X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

কেরিকে নিয়ে আমার সংশয়

হারুন উর রশীদ
৩০ আগস্ট ২০১৬, ১৫:৪৬আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০১৬, ১৯:১৭

হারুন উর রশীদ আমি সোমবার সারাদিন দারুন খুশি ছিলাম। যাকে বলে গোলাপী পাখায় উড়ে বেড়ানো। এক একটি ঘটনা শুনছি আর বলছি বাহ! ফেসবুকে খবরগুলো শেয়ার করছি। টুইটারে ঢুকে দেখছি, আসলেই কি কেরি এসব কথা বলেছেন!
আমি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির একদিনের ঢাকা সফর নিয়ে বলছি। ২০১২ সালে এসেছিলেন আরেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। এখন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে লড়ছেন। এবার এলেন কেরি, নির্বাচনের আগে। এই সফরের সঙ্গে মার্কিন নির্বাচনের কোনও সম্পর্ক হয়তো নেই। তবুও সম্পর্ক খুঁজতে চাইলেতো দোষের কিছু নেই।
কেরি তার ঢাকা সফর শুরু করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে। সেখানে তিনি ২০ মিনিট অবস্থান করেন। আর সেই পরিদর্শনে আলোচিত বিষয় হলো পরিদর্শন বইয়ে তার মন্তব্য। আমার মনে হয় তার এই মন্তব্য সবকিছুকে ছাপিয়ে আলোচনার শীর্ষে চলে গেছে। তিনি তার চমৎকার হাতের লেখায় লিখেছেন- What a tragedy to have such brilliant and courageous leadership stolen from the people of Bangladesh in such a moment of violence and cowardice. But today, Bangladesh is growing in the vision of Bangabandhu and under the strong leadership of his daughter. The United States is proud to be a friend and strong supporter of the fulfillment of his vision. We look forward for growing and working together for the peace and prosperity.--- Warm Regards Jhon F. Kerry
যার বাংলা করলে দাঁড়ায়- ‘সহিংস ও কাপুরুষোচিতভাবে বাংলাদেশের জনগণের মাঝ থেকে এমন প্রতিভাবান ও সাহসী নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়া কী যে মর্মান্তিক ঘটনা। তারপরও বাংলাদেশ এখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে, তারই কন্যার নেতৃত্বে। যুক্তরাষ্ট্র তার সেই স্বপ্নপূরণে বন্ধু ও সমর্থক হতে পেরে গর্ববোধ করে। আমরা এখন এ সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে চাই এবং শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা যৌথভাবে কাজ করছি।’

পরিদর্শন বইয়ে কেরির লেখা মন্তব্য

আমি বিশ্বাস করতে চাই কেরি যে আবেগ আর মমতায় পরিদর্শন বইয়ে ৭৮টি শব্দ লিখেছেন তা বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্থপতি এবং বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি তার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা থেকেই উৎসারিত। আর এই শব্দ ক’টি কোনও আগোছালো বা হঠাৎ মনে আসা কোনও কথা বলে আমার মনে হয়নি। এটা আগে থেকে হোমওয়ার্ক করেই লেখা। আগে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া একটি সুচিন্তিত মন্তব্য। মাত্র ৭৮টি শব্দে তাই সম্ভব কেরি অনেক কিছু একসঙ্গে বলতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড তার স্বপ্ন এবং তার স্বপ্নের বাস্তবায়নের আগুয়ান বঙ্গবন্ধু কন্যার বাংলাদেশের বন্ধু হতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

একদিনের সফরে কেরি প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বিএনপি’র চেয়ারপারসনের সঙ্গে বৈঠক এবং সাক্ষাৎ করেছেন।  তা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। অনেকেই আলোচনা করছেন এবং করবেন। আলোচনা হবে ঢাকা-ওয়াশিংটন ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের রোডম্যাপ নিয়ে। আমি সেই আলোচনায় এখানে যেতে চাই না। চাইলেও তা হয়তো সামান্য। কিন্তু এবার আমি কেরি’র দুটি টুইট বার্তা নিয়ে কথা বলতে চাই।

কেরি সোমবার দুপুরের শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর প্রথম টুইটটি করেন ২ টা ২৮ মিনিটে। শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ-এর ছবি পোস্ট করে লেখেন,  ‘বাংলাদেশের অসাধারণ অগ্রগতির ইতিহাস রয়েছে। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আনন্দিত’। (#Bangladesh has an extraordinary development story. Pleased to meet w/ PM Sheikh Hasina today.)

এর মাত্র ২৮ মিনিট পর কেরি আরেকটি টুইট করেন। তাতে লেখেন, ‘নিরাপত্তা ইস্যু ও চরমপন্থী সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের দৃঢ় সহযোগিতা নিয়ে আজ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। (Important discussions today in #Bangladesh incl. on security issues & our strong support in fighting against violent extremism.)

কেরি অবশ্য বাংলাদেশ নিয়ে আরও একটি টুইট করেছেন বাংলাদেশ ছাড়ার পর। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে দেড় কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারেন। এ সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ও ক্লিন এনার্জি নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। (By 2050, 15 million Bangladeshis could be displaced by #climatechange. US & Bangladesh committed to resiliency and clean energy future.)

ঢাকায় অবস্থানকালে কেরির প্রথম দু’টি টুইটে স্পষ্ট যে- তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার প্রশংসা করেছেন। আর বাংলাদেশ জঙ্গি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে লড়াই করছে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ব্যাপক। তারা সহযোগিতা করতে চায়। তবে ঢাকা ছাড়ার পর তৃতীয় টুইটে তিনি এক ভয়াবহ আশংকার কথা জানিয়েছেন। জানিয়েছেন ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের দেড় কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হওয়ার আশংকার কথা। আর এখানে তিনি ক্লিন এনার্জি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার আশাও প্রকাশ করেছেন। ক্লিন এনার্জি হলো নবায়নযোগ্য শক্তি। সাধারণভাবে কয়লা বা তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ নয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কেরির সাক্ষাৎ

তাহলে এবার পেছন থেকে শুরু করি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আমাদের জানা। তারা চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তারা মেনে নিতে চায়নি। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকেও তারা তখন গ্রহণ করতে পারেনি। তাইতো সেই সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে অভিহিত করেছেন,‘ তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তার জন্যও দায়ী করা হয় যুক্তরাষ্ট্রকে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে বলে মনে করা হয়। শুধু মনে করা নয় এরই মধ্যে প্রকাশিত নানা দলিলপত্রেও তা স্পষ্ট হয়েছে। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজসহ অনেক সাংবাদিক ও গবেষক অবশ্য বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনায় মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) সম্পৃক্ত ছিল বলে দাবি করেছেন।

দলিলপত্রে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার ব্যাপারে কিসিঞ্জার আগেই জানতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ওয়াশিংটন সময় সকাল ৮টায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়ে স্টাফ সভায় বসেন। ঢাকার খবর জানার জন্য উদগ্রীব কিসিঞ্জার বৈঠকের শুরুতেই বলেন, ‘আমরা এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা বলবো।’ নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন সভায় বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে বলেন, ‘এটা হচ্ছে সুপরিকল্পিত ও নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করা অভ্যুত্থান।’ কিসিঞ্জার জানতে চান, ‘মুজিবুর কি জীবিত না মৃত?’ আথারটন বলেন, ‘মুজিব মৃত’।

আর এই সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেছিলেন। গত ২৯ এপ্রিল সংসদে এই কথা জানিয়েছেন সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তিনি সংসদে বলেন, ‘‘এই জন কেরি, যখন কাদের মোল্লার ফাঁসি হয় তখনও প্রধানমন্ত্রীকে ফোন দিয়ে বলেছিলেন, ‘ফাঁসি না দিয়ে পারা যায় না?’ আমার দেশে গণহত্যা করেছে, তাদের সমর্থনে সুপারিশ করে- এরা কারা? এদের একাত্তরের ভূমিকা মাথায় রেখে জনগণ যেন বিভ্রান্ত না হয়।’’

তিনি আরও বলেন, ‘আজ জন কেরি যে কথা বলে, সেই বিএনপি-জামায়াত একই কথা বলে। জন কেরি আমাদের শিক্ষা দেয়, শেখ হাসিনাকে ফোন করে। ’

‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময়, বিশ্বের জঘন্যতম ওই হত্যাকাণ্ড যেখানে মা-শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল নির্মমভাবে; তখন জন কেরিরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অবৈধ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশে খুনের রাজনীতির ইন্ধন দিয়েছিল।’

তবে সোমবার একদিনের বাংলাদেশ সফরে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কোনও কথা বলেছেন বলে জানা যায়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেওয়ার ব্যাপারেও কোনও সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দেননি। খুনিকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাসের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বলেছেন, আমি আপনার স্বজন হারানোর কষ্ট বুঝি। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পর্যালোচনার মধ্যে রয়েছে’।

বাংলাদেশে আইএস আছে এটা প্রমাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই মরিয়া ছিল। কিন্তু এখন বলছে এখানে আইএস অনুসারী জঙ্গি আছে। কেরি সেকথাই বলেছেন। এটা স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আইএস-এর উপস্থিতি তত্ত্ব থেকে সরে এসেছে।

অনেকগুলো অবস্থানের পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের। বাংলাদেশ নীতিতে তাদের অবস্থানের অনেক পরিবর্তন স্পষ্ট করেছেন জন কেরি এই সফরে। যোদ্ধা থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন জন কেরি।

১৯৬৬ সালে  ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে কূটনীতিতে স্নাতক কেরি ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন নৌ সেনা হিসেবে। যুদ্ধ এবং কূটনীতি দুই ক্ষেত্রেই তিনি পেশাদার। তাই কেরিকে নিয়ে আমার সংশয়। আমার সংশয় তার মুখের কথা আর মনের কথা নিয়ে। সংশয়ে উপনীত হয়েছি ইতিহাস বিশ্লেষণ করে। কারণ কেরি তো কেরি নয়, কেরি হলো মার্কিন প্রতিনিধি। তাই বলছি সাবধানতার জন্য আমার সংশয়। ভালোবাসা যাচাই করে নেওয়াই ভালো। তাই আমি কেরিকে নিয়ে সংশয়ী থাকতে চাই। দেখতে চাই সামনের দিনগুলো।

লেখক: সাংবাদিক
[email protected]

আরও খবর: রিশা হত্যাকাণ্ড: মন্ত্রী যদি বিচার চায়, আমরা কার কাছে যাব!

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ‘জেনোসাইড কর্নার’ বন্ধ থাকায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অসন্তোষ
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ‘জেনোসাইড কর্নার’ বন্ধ থাকায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অসন্তোষ
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ