X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

একি গুরুভার বয় শেখ হাসিনা

আনিস আলমগীর
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৫:৩১আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৫:৪৬

আনিস আলমগীর পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ তার জাতীয় বেঈমানদের সাজার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু স্বাধীনতার কয়েক যুগ পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্র ক্ষমতায় স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি সহানুভূতিশীল সরকার থাকায় আমরা ব্যর্থ হচ্ছিলাম জাতীয় বেঈমানদের বিচার করতে। বেঈমানদের আমরা এতদিন সাজাতো দেইনি বরং তাদের গাড়িতে তুলে দিয়েছিলাম রাষ্ট্রীয় পতাকা। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই বেঈমানদের দেশে ফেরার পথ করে দিয়েছিলেন আর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া তাদেরকে মন্ত্রী করেছিলেন। অবশেষে কয়েক যুগ পেরিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আমলে আমরাও দেখলাম আমাদের জাতীয় বেঈমানদের করুণ পরিণতি।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের পথ বেয়ে আজ জাতি দেখছে একের পর এক ফাঁসিতে ঝুলছে স্বাধীনতাবিরোধী কুখ্যাত, প্রভাবশালী যুদ্ধাপরাধীরা। কাদের মোল্লাকে দিয়ে শুরু, এরপর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী-মীর কাশেম আলীকে নিয়ে ৬ জন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে ২৬টি মামলার রায় হয়েছে। আরও ২৪টি বিচারাধীন রয়েছে। শ্রদ্ধায় আজ জাতির সিংহভাগ মানুষ মাথা নত করছে বিচার বিভাগের এই অসামান্য কাজের জন্য। কিন্তু সব কিছুর ছাড়িয়ে প্রশ্ন আসছে রাষ্ট্রক্ষমতায় যদি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা না থাকতেন তাহলে এটা সম্ভব ছিল কিনা? নেপথ্যে থেকে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে নির্মূল কমিটি গঠন, তার আন্দোলনকে লালন আর ২০০৯ সালে বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করা, গণজাগরণ মঞ্চকে ফোকাসে আনা—একের পর এক পদক্ষেপগুলো যদি শেখ হাসিনা না নিতেন, সমর্থন না করতেন—জাতীয় বেঈমানদের বিচার বাংলার মাটিতে আদৌ হতো না। জাতির জীবনে এই বিচার, এই গ্লানি মুক্তির দিন আদৌ আসতো কিনা সন্দেহ।

গত ৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ১০.৩৫ মিনিটে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। তার মৃত্যুদণ্ড আপিল বিভাগ বহাল রাখার পর থেকে সারাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে গিয়েছিল। গুলশানের হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ড আর শোলাকিয়ার হত্যাকাণ্ড এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টান ধর্মের বহু যাজক, বৌদ্ধদের মঠাধ্যক্ষ, হিন্দুদের পুরোহিতদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে মীর কাসেম আলীর ভূমিকা রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। মীর কাসেম আলী ধনাঢ্য ব্যক্তি। তার ব্যক্তিগত মূলধন নাকি ১২ হাজার কোটি টাকা। দেশে প্রচার রয়েছে যে তিনি নাকি ২০০ কোটি টাকা দিয়েছেন বিভিন্ন গোলযোগ পাকিয়ে দেশকে অচল করে দেওয়ার জন্য। কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। আপিল বিভাগের রায়ের পরে তো দেশে গণ্ডগোল কম হয়নি। শোলকিয়ায় জঙ্গিরা ঈদগাহ জামাতে পৌঁছাতে পারলে তো কয়েক হাজার মানুষ মারা কোনও ব্যাপারই ছিল না। পুলিশ জান দিয়ে অবশ্য তা প্রতিরোধ করেছেন। না হয়তো কারবালা সৃষ্টি হতো। মীর কাসেম আলী আর সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুর পর অর্থের সরবরাহ কমে যাওয়ায় গুপ্তহত্যা- সন্ত্রাস কিছু কম হবে বলে মনে হয়। তবে একেবারে বন্ধ হবে না।

২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী তার দলীয় মেনিফেস্টোতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে জনগণের ম্যান্ডেট চেয়েছিলেন। জনগণও তাকে ২৬৮ সিটে জিতিয়ে দিয়ে তাদের বিচার কথার পথ সুগম করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব চাপ উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জানে তারা কখনও এদের বিচারের বিরোধিতা করতে পারে না। জামায়াতের গুরু মওলানা আবু আলা মওদুদীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল নির্বিচারে কাদিয়ানি হত্যার জন্য। কিন্তু সৌদি আরবের জোর দাবির মুখে মওদুদীর মৃত্যুদণ্ড পাকিস্তান সরকার রহিত করেছিল। সেই সৌদি আরব এদের মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে কোনও কথাই বলেনি, বলছে না।

সৌদি আরব উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, বিশ্বে ইসলামের নামে যে সন্ত্রাস হচ্ছে এর হোতা এরাই। ইসলামী সন্ত্রাসের কারণে সারাবিশ্বে আজ মুসলিম উম্মাহ ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেছে। তাই আজ প্রত্যেক মুসলিম দেশের সরকার এদের নিয়ে চূড়ান্ত উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে এবং তাদের নির্মূল করতে বদ্ধ পরিকর। শেখ হাসিনা একজন সংবেদনশীল হৃদয়ের মানুষ। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে এমন কঠোর এবং ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবেন সেটা চিন্তা করতেও অবাক লাগে। অবশ্য কথায় বলে,‘ অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর’।

বঙ্গবন্ধুতো দয়ালু ছিলেন। শাহ আজিজ যখন দালাল আইনে জেলে তখন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসা ভাড়া পৌঁছিয়ে দিতেন। সবুর খান জেল থেকে লিখেছিলেন, ‘মুজিব বুড়ো হয়েছি, জেল সহ্য হচ্ছে না।’ তিন দিনের মাথায় মুক্তি দিয়েছিলেন। তারাইতো সবাই মিলেমিশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। সফলও হয়েছিলেন। যারা পথের বাধায় প্রাণের ভয়ে কর্তব্যকে কঠোরভাবে পালন করতে পারে না তাদের জন্য নেতৃত্ব দান কঠিন হয়ে ওঠে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করাটা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ছিল একটা পর্বত প্রমাণ শক্ত কাজ। দেশের ভেতর থাকা দেশবিরোধী শক্তিসহ আন্তর্জাতিক শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে এই বিচার কাজ সম্পন্ন করার মতো দূরুহ কাজের পেছনে মূল ভূমিকায় যদি শেখ হাসিনা না থাকতেন সেটা সম্ভব ছিল না। একটি দেশের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ যেখানে ইতিহাস ভুলে এদেরকে ইসলামিক নেতা হিসেবে মান্য করে, আন্তর্জাতিকভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে তাদেরকে ‘ইসলামিক নেতা’ হিসেবে প্রচার করা হয়- সেখানে এমন বিচার কার্যকর করার পেছনে রাজনৈতিক দৃঢ়তা না দেখালে উল্টো কিছু হতে পারতো। বিচারের প্রথমদিকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রবল চাপ আসতে থাকে এবং এখনও পাকিস্তান ও তুরস্ক যেভাবে ঘেউ ঘেউ করছে। তাকে উপেক্ষা করাটা শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কারও দ্বারা সম্ভব হতো না।

যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং মীর কাশেমের যে প্রভাব, সেই প্রভাব প্রতিপত্তিকে হার মানিয়ে তাদের সাজা কার্যকর করে শেখ হাসিনা নিজের দক্ষতাকে বিশেষ একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন। প্রমাণ করেছেন, চাইলে দেশের জন্য শেখ হাসিনা পারবে না এমন কোনও কাজ কম আছে। এই বিচারকাজ সম্পন্ন করার ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্বের যে দৃঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে সেটাও জাতি হিসেবে আমাদেরকে একটা নতুন মাত্রা দিয়েছে। সে কারণে জন কেরি শেখ হাসিনাকে নিয়ে টুইট করে তৃপ্তি প্রকাশ করেন।যে জন কেরি যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করেছিলেন সে জন কেরিই তার বাংলাদেশ সফরের সময় এ বিষয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। সর্বোপরি এই বিচারের মাধ্যমে সারাদেশে নতুন প্রজন্মের চোখে দেশের সেরা আইকন হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। আর শেখ হাসিনা জলে স্থলে দেশের সীমানা বিরোধ নিরসন করে বাংলাদেশকে দিয়েছেন একটা স্থায়ী সীমান্ত।চিরদিন কেউ থাকে না, তিনিও থাকবেন না। কিন্তু দেশের সীমান্ত চিহ্নিতকরণ এবং জাতীয় বেঈমান, নরঘাতক, যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান প্রধান হোতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, সাজা ভোগ করতে করতে মৃত্যুর দরজায় পাঠিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা দেশের ইতিহাসে চিরদিনই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। থাকবেন তার কঠোর কর্তব্য পালন ও উন্নয়নে ঐতিহাসিক ভূমিকার জন্যও। শান্ত সাগরে নৌকা চালানো কঠিন কিছু নয়। কিন্তু অশান্ত সাগরে নৌকা চালাতে বিজ্ঞ মাঝির দরকার। শেখ হাসিনা এ পর্যন্ত সিংহভাগ কাজে বিজ্ঞতার পরিচয়ই দিয়েছেন, আগামীতেও দেবেন সেই প্রত্যাশা করি।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

আরও খবর: খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ছে

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ