X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারত মার্কিন সামরিক চুক্তি

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৪:০২আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৭:১৯

 



বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে, যখন উপসাগরীয় যুদ্ধ চলছে, তখন ভারতকে আমেরিকা অনুরোধ করেছিল তাদের বিমানবন্দর ব্যবহার করে আমেরিকার যুদ্ধবিমানকে যেন তেল ভর্তি করার অনুমতি দেয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শেখর, তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ১০ দিনের মাথায় চন্দ্র শেখর অনুমতি প্রত্যাহার করে নেন। কারণ চন্দ্র শেখর সরকার গঠন করেছিলেন কংগ্রেসের সমর্থনে আর কংগ্রেস অনুমতি দেওয়ার বিষয়টির তীব্র বিরোধিতা করেছিল। তাদের সঙ্গে ছিল বাম দলগুলো এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং।
কংগ্রেস নেতা রাজিব গান্ধী ভারতের নিরপেক্ষ থাকার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, কারণ ইরাকের সঙ্গে তাদের ছিল মজবুত বন্ধন। অনেক বছর পর গত ৩০ আগস্ট ২০১৬, সেই ভারত আমেরিকার সঙ্গে এক সামরিক চুক্তি সম্পাদন করে স্বীকার করে নিলো যে, আমেরিকা তেল ভর্তির জন্য হোক বা অন্য যেকোনও প্রয়োজনে হোক, ভারতের ঘাঁটি অবাধে ব্যবহার করতে পারবে।
খবরে বলা হয়েছে, ‘‘ভারত ও আমেরিকা যেন পরস্পরের সামরিক ঘাঁটিগুলোতে রসদ ভরার ও মেরামতের জন্য অ্যাক্সেস পায়, তা নিশ্চিত করতে দুই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির ফলে দুই দেশের সামরিক বাহিনী একে অন্যের নৌ, বিমান বা সেনা-শিবিরগুলোয় গিয়ে নতুন শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে, সামরিক পরিভাষায় যাকে বলে ‘রিপ্লেনিশমেন্ট’। স্ট্র্যাটেজিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক পরাক্রমের মোকাবিলা করার জন্যই ভারত ও আমেরিকা এই নজিরবিহীন প্রতিরক্ষা সহযোগিতার পথ বেছে নিয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশটন কার্টার ও তার ভারতীয় কাউন্টারপার্ট মনোহর পারিক্কর পেন্টাগনে যে সমঝোতায় সই করেন, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনও চুক্তি আগে কখনও হয়নি।’’
পাকিস্তান আমেরিকাকে তার প্রয়োজনে পেশোয়ারে ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিল। শুধু পেশোয়ারে ঘাঁটি আমেরিকা ব্যবহার করতো। কিন্তু ভারত অনুমতি দিল সুনির্দিষ্ট কোনও ঘাঁটির কথা উল্লেখ না করে। ভারতের যেকোনও ঘাঁটি যেকোনও সময় যেকোনও প্রয়োজনে আমেরিকা ব্যবহার করতে পারবে। এ এক লাগামহীন অধিকার। অস্ট্রেলিয়া থেকে ওমান সাগর পর্যন্ত আমেরিকার বেশ কিছু সারিবদ্ধ ঘাঁটি রয়েছে। দিয়াগো গার্সিয়ায় তার বড় নৌঘাঁটির অবস্থান। আমেরিকার নৌবহর বিশ্বের বৃহত্তম ও সর্বাধুনিক নৌবহর। ২৯০ খানা জাহাজ রয়েছে তার নৌবহরে। আরও ১০ খানা জাহাজ অচিরেই সংযোজিত হবে। এতকাল পর্যন্ত আমেরিকার নৌবহর ছিল আটলান্টিক নির্ভর। এখন আমেরিকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার ষাট শতাংশ নৌশক্তি প্রশান্ত মহাসাগরে স্থানান্তর করবে। আমেরিকা বলছে তাদের বাণিজ্যের সিংহভাগ এখন প্রশান্ত মহাসাগর ভিত্তিক হয়ে উঠছে। সুতরাং তার বাণিজ্যের নিরাপত্তার জন্য তার নৌশক্তির উপস্থিতির প্রয়োজন।
গত দুই বছর ধরে স্থানান্তরের কাজ চলছে। চীন বিচলিত হবে ভেবে আমেরিকা বলছে, তারা চীনকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরে আসেনি। তাদের দাবি, তারা প্রশান্ত মহাসাগরীয় শক্তিও। কারণ তাদের রাজ্য হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ ১৯৫৯ সালের ২১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ সর্বশেষ রাষ্ট্র, তারপর আমেরিকার সঙ্গে এযাবৎ আর কেউ যোগ দেয়নি।
চীনের নৌবহর বারবার ভারত মহাসাগরে উপস্থিত হওয়ার এক রেওয়াজ তৈরি করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরেতো চীনের নৌবহর সার্বক্ষণিকভাবে উপস্থিত। দক্ষিণ চীন সাগরের অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক আদালত দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর চীনের মালিকানা অস্বীকার করেছে। চীন বলেছে তারা আন্তর্জাতিক আদালতের এ রায় মানে না। এতদিন আমেরিকা বিশ্ব ব্যবস্থাকে বিধ্বস্ত করেছে এখন দেখছি চীনও সেই পথ অবলম্বন করছে। বড় রাষ্ট্রগুলো যদি এমন আচরণ করে তবে ছোট রাষ্ট্রগুলো তাদের অধিকার রক্ষা করবে কিভাবে! দক্ষিণ চীন সাগরের অবস্থান হচ্ছে ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনামের মধ্যস্থলে। এ সাগরটির প্রকৃত দাবিদার এ দুই রাষ্ট্রই হতে পারে। ভিয়েতনাম তো সাগরতীরে মূলভূখণ্ডের সঙ্গে আর ফিলিপাইন হচ্ছে দ্বীপপুঞ্জ।
প্রশান্ত মহাসাগরের আমেরিকার বহু ঘাঁটি রয়েছে কিন্তু ভারত মহাসাগরের আমেরিকার নৌ-ঘাঁটির সংখ্যা বেশি নেই। ভারতের সঙ্গে আমেরিকার এ চুক্তির ফলে ভারত মহাসাগরে তাদের কৌশলগত উপস্থিতির ক্ষেত্র প্রসারিত হলো। ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী দেশ ভারত। তার সব ঘাঁটিই তার উপকূলে অবস্থিত। সম্প্রতি ভারত উদ্যোগ নিয়েছে মরিশাস এবং সিসিলিতে নৌঘাঁটি স্থাপনের জন্য। চীন পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে গোয়াদার এ বন্দর নির্মাণ করছে। এখানেও তার নৌঘাঁটি স্থাপন করবে। শ্রীলংকা, ইয়েমেন এবং মায়ানমারেও চীন নৌঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করছে।
ভারতের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক স্থাপনের উভয় রাষ্ট্রের আগ্রহ থাকলেও এ ধরনের চুক্তি ছাড়া তা সম্ভব হচ্ছিল না। এখন তা বাস্তবে রূপ নিলো। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, এটা কোনও সামরিক চুক্তি নয়। এটা নাকি সহযোগিতা চুক্তি। চুক্তিটাকে যে নামেই অবহিত করুক না কেন, এটা উভয় দেশের সামরিক উদ্দেশ্যই পূরণ করবে। তারা নিজেরাই বলেছেন চীন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তাতে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের নিকটবর্তী হয়ে সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করতে বাধ্য হয়েছে।
চীন এ চুক্তিটি নিয়ে কোনও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। খুব শান্তভাবে বলেছে, ‘এ চুক্তিটা গঠনমূলক ও ইতিবাচক হবে।’ অথচ চীনকে প্রতিপক্ষ ভেবে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তিটা সম্পাদন করেছে। ভারত আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে চীনের দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর একক দাবি এবং কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ এ জলপথের বাণিজ্যকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
নরেন্দ্র মোদি বাস্তব বোধ সম্পন্ন রাজনীতিবিদ। তিনি স্বপ্ন দেখেন না। পুরোপুরি ভারতীয়। সম্ভবতো ভারতের মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই তিনি এ চুক্তিটা করেছেন। তার আগে তার চেয়েও বেশি প্রথিতযশা রাজনীতিবিদেরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তারাও এমন চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজন অনুভব করেননি। ১৯৬২ সালে চীন ভারত আক্রমণ করেছিল এবং শোচনীয়ভাবে ভারতের পরাজয়ও হয়েছিল। চীন একতরফাভাবে যুদ্ধ বন্ধ করে পুরনো সীমান্তে ফিরে গিয়েছিল, না হয় ভারতের পক্ষে চীনকে ঠেকানো মুশকিল ছিল। এখন ভারতেরও বহু উন্নতি হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে চীনও পিছিয়ে নেই। ব্রিটিশের ম্যাক মোহন লাইনকে চীন সীমান্ত হিসাবে কখনও মানেনি। রাজীব গান্ধী ও অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সীমান্ত বিরোধ মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদী সে পথে হাঁটলেনও না। বিরোধ অব্যাহত রাখলে তার ডালপালা বিস্তার করে। সুতরাং বিরোধ মীমাংসা করাই উত্তম। অথচ সীমান্তবিরোধ ছাড়া ভারতের সঙ্গে চীনের অন্যকোনও বিরোধ নেই।
এ চুক্তির প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করার প্রস্তাব নিয়েছে এবং চুক্তির একটা খসড়াও তৈরি করেছে যা পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। নিশ্চয়ই অচিরেই চীন-পাকিস্তান আরেকটা সামরিক চুক্তি সম্পাদন করবে। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর তৈরি করছে। এতে চীন ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই করিডোর পাকিস্তানি অধ্যুষিত কাশ্মীরের ওপর দিয়ে গোয়াডর বন্দরে গিয়ে পৌঁছাবে। জি-২০ সম্মেলনে মোদি চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন কিন্তু লাদাখ সীমান্তের ওপরে চীন খোদ ভারতের জমির ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করেছে এই রাস্তাটাই এখনও সরাতে পারেনি। সুতরাং পাকিস্তান অধ্যুষিত কাশ্মীর নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন তুলে লাভ কি! সীমান্ত বিরোধ মীমাংসা করতে নেওয়ার-দেওয়ার মনোবৃত্তি থাকতে হয় সে মনোবৃত্তি নিয়ে ভারতের উচিত ছিল সীমান্তবিরোধ মীমাংসা করা। এতেই শান্তির বীজ নিহিত ছিল।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ