X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

চ্যান- জাকারবার্গ ও সুকান্তের স্বপ্ন

সালেক উদ্দিন
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৪:৫২আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৫:০৫

Salek Uddin‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বসবাসযোগ্য করে যাবো আমি/ নব-জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ বাংলার ক্ষণজন্মা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই দৃঢ় অঙ্গীকার তার মৃত্যুর ৬৮ বছর পর উচ্চারিত হলো পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের প্রবর্তক মার্ক জাকারবার্গের কণ্ঠে। জাকারবার্গ ও তার স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান তাদের কন্যা ম্যাক্সের জন্ম উপলক্ষ্যে বললেন, ‘সব শিশুর জন্য উন্নত বিশ্ব রেখে যাওয়ার দায়িত্বটা বেশি করে অনুভব করছি’। বললেন, ‘আমরা যে পৃথিবী রেখে যাবো আমাদের পরের প্রজন্ম যেন তার চেয়ে উন্নত পৃথিবী পায়’।
তারা আগামী প্রজন্মকে এমন একটি পৃথিবী উপহার দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন যে পৃথিবীর হবে সমতার। যার মানুষ হবে রোগমুক্ত সুস্বাস্থ্যময় ও দীর্ঘায়ুর। তারা তাদের স্বপ্নের পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পার্থিব জগতের সমস্ত সুযোগের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চেয়েছেন। মানুষের সম্ভাবনার বিকাশে ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় কী করা যায় তা নিয়েই ভাবছেন তারা। তারা এমন উদ্যোগের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন যা উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোনও সমস্যার সমাধান করতে সম্ভব। যেখানে সব সুবিধা গ্রহণে প্রত্যেকেরই সমান সুযোগ থাকবে- তা সে যে জাতি পরিবার বা পরিবেশেই জন্ম নিক না কেন! কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ছাড়পত্র কবিতায় যে স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রিসিলা চ্যান ও মার্ক জাকারবার্গ দম্পতি যেন এই পৃথিবীতে তারই বাস্তবায়নের পথক্ষেপ গ্রহণ করলেন।
তারা বলেছেন, এর জন্য দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগ দরকার হবে। দরকার হবে বিশেষজ্ঞদের পৃষ্ঠপোষকদের। দরকার হবে আরও আশ্চর্য সব মানুষের কাঁধে কাঁধ মেলানো সহযোগিতা।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তাদের একমাত্র কন্যা ম্যাক্স জন্ম নেয়। সেই আনন্দে সৃষ্টিশীল জাকারবার্গ তার মানবকল্যাণ পরিকল্পনাটি পৃথিবীর মানুষের সামনে তুলে ধরেন। ফেসবুকে নবজাত কন্যা ম্যাক্সকে লেখা পত্রের মাধ্যমে পরিকল্পনার ঘোষণা দেন তিনি। লিখেন, আগামী পৃথিবীতে হৃদরোগ ক্যানসার স্ট্রোক আর সংক্রামক রোগে যেন মানুষ আর মারা না যায় সে জন্যে তারা কাজ করে যাবেন এবং আগামী প্রজন্মের জন্য এখনকার চেয়ে ১০০ গুণ চমৎকার ও নিরাপদ পৃথিবী গড়ার কাজে তারা তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন।   
বিষয়টি তিনি তার বক্তব্যে আরও পরিষ্কার করেন। বলেন, ফেসবুকে তার এবং তার স্ত্রীর যে শেয়ার আছে তার ৯৯ শতাংশই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় করবেন। মানুষের অমিত সম্ভাবনাকে বিকশিত করার রোগমুক্ত পৃথিবী উপহার দেওয়ার এবং আগামী দিনের শিশুদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করাই হবে তাদের ব্রত।
প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তারা গড়ে তোলেন দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘চ্যান জাকারবার্গ ইনিশিয়েটিভ’। এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যই হলো মানুষের অমিত সম্ভাবনার বিকাশ আর সমতা প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠানে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা জাকারবার্গ ও তার স্ত্রীর ফেসবুকে যে শেয়ার আছে তার ৯৯ শতাংশই দান করে দিয়েছেন। অর্থের বিবেচনায় যার পরিমাণ ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
এ বছর আগস্ট মাসে প্রতিষ্ঠানটি তার কার্যক্রম শুরু করেছে। কার্যক্রম শুরুর অংশ হিসেবে ১৭ ও ১৮ আগস্ট শেয়ার বিক্রি শুরু করেছে চ্যান জাকারবার্গ ইনিশিয়েটিভ। আগামী তিন বছরের মধ্যে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের শেয়ার বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। আগস্টে ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৯০৫ টি শেয়ার বিক্রি করে সাড়ে ৯ কোটি মার্কিন ডলার নগদ অর্থ সংগ্রহও করেছেন তারা।

ফেসবুক মার্ক জাকারবার্গের একটি অভিনব ধারণার বিশ্বজয়ের প্রমাণ। একটি নতুন আইডিয়াকে পুঁজি করে যিনি বিশ্ব জয় করতে পারেন তার পক্ষেই সম্ভব আজকের পৃথিবীর অবয়ব পাল্টে দেওয়া। সম্ভব মানুষের অমিত সম্ভাবনাকে বিকশিত করা, রোগমুক্ত পৃথিবী উপহার দেওয়া, আগামী দিনের শিশুদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা এবং সব মিলিয়ে একটি উন্নত চমৎকার পৃথিবীর পথ উন্মোচন করা। যে পৃথিবী হবে সমতার যেখানে পৃথিবীর সব এলাকার সব মানুষ সব সুবিধার ভাগিদার হতে পারবে। বলতে পারবে, আমি সৃষ্টির সেরা জীব স্রষ্টার প্রতিনিধি এক অনন্য মানুষ। এ পৃথিবী আমার। যেখানে দরকার সেখানে যাবো যা প্রয়োজন তাই নেব। জাতি ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণ করবো।  

মার্ক জাকারবার্গ ও তার স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান তাদের একমাত্র কন্যা ম্যাক্সের জন্ম উপলক্ষ্যে সমতার যে স্বপ্ন দেখেছেন যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা হিংসাত্মক পৃথিবীর সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। তাদের এই মহান উদ্যোগ এই পৃথিবীতে কতটা সার্থক হবে অথবা আমাদের জীবদ্দশায় সমতার সেই পৃথিবী দেখে যেতে পারবো কিনা জানি না। তবে আজ তারা যে উদ্যোগ নিলেন তা হলো ঘন কালো মেঘের আকাশে উজ্জ্বল সূর্যের বীজ বপন। একদিন মেঘ কাটবেই সমতার সেই উজ্জ্বল সূর্য উঠবেই এবং তারই আলোতে পৃথিবীর মানুষ মার্ক জাকারবার্গ ও প্রিসিলা চ্যানকে দেখবে। কারণ মানুষের আন্তরিক ইচ্ছা সবকটাই পূরণ হয়। জাকারবার্গ ও চ্যানের আন্তরিক ইচ্ছাও পূরণ হবে। সময়ের ব্যাপার মাত্র।

যে কথা না বললেই নয় তা হলো পৃথিবীতে মার্ক জাকারবার্গের মতো অর্থশালী ক্ষমতাধর মানুষের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। কেউ কেউ তার চেয়েও অধিক অর্থশালী ক্ষমতাশালী। প্রয়োজন শুধু জাকারবার্গের মতো সুন্দর মনের। মার্ক জাকারবার্গ নিজেই বলেছেন, তার কল্পনার সেই সমতার পৃথিবীর জন্য দরকার দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগ, বিশেষজ্ঞদের পৃষ্ঠপোষকতা ও আশ্চর্য সব মানুষের কাঁধে কাঁধ মেলানো সহযোগিতা।

চ্যান-জাকারবার্গ দম্পতি তাদের সন্তান ম্যাক্স এর ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন। পৃথিবীর সব মানুষই তাই ভাবে। আমরাও ভাবি। তবে একটু ভিন্নভাবে। আমরা সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য অর্থ জমাতে চাই। এর জন্য খাদ্যে ভেজাল মেশাই। ফরমালিন মিশিয়ে ক্যানসারের মহামারী লাগিয়ে দেই, জীবন রক্ষাকারী ওষুধে দুই নম্বরি করে লাখ মানুষের জীবন হরণ করি। বনের রাজা হয়ে বন উজাড় করি। টাকা দিয়ে তোষক বানাই বালিশ বানাই। ন্যায় নীতির লঙ্ঘন করি। ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা সরিয়ে রেখে ঋণ খেলাপি হই। এ সবই করি নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কেন যেন আমরা ভাবতেও ভুলে যাই, যে সন্তানের জন্যে এত আয়োজন সেই সন্তানও ফরমালিন মেশানো খাবার খেয়ে যেকোনো দিন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে। ভেজাল ওষুধ লাখ মানুষের মতো তার জীবনও রক্ষা না করে হরণ করতে পারে। প্রকৃতির শাস্তি যে কত নির্মম!

চ্যান- জাকারবার্গও তাদের ৪৫ বিলিয়ন ডলার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যয়ের মতো সহজতর কাজটি করতে পারতেন। স্বার্থপর পৃথিবীর কাছে তারা অতি সহজেই হিরো হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তারা তা করেননি। তারা আগামী দিনের শিশুদের জন্যে সমতার এক চমৎকার পৃথিবী গড়ার মতো কঠিনতর কাজ হাতে নিয়েছেন।

স্বাগত জানাই এই মহান দম্পতিকে। প্রত্যাশা করি পৃথিবীর কল্যাণকামী সেই- ‘আশ্চর্য সব মানুষ’ খুব ধ্রুত সংখ্যায় বাড়ুক। কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে যাক পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। শীতল হোক উত্তপ্ত পৃথিবী। পৃথিবীর মানুষদের অমিত সম্ভাবনা বিকশিত হোক। মানুষদের জন্য রোগমুক্ত সমান সুযোগের উন্নততর চমৎকার সেই পৃথিবীর পথ উন্মোচিত হোক। যে স্বপ্ন কন্যা ম্যাক্সকে উপলক্ষ্য করে মার্ক জাকারবার্গ ও প্রিসিলা চ্যান দম্পতি দেখছেন, যে স্বপ্ন রোগের কাছে পরাজিত হয়ে ২০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণকারী বাংলার ক্ষণজন্মা কবি সুকান্ত দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন পূরণ হোক। আমরা পৃথিবীর স্বার্থপর মা-বাবারা চ্যান-জাকারবার্গ দম্পতি ও কবি সুকান্তের মতো উদার ও সৃষ্টিশীল হই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ