X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র’ ও ‘শক্তিশালী শাসক’

চিররঞ্জন সরকার
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১২:৪৯আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১২:৫৭

চিররঞ্জন সরকার গায়ের জোরে শাসন করা- এটা নতুন কোনও ঘটনা নয়। গণতন্ত্রের নামেও যেমন গায়ের জোর দেখা যায়, আবার অন্য ব্যবস্থাতেও গায়ের জোর দেখা যায়। অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে নানা দেশে এক বিশেষ ধরনের রাজতন্ত্র কায়েম হয়েছিল, ঐতিহাসিকেরা যার নাম দিয়েছিলেন- ‘এনলাইটেনড ডেসপটিজম৷’ রাশিয়ার ক্যাথরিন দ্য গ্রেট কিংবা জার্মানির ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট ছিলেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কেবলই নিপীড়ন করে নয়, উদারতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে প্রজা শাসন ছিল এর লক্ষ্য। ঊনবিংশ শতকে এসে আমেরিকার গণতন্ত্রের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ফরাসি ঐতিহাসিক টকেভিল আমদানি করেছিলেন- ‘সফট ডেসপটিজম’-এর তত্ত্ব। তার একটি অসাধারণ প্রবন্ধের শিরোনামই ছিল- ‘হোয়াট সর্ট অব ডেমোক্র্যাটিক ডেসপটিজম নেশনস হ্যাভ টু ফিয়ার’।
আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর বাকশাল কায়েমের আগ পর্যন্ত একটা গণতান্ত্রিক আবহ বর্তমান ছিল বটে। কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বৈরতন্ত্রই বাংলাদেশে শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে গড়ে ওঠে। নব্বইয়ে স্বৈরশাসক এরশাদকে হঠিয়ে বাংলাদেশে যে ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়, তাকে ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র’ বলাই ভালো। ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের’ লক্ষণগুলো ঠিক কী কী?  টকেভিলের কথায়, এটা এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে দৃশ্যত নাগরিকের ইচ্ছাশক্তিকে ধ্বংস করে ফেলা হয় না কিন্তু ‘বেনডস, সফেনস অ্যান্ড গাইডস ইট’। এই শাসনের ভিত্তি সার্বিক নিপীড়ন না হলেও, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ এখানে প্রতিহত হয়, ধীরে ধীরে তারা পর্যবসিত হয় সরকার নামক রাখালের আস্তাবলে একদল নির্জীব অথচ পরিশ্রমী ভেড়ার পালে। বাংলাদেশেও কি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি? এর বাইরে অন্য কোনও অভিজ্ঞতা কি আমরা দেখতে পাই?
এর আগে জামায়াতিদেরকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিল, তখন দেশে কী এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা দেশবাসীর ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, নাশকতা, দুর্নীতি, নৈরাজ্য, রাজনৈতিক হত্যা, হাওয়া ভবন নামে একটি ভবনকে ঘিরে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমসহ এক চরম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এরপর সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে নির্বাচন, সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনার জয়, আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আবার সুশাসনের অভাব ইত্যাদি বলবৎ হয়। বছর তিনেক আগে বিরোধীশূন্য পরিবেশে নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ তার মিত্রদের নিয়ে আবার ক্ষমতায় সওয়ার হন। বিরোধী দলহীন, সমালোচনা-চ্যালেঞ্জহীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রকারান্তরে ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র’ই কায়েম করে। এক ধরনের নিপীড়নমূলক বন্দোবস্ত চালু করা, সমালোচনাকে গুরুত্ব না দেওয়া, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সমালোচকদের প্রতি খড়গহস্ত হওয়া, প্রতিবাদীদের শত্রুর কাতারে ঠেলে দেওয়া, প্রতিবাদ-আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ-আইন ও দলীয় মস্তানদের যথেচ্ছ ব্যবহার  ঘটানো-ইত্যাদির মাধ্যমে মূলত গায়ের জোরে দেশ শাসনের একটা প্রক্রিয়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
অবাধ গণতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার স্বপ্ন থেকে বাংলাদেশের জন্ম হলেও কার্যত কোনও দিন তা পূরণ হয়নি। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে খুন হওয়ার পর থেকে সামরিক শাসন বা গণতান্ত্রিক শাসন যাই কায়েম হোক না কেন, তার অভিমুখ থেকে গিয়েছে বিরোধী কণ্ঠরোধ আর স্বৈরাচারের দিকেই। আমাদের আজকের এই যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তার প্রধান কারণ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের ‘জিরো সাম গেম’৷ কেউ কাউকে মূল্য দেয় না। একে অপরকে ‘শূন্য’ বানাতে চায়!
শাসকগোষ্ঠী ক্রমেই যেন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। সমালোচনা বা বিরোধিতাকে কঠোর ভাবে স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যম, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও এখন আইনি ব্যবস্থার খাঁড়ার নিচে পড়েছে। কখনও শাসক দলের ছাত্র সংগঠন কখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রতিবাদী শক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এতে করে সমালোচনা বা প্রতিবাদ নয়, এক ধরনের চাটুকারিতার পরিবেশ গড়ে উঠছে। কোনওরকম বাধা-বিপত্তি বা সমালোচনা-প্রতিবাদের আশঙ্কা না থাকায় শাসক হয়ে উঠছে ক্রমেই বেপরোয়া। শাসক দলের ছোট-খাট নেতারাও মহা-অন্যায় করে বসছেন। এই অন্যায়কে চাপা দিয়ে রাখতে গায়ের জোরও প্রয়োগ করছেন। এই স্বৈরতান্ত্রিকতার যাঁতাকলে পিষ্ট শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরা আজ বড়ই অস্বস্তি এবং বিপন্নবোধ করছেন।
ইদানীং অনেকে যুক্তি দেখানো শুরু করেছেন যে, দেশে একজন শক্তিশালী নেতা/নেত্রী দরকার। দরকার একজন শক্ত প্রশাসক। স্ট্রং লিডার। যে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের পথে দেশকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু কেউ বলছেন না, আমাদের একজন আদর্শ নেতা বা নেত্রী দরকার। ‘শক্তিশালী’ জিনিসটা আসলে কী? শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রশংসার বিষয়, দুর্বলতা পরিত্যাগযোগ্য। কিন্তু কোনও ব্যক্তি কতখানি শক্তিশালী আর কতখানি দুর্বল এটা দিয়েই কি বিচার করা হবে আদর্শ নেতার চরিত্র? যারা ক্রীড়া জগতে বিখ্যাত ভারোত্তোলক বা কুস্তিগীর, তারা তো দুর্বল চিত্ত নন। কিন্তু তাদের শক্তি অনেকটাই শারীরিক। আবার হিটলারের মতো ছোটখাটো মানুষের শক্তি ছিল মূলত মনস্তাত্ত্বিক। তা হলে কী দিয়ে বিচার হবে শক্তিশালী না দুর্বল নেতা?
সততা, বুদ্ধি, প্রকাশের ক্ষমতা, বিচারক্ষমতা, প্রশ্ন করার মন, মতামত বা নানান মতামত সংগ্রহের ইচ্ছা, তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা, ভালো স্মৃতিশক্তি, সাহস, দূরদর্শিতা, সীমাহীন উৎসাহ এবং চিন্তাভাবনায় কট্টর না হয়েও আধুনিক ও নমনীয় হওয়া— এ সবই কি ভাল নেতা হওয়ার গুণ নয়? আজকাল বার বার মনে হয়, শক্তিশালী, জবরদস্ত ও সুযোগ্য নেতা সম্পর্কে আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষের মনে কিছু বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে যা বাস্তব থেকে অনেকটাই দূরে।
আসল কথা হলো, নেতার গ্ল্যামার, ক্যারিসমা, জনপ্রিয় জনমোহিনী শক্তি, যাই হোক না কেন আসলে নেতৃত্ব শক্তিশালী হতে পারে একমাত্র যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমেই। পুরোপুরি গণতন্ত্র আছে এমন দেশের পাশাপাশি যে সব দেশে গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপট নেই সেখানেও কোনও ব্যক্তি প্রবল জনপ্রিয় স্বৈরতন্ত্রী হয়ে উঠতে পারেন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে কী জাতীয় পর্যায়ে কী আঞ্চলিক পর্যায়ে অনেক নেতা-নেত্রী আছেন যারা একাধারে জনপ্রিয় কিন্তু অগণতান্ত্রিক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস ও সিনেটের ভূমিকা সংবিধানের মাধ্যমেই এমন ভাবে করা হয়েছে যাতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষে চরম ক্ষমতার ব্যবহার করা কঠিন। ক্লিন্টন থেকে ওবামা- প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্বের অবক্ষয়ের নমুনা আমরা দেখছি। লিঙ্কন প্রায়ই বলতেন, কোনও ভুল হলে এটা আমাদের ভুল। ক্যাবিনেটের সকলের নয়। তার মন্ত্রিসভার এক সতীর্থ সদস্য গিডিওন ওয়েলস বলেছেন, এ কথা বলার হিম্মত রাখতেন লিঙ্কন, তাই তিনি ছিলেন বড় নেতা।
আর্চি ব্রাউন আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সেটি হলো নির্বাচনে বিপুলভাবে জিতলেই একজন নেতা বা নেত্রী মনে করেন যে- তিনি যোগ্য, সফল এবং শক্তিশালী নেতা। কিন্তু সেটা এক মস্ত বড় ভুল। জয়লাভ করা মানেই কিন্তু ভালো নেতা হওয়া নয়। হিটলারও তার জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রী দলের পক্ষে পেয়েছিলেন এক বিপুল জনসমর্থন।
ম্যাকিয়াভেলি তার ‘প্রিন্স’য়ে বলেছিলেন, রাজাকে মিথ্যা বলতেই হবে, তাকে অভিনয় করে হলেও দেখাতে হবে যে তিনি প্রজাবৎসল। প্রজাদের শোকে তিনি মুহ্যমান, এই ধারণা রাজাকে জনপ্রিয় করবে। চাণক্যের সূত্রতে নৈতিকতার কথা বলা হয়েছে বার বার। তার সূত্রের প্রথমেই বলা হয়েছে, রাজাকে সৎ হতে হবে। অসত্য অন্যায়ের মাধ্যমে রাজধর্ম পালন হবে না। রাজা শক্তিশালী হবে না।
বিরোধী মতকে অগ্রাহ্য করে নয়, বরং তাদের অভিমতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করাটাই সৎ শাসকের বৈশিষ্ট্য। আর শাসক যদি সৎ না হয়, তাহলে শক্তিশালী হবে কিসের জোরে? গায়ের জোরে? গায়ের জোরে কি সত্যিই টিকে থাকা যায়?

লেখক: কলামিস্ট
আরও খবর: ‘টুটুলের ছবি দেখিয়ে বলে, উনি ইসলামবিরোধী, হত্যা করতে হবে’

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ