X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা জাতীয় কমিটির কাজ নয়

গোলাম মোর্তোজা
৩১ আগস্ট ২০১৬, ১৪:৪৪আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০১৬, ১৪:৫৯

গোলাম মোর্তোজা আফ্রিকার বহু দেশে যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ চলছে। এক একটি দেশে দু’তিনটি পক্ষ। এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। একপক্ষকে আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। যুদ্ধ লাগিয়ে রেখেছে ইউরোপের ধনী দেশগুলো। এ সমস্ত দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী। লেখার বিষয় সেটা নয়। যুদ্ধ কেন চলছে, বলতে চাইছি সেই গল্প। যুদ্ধের কারণ সম্পদ। ডায়মন্ড, ইউরেনিয়াম, স্বর্ণ... পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আছে এসব দেশে। এই দেশগুলো আবার ‘গরিব দেশ’ হিসেবে পরিচিত। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ডায়মন্ডের বাজার বেলজিয়াম। অথচ বেলজিয়ামের নিজস্ব ডায়মন্ডের খনি নেই। আফ্রিকার গরিব দেশগুলোর সঙ্গে বেলজিয়ামের সরাসরি ফ্লাইট আছে। এসব গরিব দেশের ডায়মন্ডের বাজার বেলজিয়াম। ইউরোপের আরও অনেক দেশের ক্ষেত্রে এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। গরিবের সম্পদের ওপর ধনীদের লোভ চিরন্তন।
বাংলাদেশ একটি গরিব দেশ। সেই দেশের হাতে গ্যাস আছে। কয়লা আছে। সমুদ্রে গ্যাস তো পাওয়া যাবেই, তেলসহ আরও বহু মূল্যবান সম্পদ পাওয়ার সব সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এসব তথ্য বাংলাদেশ যতটা জানে, তারচেয়ে বেশি জানে ধনী দেশ ও তাদের কোম্পানিগুলো।
আফ্রিকার মতো বাংলাদেশের সম্পদও তারা লুটপাট করতে চাইছে বহু দিন ধরে। লুটপাটের জন্যে রাজনীতিবিদ-আমলাদের একটা অংশকে কেনার কাজ তারা সম্পন্ন করে ফেলেছিল। কিনে ফেলেছিল দেশীয় বিশেষজ্ঞদের অনেককে। তারাই অসত্য তথ্য দিয়ে বলেছিল ‘বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে’। লুটপাটের আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করে ফেলার পরও, শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেনি। প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’। জাতীয় কমিটির ওপর দেশি-বিদেশি লুটপাটকারী ও তাদের সুবিধাভোগীরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। দেশের বড় দু'টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ- বিএনপি, জাতীয় কমিটির কর্মকাণ্ড পছন্দ করে না।
আবার সুবিধাজনক সময়ে তারা জাতীয় কমিটির আন্দোলনের সুফল ভোগ করতে চায়, ভোগ করে। বর্তমান সময়ে এমন একটা অবস্থা বিরাজ করছে। বিরাজমান এই পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ।

১. রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ যখন থেকে শুরু হয়েছে, জাতীয় কমিটি তখন থেকেই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। জাতীয় কমিটি রাজনৈতিকভাবে খুব শক্তিশালী সংগঠন নয়। সচেতন কিছু মানুষ তার সম্পদ। যেহেতু জাতীয় কমিটি দেশের স্বার্থে আন্দোলন করে, একটু দেরিতে হলেও জনমানুষের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়। যেমন সুন্দরবন বাঁচানোর রামপাল বিরেধী আন্দোলনের জনসম্পৃক্ততা তৈরি হয়েছে। আন্দোলনের এই পর্যায়ে এসে বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চাইছে। চাইতেই পারে। জনস্বার্থের আন্দোলনে, যে কোনও ব্যক্তি-সংগঠন-রাজনৈতিক দল সম্পৃক্ত হতে পারে। সবারই অধিকার আছে। সমস্যা হয় তখন, যখন রাজনৈতিক দল জাতীয় কমিটির কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি করতে চায়।

রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা জাতীয় কমিটির কাজ নয়। এ কথা বুঝতে তো কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, সম্পদ রক্ষা করা বিএনপির মূল উদ্দেশ্য নয়। বিএনপির মূল উদ্দেশ্য সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করা। এই কাজটি তারা করতে চাইছে, পারছে না। রামপাল বিরোধী জাতীয় কমিটির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা সেই জায়গায় পৌঁছাতে চায়। বিএনপি যদি রামপাল বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়, আপত্তির কারণ নেই।

কিন্তু বিএনপির গোপন বাসনা তৈরি হয়েছে, তাদের আন্দোলনটি জাতীয় কমিটি করে দেবে। জাতীয় কমিটি খুব ভালো করে জানে রামপাল বিরোধী আন্দোলনের প্রতি বিএনপির সমর্থনের কারণ, তারা বিরোধী দলে আছে বলে। সরকারে গেলে নিশ্চিত করেই বলা যায়, ভুলে যাবে। যেভাবে ভুলে গেছে আওয়ামী লীগ।

২. বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করবেন কিনা? এই প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় কমিটি স্বাভাবিকভাবেই ঘোষণা দিয়েছে, বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা আন্দোলন করবে না। এতেই বিএনপি সংশ্লিষ্ট লোকজন ক্ষেপে গেছে। আপনারা ক্ষেপছেন কেন? আপনাদের তো আন্দোলন করতে না করা হয়নি। বলা হয়েছে, আপনাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় কমিটি আন্দোলন করবে না। কারণ আপনাদের বিশ্বাস করা যায় না। আপনারা কি স্বীকার করবেন ফুলবাড়ীতে গুলি করে মানুষ হত্যা করে ভুল করেছিলেন? বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল, আপনারা আপনাদের মতো করে আন্দোলন করে- বিশ্বাস অর্জন করেন। তা না করে আপনারা ক্ষুব্ধ হয়ে জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দের চরিত্র হনন করছেন। ঠিক সরকার যা করছে। সরকার করছে রামপাল বিরোধী আন্দোলন করার কারণে। আপনারা করছেন, আপনাদের জন্যে আন্দোলন করে না দেওয়ার কারণে।

এত বছর হয়ে গেল এখনও আপনারা জাতীয় কমিটি সম্পর্কে জানেন না। প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বা আনু মুহাম্মদ সম্পর্কে জানেন না। শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একজন সাধারণ ইঞ্জিনিয়ার নন। অনন্য প্রতিভাবান একজন ইঞ্জিনিয়ার। তার মোটামুটি বড় একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এই প্রতিষ্ঠানের সহায়তা সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বহু বড় বড় প্রতিষ্ঠান নিয়ে থাকেন। ইচ্ছে করলে এই প্রতিষ্ঠান তিনি আরও অনেক বড় করতে পারেন। তা না করে আন্দোলনের পেছনে সময় ব্যয় করছেন। তার প্রতিষ্ঠানের আয়ের একটা অংশ ব্যয় করেন জাতীয় কমিটির আন্দোলনের পেছনে। এসব অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য শোনায়, তাই না? এত বড় পাগল আছে নাকি, নিজের আয় করা অর্থ খরচ করে জাতীয় স্বার্থের আন্দোলন করবেন? আছে। আছে যে তার প্রমাণ প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। আরও অদ্ভুত তথ্য শোনাই।

প্রকৌশলী শহীদুল্লাহর ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম কাজ করে শতভাগ সততার সঙ্গে, কোনও রকম ঘুষ না দিয়ে। ঘুষ দিয়ে কাজ করতে হবে বলে, বন্ধুদের সঙ্গে করা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে এসেছেন। নিজের নামে করা প্রতিষ্ঠানের নামও তাদের দিয়ে এসেছেন। নিজে নতুন প্রতিষ্ঠান করেছেন। প্রকৌশলী শহীদুল্লাহর মেধা-সততা-যোগ্যতা-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার গল্পের পুরোটা জানলে, আপনাদের মাথার চুল খাড়া হয়ে যাবে। আপনারা যা কল্পনা করতে পারেন না, প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ বাস্তবে তা করেন!

আরেকজন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সরকার সংশ্লিষ্টরা তো বটেই, বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টরাও তার চরিত্র হননে মেতে উঠেছেন। আনু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক। ক্লাস ফাঁকি দেন না। কোনও রকম কনসালটেন্সি করেন না। গাড়ি-বাড়ি-সম্পদ তার লক্ষ্য নয়। অতি সাধারণ, প্রায় রোদে পোড়া কৃষকের জীবনযাপন করেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে কোনও আলোচনা অনুষ্ঠানে আসেন, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা-পাউরুটি খান অন্যদের সঙ্গে নিয়ে। শ্রম-ঘাম তো আছেই, নিজের আয়ের থেকে নিয়মিত চাঁদাও দেন জাতীয় কমিটিকে। জাতীয় কমিটির সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত আছেন, সবাই কম-বেশি চাঁদা দিয়ে থাকেন। পয়সা দিয়ে কর্মী ভাড়া করতে হয় না জাতীয় কমিটির।

আওয়ামী লীগ-বিএনপির একটি বড় জনসভা করতে কোটি টাকা খরচ হয়ে যায়। জাতীয় কমিটির একটি লংমার্চ আয়োজন করতে কয়েক হাজার টাকা খরচ হয়। মুশকিল হয়েছে, তারা নিজেদের খরচের সঙ্গে মিলিয়ে জাতীয় কমিটির খরচের হিসেব করতে চাইছেন।

৩. বিএনপি সংশ্লিষ্টদের ক্ষুব্ধতার আর একটি কারণ তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করলে সমস্যা নেই, বিএনপির সঙ্গে করলে সমস্যা কেন? কেন বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন না করার ঘোষণা দিল জাতীয় কমিটি? আগেই বলেছি, কারও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা জাতীয় কমিটির কাজ নয়। আপনার এজেন্ডা আপনি বাস্তবায়ন করেন, জাতীয় কমিটি তাতে বাধা দেবে না। কথা আর একটু জেনে বলতে হবে। জাতীয় কমিটি আজ পর্যন্ত কোনও দিনই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনও আন্দোলন করেনি। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে ফুলবাড়ী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। সরকার গুলি করে মানুষ হত্যা করে। জাতীয় কমিটির তথা জনমানুষের বিজয় নিশ্চিত হয়। সেই বিজয়ের পক্ষে অবস্থান নেয় তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। ফুলবাড়ীতে জনসভা করে তারা জাতীয় কমিটির পক্ষে অবস্থান নেয়। সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত জাতীয় কমিটির চুক্তি ক্ষমতায় গিয়ে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। এবং ক্ষমতায় এসে ভুলে যায়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করার কোনও ঘটনা এর মধ্যে ছিল না। না জেনে, বা আংশিক জেনে বা অনুমান করে, দায় চাপানো সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা দরকার।

বিএনপি জনসভা-মিছিল-লংমার্চ করে জাতীয় কমিটির আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতেই পারে। কেউ না করছে না, না করলেও তা মানার দরকার নেই। ‘ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করব না’- এতে গোস্মা করার তো কোনও কারণ দেখি না।

নিজেদের কাজ, নিজেরা করেন। অন্যের দিকে (জামায়াত-জাতীয় কমিটি-আমেরিকা, যেই হোক) তাকিয়ে থাকার নীতি পরিত্যাগ করুন। নিজের পায়ে দাঁড়ানো যে ভুলে গেছেন, তা আবার আয়ত্ত করার চেষ্টা করেন। নিজেদের লোকজন দিয়ে সরকারের মতো জাতীয় কমিটির চরিত্র হনন বন্ধ করেন।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ