X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

একালের রামপাল

আহসান কবির
৩১ আগস্ট ২০১৬, ১৭:৩৯আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৯:৪৭

আহসান কবির ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা পড়ে জেনেছিলাম গল্প কিভাবে বদলে যায়। ইদানীংকালে দেখা যাচ্ছে কৌতুকও বদলে যেতে পারে। উদাহরণসহ বুঝিয়ে বলি।
আসল কৌতুক: স্কুলে দেরি করে এসেছে বল্টু। স্যার তার কাছে জানতে চাইলেন—দেরি করে এসেছিস কেন? বল্টু উত্তর দিল- স্যার বাবা-মা’র ঝগড়ার কারণে। স্যার ক্ষেপে গিয়ে বললেন- বাবা মার ঝগড়ার সঙ্গে স্কুলে দেরির সম্পর্ক কী? বল্টু বললো- স্যার ঝগড়ার সময়ে আমার স্কুলের জুতার একটা ছিল বাবার হাতে আর অন্যটা ছিল মায়ের হাতে!!
বদলে যাওয়া কৌতুক: স্কুলে দেরি করে এসেছে বল্টু। স্যার তার কাছে জানতে চাইলেন- দেরি করে এসেছিস কেন? বল্টু উত্তর দিল- স্যার বাবা মা’র ঝগড়ার কারণে। স্যার ক্ষেপে গিয়ে বললেন- বাবা মার ঝগড়ার সঙ্গে স্কুলে দেরির সম্পর্ক কী? বল্টু বললো- স্যার ঝগড়ার সময়ে আমার পানির বোতলটা নিয়ে বাবা-মা কাড়াকাড়ি করছিলেন! বাবা চাচ্ছিলেন আমার পানির বোতলে তেল ভর্তি করে সাংবাদিক সম্মেলনে যেতে। আবার মাও চাচ্ছিলেন একই কাজ করতে!
আজকের লেখার বিষয়বস্তু কোনও সাংবাদিক সম্মেলন নয়। অন্যকিছু!
ড. মো.শহীদুল্লাহর গল্পের মতো একদা স্কুলের পাঠ্য বইতে শেখানো হতো ‘এসো নিজে করি’। হাজারো স্কুলে হয়তো তখনও বিজ্ঞানাগার এবং পড়ালেখার প্রয়োজনীয় উপাদান ঠিকমতো সরবরাহ করা হয়নি। আর তাই ‘এসো নিজে করি’র ব্যাপারটা সীমাহীন কৌতুকে পরিণত হয়েছিল। ছাত্রদের কেউ কেউ ওয়াশরুমে ( ওয়াশরুম সাউন্ডস গুড। প্রথমে ব্যবহৃত হতো প্রক্ষালন কক্ষ শব্দটি। এরপর টয়লেট, বাথরুম। এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ওয়াশরুম) যাওয়ার আগে ঘোষণা দিয়ে যেত- এসো নিজে করি!

নিজেরা করার আরও অনেক বিষয় আছে। কেউ হয়তো একটা সংগঠন তৈরি করে নাম দিলো ভাই ব্রাদার ও ছবিয়াল। কেউ হয়তো নাম দিলো গরুর পাল। সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা সংগঠন তৈরি হয়ে গেল যার নাম গাধার পাল। ইদানীং এমন আরও একটা সংগঠন তৈরি হতে যাচ্ছে। নাম রামপাল। যদি কেউ জানতে চান এই সংগঠনের কার্যক্রম কী? উত্তর হচ্ছে রামপাল সংগঠনটা ভারতীয় অভিনেতা অর্জুন রামপালের ভক্তদের নিয়ে তৈরি। ভক্তরা এদেশে অর্জুনের স্বার্থ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে সব কিছু করবে প্রয়োজনে।

সংগঠনটা কার্যক্রম শুরু করার আগেই সারাদেশে বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ বললো অভিনেতা কি এদেশে কম আছে? অর্জুন রামপালকে ভারত থেকে টেনে আনতে হবে কেন? নিজের দেশকেই তো আমাদের প্রধান্য দিতে হবে আগে। বঙ্গবন্ধুর একটা কথা স্মরণে আনা যায়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ইংল্যান্ড হয়ে ইন্ডিয়াতে গিয়েছিলেন। সে সময়ের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (ইন্দিরা গান্ধী) আপনাকে ধন্যবাদ কারণ আপনার সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি আপনার সেনাবাহিনীকে আমাদের দেশ থেকে কবে ফেরত আনবেন? ইন্দিরা গান্ধীর উত্তর ছিল আপনার (বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ) জন্মদিনের আগেই!

কেউ কেউ বলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হচ্ছে ‘ভারতের দালাল’। কিন্তু তারা আসলে তা নয়। আসলে ভারতের দালাল হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এরাই প্রথম ইন্ডিয়ান গাড়ি কোম্পানিগুলোকে এদেশে ব্যবসার বিশাল সুযোগ করে দেয়। ২০০১ সালে বিএনপি তথা চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর সারাদেশে এরা হাজার হাজার ইন্ডিয়ান সিএনজি আর টেক্সিক্যাব নামিয়েছিল। আওয়ামী লীগ অর্জুন রামপালকে আনলেও এদেশের ফিল্ম কিংবা এফডিসির পরিবেশের কোনও ক্ষতি হবে না।

অবশ্য ইন্ডিয়াকে ক্ষতিকর ভাবেন না এদেশে এমন মানুষ অনেকেই আছেন। তারা অবশ্য ইন্ডিয়াকে নিয়ে আফসোসও করে থাকেন। এদেশের অনেকেই ঘুরতে যান ইন্ডিয়ায়। ছেলে-মেয়েকে পড়ালেখা করান ইন্ডিয়ায়, চিকিৎসাও নিতে যান ইন্ডিয়ায়। ইন্ডিয়ার পোশাক আশাক না কিনলে ফ্যাশান কমপ্লিট হয় না, আর হিন্দি সিরিয়াল না দেখলে নাকি রাতে ঘুমই আসে না। মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি ছবি গরম গরম দেখতে না পারলে অনেকের মন খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপ হয় ইন্ডিয়ার ক্রিকেট টিম হারলে। ইন্ডিয়ার গরু না আসলে কোরবানি হয় না, ইন্ডিয়া পেঁয়াজ না বেচলে নাকি এদেশে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। কিন্তু আফসোসের জায়গা হচ্ছে গালি দেওয়ার সময় এদেশের মানুষ কেন যেন ইন্ডিয়াকেই বেশি গালি দেয়!!

যাই হোক আমরা ইন্ডিয়া কিংবা গালাগালি বাদ দিয়ে রামপালের দিকেই দৃষ্টি ফেরাই। অর্জুন রামপালের ভক্তরা বলছেন অর্জুন ধর্মে হিন্দু হলেও মুসলমানদের সঙ্গে তার ব্যাপক ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে শাহরুখ খান যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন তার সঙ্গে এসেছিলেন অর্জুন রামপাল। আর বাংলা নাচ নাচতে ও বাংলায় কথা বলতে এসেছিলেন রানী মুখার্জি। রামপাল বাংলাদেশে তার অভিনয় কার্যক্রম শুরু করলেও এফডিসি ও তার আশেপাশের পরিবেশের আদৌ ক্ষতি হবে না বরং গরিব মানুষদের আয় উন্নতি হবে। আগে এফডিসির গেটে শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতো। অনেক ছবি মুক্তি পেত বলে এফডিসি ছিল কাজ আর ব্যস্ততার জায়গা। এখন কাজ নেই। তাই লোকজন এফডিসির পাশে লোহা-লক্কড় আর মাছের দোকান দিয়েছে। এফডিসির গেটের আশেপাশে গাড়ি ধোয়া মোছা, মেরামত ও গাড়ি বিষয়ক প্রচুর দোকান গড়ে উঠেছে। রামপাল এলে এদের কোনও ক্ষতিতো হবেই না বরং প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরে উঠবে এফডিসি।

এদেশে রামপাল এলে হয়তো নিজের ক্যারাভানেই (বড় বড় অভিনেতা অভিনেত্রীদের থাকা খাওয়া আর রেস্ট নেওয়ার গাড়ি) থাকবেন। সেখানেই রেস্ট নেবেন, খাবেন দাবেন, ওয়াশরুমে যাবেন। রামপালের ব্যবহৃত পোশাক আশাক, খাবার দাবার কিংবা মলমূত্র হাতির ঝিল লেক কিংবা নদীতে ফেললে দূষণ হবে না। চট্টগ্রামের সার কারখানায় অ্যামোনিয়া নির্গত হলেই টন টন মাছ মরে ভেসে ওঠে। পাখিরা হাওয়া হয়ে যায়। শিশুরা শ্বাস কষ্টে ভোগে। রামপালের বেলায় সেটা হবে না। পাখিরা রামের ক্যারাভানে বসতে পারবে, আশেপাশে উড়তে পারবে। লেক কিংবা নদীর মাছ মরবেই না। বরং তারা আরও তরতাজা হবে। রামপালের ক্যারাভান থেকে যে ধোঁয়া বা পারদ নির্গত হবে তাতে গাছপালা বা জীববৈচিত্র্যের কোনও ক্ষতি হবে না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

সমস্যাটা আসলে কিছু মানুষকে ঘিরে। তারা অর্জুন রামপালের এদেশে আগমন উপলক্ষে খুব বেশি অসহিষ্ণু আর অধৈর্যশীল হয়ে উঠেছিলেন।  অর্জুন রামপাল খুবই কৌতুকবাজ। তিনি বলেছেন বাংলাদেশের লোকরা অনেক সহনশীল তবে খুব বেশি ধৈর্যশীল। তারপরই তিনি জানতে চান পৃথিবীর সবচেয়ে ধৈর্যশীল ব্যক্তি কে? রামপাল নিজেই উত্তর দেন- সানি লিওনের বিশেষ শো এর ক্যামেরাম্যান!!

যাই হোক রামপালের যারা স্পনসর তারা বলেছে রামপাল এলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির জায়গা থেকে অনেক অনুদান পাওয়া যাবে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, আশেপাশের গ্রামের লোকরা তেমন লাভবান হবে না। কারণ রামপালের সঙ্গে যারা কাজ করবেন তারা সব টেকনিক্যাল লোক। গ্রামের লোকরা সহজ সরল, তারা টেকনিক্যাল না! উল্টো এফডিসির আশেপাশের গ্রামের যারা মাছ ধরতেন, কাঠ কাটতেন, মধু সংগ্রহ করতেন তারা বিপদে পড়ে যেতে পারেন। যদি মাছ রাগ করে চলে যায়? যদি পাখি বা মৌমাছি না আসে? যদি গাছপালা মাইন্ড করে তখন? অর্জুন রামপাল যতই কৌতুকবাজ হন তিনি কি পাখির ভাষা বুঝবেন? মাছ কিংবা গাছের কথা বুঝবেন?

আসলে দেশ এখন দুইভাগে বিভক্ত। একদল রামপালের পক্ষে অন্যদল বিপক্ষে। এখন আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কোন পক্ষে সীমাহীন তেল দেবেন!!

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই লেখাটা অর্জুন রামপালকে নিয়ে। লেখাটা নিয়ে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। সমস্যাটা প্রথম তৈরি করে বিদেশি একটা সংবাদ সংস্থার বাংলা সংস্করণ। তারা রিপোর্ট করে যে রামপাল প্রশ্নে বাংলাদেশে ভিন্নমত তৈরি হচ্ছে। রামপাল প্রশ্নে জনগণের বিরোধিতা শেষমেষ সরকার ও ভারত বিরোধিতায় রূপ নিতে পারে। সবশেষে এই বিষয়টি নিয়ে একটা সাংবাদিক সম্মেলনও হয়েছে। ফেসবুকে অনেকেই বলেছেন, সংবাদ সম্মেলনে 'তেল বিষয়ক' সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে। যারা এই সংবাদ সম্মেলন দেখেননি তারা একটা বড় জিনিস মিস করেছেন।

তবে ড. মো.শহীদুল্লাহর মতো ( যিনি অবশ্যই ভাষা রক্ষা করতে চাইতেন) একালেও একজন শহীদুল্লাহর দেখা মিলেছে যিনি এদেশের তেল ও গ্যাস রক্ষা করতে চান। যিনি রামপালেরও বিরোধিতা করছেন।

আমার লেখার সঙ্গে এই রামপালের কোনও মিল নেই!

লেখক: রম্যলেখক

আরও পড়তে পারেন: 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
থাইল্যান্ড ও ভারতের বক্সারকে হারিয়ে সুরো কৃষ্ণর ৬০০ ধাপ উন্নতি
থাইল্যান্ড ও ভারতের বক্সারকে হারিয়ে সুরো কৃষ্ণর ৬০০ ধাপ উন্নতি
রেকর্ড বৃষ্টির তৃতীয় দিনেও স্থবির দুবাই
রেকর্ড বৃষ্টির তৃতীয় দিনেও স্থবির দুবাই
বাংলাদেশের সাবেক কোচকে নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের সাবেক কোচকে নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
বিএনপির চিন্তাধারা ছিল অন্যের কাছে হাত পেতে চলবো: প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির চিন্তাধারা ছিল অন্যের কাছে হাত পেতে চলবো: প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ