনে মেয়েকে জবাই করা এবং তার তার ভিডিও প্রচার, মেয়েদের যৌনদাসী বানানো আর পণ্যের মতো বিক্রি করা – এসব নিয়মিতভাবেই করছে আইএস। আইএস এখন আর শুধু সিরিয়া, তুরস্ক বা ইরাকেই সক্রিয় নয়। তারা পরিণত হয়েছে এক ভ্রান্ত-মতাদর্শে। একটি বিশ্বাসে। বিশ্বের অন্যান্য ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলো থেকে তারা এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়। নাইজেরিয়ার জঙ্গি সংগঠন বোকো হারাম কয়েকদিন আগেই জানিয়েছে, আইএস-কে তারা সমর্থন করে। দুটি সংগঠনের মধ্যে একটি জায়গায় মিলও আছে। আইএস-এর মতো বোকো হারামও নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতার প্রতিভূ হয়ে উঠেছে। অন্য ধর্মের নারী ও শিশুদের প্রতি দুটি সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণই মধ্যযুগীয়।
তাদের কর্মকাণ্ড আর চরিত্র এতই বিচিত্র যে ‘গেলাম আর বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে চলে এলাম’ করলেই তাকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। এই রক্তবীজের জন্মান্তর ঘটছে পুনঃপুনঃ, একটা দেশে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে অনতিবিলম্বে ফের আর একটা দেশে আর একটা নামে তার জন্ম হচ্ছে।
তা হলে আইএস ব্যাপারটা আদতে কী? এক এক জায়গায় এক এক রকম। সিরিয়া কিংবা ইরাকের একটা বড়ো অংশে তারা সামরিক শক্তি এবং আধা-রাষ্ট্র। উত্তর আফ্রিকা কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটি একাধিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সমষ্টি, যেমন আফ্রিকায় বোকো হারাম, পূর্ব আফ্রিকার একাংশে আল-শাবাব, মিশরে সিনাই জঙ্গি-বাহিনী। ইউরোপ ও আমেরিকায়, যেখানে আইএস-এর শারীরিক অবয়ব নেই সেখানে এটি এমন একটি চরমপন্থী মতাদর্শ যার অমোঘ আকর্ষণে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে পশ্চিমি জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য হেলায় বিসর্জন দিয়ে জীবন পণ করতে চলেছে সিরিয়ায়, অনেকেই আবার বিধর্মীদের সবক শেখানোর মন্ত্রগুলোর শপথ নিয়ে ফিরে এসে ঘটাচ্ছে প্যারিস কিংবা গুলশানের মতো নরসংহার।  

বোমা-বর্ষণ করে সিরিয়া বা ইরাকে আইএস-এর সামরিক প্রতিপত্তির ক্ষতিসাধন কি সম্ভব? তার পর? গেরিলারা মিশে যাচ্ছে জনতার মধ্যে, লাগাতার বোমা-বর্ষণের ফলে যে কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ হচ্ছে তাতে বিপন্নতা ও অসহায়তা আরও বাড়ছে সাধারণ মানুষের, নিরাপত্তার খোঁজে নতুন করে আরও হাজার মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে শরণার্থী হচ্ছেন, তাদের একটা অংশ আসতে চাইছেন ইউরোপে। তাতে আখেরে কার লাভ? আইএস-এরই নয় কি?

আইএস সমস্যাটি এখন একটি জটিল রূপ নিয়েছে। আঞ্চলিক রেষারেষি ও স্বার্থ আইএসকে বিকশিত হতে সাহায্য করছে। যেমন ইরানের ভূমিকা। শিয়া-প্রধান এই দেশটির একমাত্র লক্ষ্য যেন তেন প্রকারে দামাস্কাস ও বাগদাদে ক্ষমতাসীন শাসকদের মদত দিয়ে যাওয়া, আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার ততটা তাগিদ তেহরানের নেই। ইরানের জাতশত্রু সৌদি আরব ইচ্ছে করলে আইএস-এর বিরুদ্ধে সুন্নিদের সঙ্ঘবদ্ধ করতে পারে কিন্তু তাতে যদি আখেরে ইরানের লাভ হয় সে কাজ তারা করবে না। লেবাননের প্রভাবশালী হেজবুল্লা নিজে থেকে কিছু করবে না, তারা চেয়ে থাকবে তেহরানের সংকেতের দিকে।  

উত্তর ইরাক বা সিরিয়ায় এ পর্যন্ত কেউ যদি আইএস-এর বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াই চালিয়ে গিয়ে থাকে তা হচ্ছে কুর্দিরা। কিন্তু তুর্কিদের সঙ্গে তাদের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ছদ্মবেশে তুরস্ক ইতিমধ্যেই কুর্দি প্রভাবিত অঞ্চলে বোমা বর্ষণ করেছে, কিছুতেই তারা জাতশত্রুদের মাথা চাড়া দিতে দেবে না৷ অতএব, কার বাবার সাধ্য এমত প্রতিবেশীদের দুই হাত এক করেন?

সিরিয় সমস্যার মাথায় পূজার থালায় নৈবেদ্যের কলার মতো বসে আছেন বাশার আল আসাদ, স্বৈরাচার আর নিরীহ নাগরিকদের ওপর বর্বরতম আক্রমণের প্রশ্নে যিনি সাদ্দাম হোসেনের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন অনেক আগে। এখন এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে তার বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া স্বতঃস্ফূর্ত জনমতকে দমন করতে আসাদ শুধু যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন তাই নয়, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলবেন বলে আইএসকে মদতও দিয়ে যাচ্ছেন আগাগোড়া। আইএস-এর সামরিক অভিযানে সিরিয়ায় বিমান বাহিনী এয়ার কভার দিয়ে সাহায্য করেছে, এমনকী আইএস-এর কাছ থেকে তেল কিনে তাদের আর্থিক ভাবেও সহযোগিতা করেছেন আসাদ। আসাদের মতো ‘মূর্তিমান শয়তান’কে ক্ষমতায় রেখে সিরিয় সমস্যার স্থায়ী সমাধান কি সম্ভব?

কিন্তু তার মুরুব্বির জোর সাংঘাতিক। এক দিকে ইরান অন্য দিকে খোদ পুতিনের রাশিয়া। নিজের দেশের বাইরে একমাত্র আসাদের সিরিয়াতেই এখনও পর্যন্ত সামরিক ঘাঁটি আছে মস্কোর, ভ্লাদিমির পুতিন কোনও অবস্থাতেই সেই সবেধন নীলমণিকে হারাতে চান না। আইএস অংকে ভুল করে যাত্রীবাহী রুশ বিমানে বিস্ফোরণ ঘটানোর পরে প্রাক্তন কেজিবি-প্রধানের চোয়াল শক্ত হয়েছে কিছুটা, কিন্তু সিরিয়ার প্রধান খলনায়ক সম্পর্কে তার দুর্বলতায় কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি। ইসলামিক স্টেট-এর পাশে আসাদ প্রশাসনকে তুলনায় কম দানবীয় মনে হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু দানব তো উভয়েই।

ওদিকে তুরস্কে আমেরিকার ভূমিকা শেষ পর্যন্ত আইএসকেই সুবিধা করে দিচ্ছে। আমেরিকা আপাতত আরেক স্বৈরাচারী এরদোয়ানকে চটানোর রাস্তায় হাঁটবে না। কারণ এরদোয়ান খেপলে তুরস্কের যে বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে সিরিয়ায় আইএস বিরোধী অভিযান চালাচ্ছে আমেরিকা, সেই ইনসিরলিঙ্ক বিমানঘাঁটিও আমেরিকার নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে।

এই ঘাঁটিটি আমেরিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে মাটির নিচে বিমানের হ্যাঙ্গারে ‘স্পেশাল ওয়েপন’ বা প্রায় ৯০টি মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র মজুত রয়েছে। ১২ ফুট লম্বা বোমাগুলোর ওজন ৭০০ পাউন্ডের মতো। এই ধরনের বোমা বহন করার জন্য ইনসিরলিঙ্কে এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন, এফ-১৫ই এবং এফ/এ-১৮ হর্নেট যুদ্ধবিমানও রয়েছে।

রাশিয়াকে ‘জব্দ’ করতে এই ঘাঁটিটি সক্রিয় রাখা চাই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও রাশিয়ার পেশিশক্তি যে এখনও কতটা, তার ক্রিমিয়ায় প্রমাণিত হচ্ছে। চেচনিয়া এবং জর্জিয়া সে প্রমাণ আগেই পেয়েছে। সিরিয়ার হয়েও রণাঙ্গনে নেমেছে রাশিয়া। ফলে ন্যাটো তথা আমেরিকার কাছে তুরস্কের ইনসিরলিঙ্ক ঘাঁটি কৌশলগত ভাবে এখনও গুরুত্বপূর্ণ।

ইনসিরলিঙ্ক আমেরিকার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা এরদোয়ান জানেন। জানেন বলেই এতটা বেপরোয়া। এরদোয়ান বুঝে গেছে, ইনসিরলিঙ্ক বিমানঘাঁটির নিরাপত্তার স্বার্থেই আমেরিকা তাকে সমর্থন যুগিয়েই যাবে। এরদোয়ানের ‘নরম মৌলবাদ’ এই জঙ্গি সংগঠনগুলোকে শিকড় ছড়াতে সাহায্য করেছে। সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়াতে স্বাভাবিক কারণেই আইএস উল্লাস প্রকাশ করেছে। কারণ তারা জানে মুখে যাই বলুক, এরদোয়ানের ক্ষমতায় থাকা তাদের জন্য বিরাট আশীর্বাদ। তুরস্কে আমেরিকার এই কৌশলগত ভূমিকা এরদোয়ান ও আইএসকেই শক্তিশালী করছে। 

এই যখন রাজনৈতিক হিসেবে-নিকেশ, তখন আইএস অসফল হবে কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায়? এখন শিশুরাও যদি আইএসের মানববোমা হয়, তাহলে শংকিত ও ভীত হওয়া ছাড়া আমাদের কী করার আছে? পরিত্রাণের পথ কোথায়?

লেখক: কলামিস্ট

আরও খবর: জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে সিরিয়ান বন্ধুরা

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউআইইউতে ‘বাংলাদেশের সংবিধান এবং এর শাসন কাঠামো’ শীর্ষক লেকচার অনুষ্ঠিত
ইউআইইউতে ‘বাংলাদেশের সংবিধান এবং এর শাসন কাঠামো’ শীর্ষক লেকচার অনুষ্ঠিত
পাট শিল্পের উন্নয়নে জুট কাউন্সিল গঠন করা হবে
পাট শিল্পের উন্নয়নে জুট কাউন্সিল গঠন করা হবে
ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টা মামলায় মাদ্রাসাশিক্ষকের ১০ বছরের কারাদণ্ড
ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টা মামলায় মাদ্রাসাশিক্ষকের ১০ বছরের কারাদণ্ড
রেসিপি: মসুরের ডাল দিয়ে হাতে মাখা পুঁই শাক
রেসিপি: মসুরের ডাল দিয়ে হাতে মাখা পুঁই শাক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ