X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভারত-চীন সীমান্তে রণদামামা

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৫:৫৩আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৬:২৬

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ভারত স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭ সালে, আর চীনে কমিউনিস্টরা বিপ্লব শেষ করে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেছে ১৯৪৮ সালে। ভারতের মুখ্য প্রতিবেশী চীন এবং পাকিস্তান। জন্মলগ্ন থেকে ভারতের সাথে পাকিস্তানের বৈরিতা। সে বৈরিতার শেষ এখনও হয়নি। কিন্তু চীনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের জন্য ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।নেহরুর সমাজতন্ত্রের প্রতি দুর্বলতা ছিল, আর চীন সভ্যতা সম্পর্কে তিনি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। এ দুই কারণে নেহরু চীনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলার চেষ্টা করেছেন।
চীনারা কমিউনিস্ট হতে পারে, কিন্তু তারা যত না কমিউনিস্ট তার চেয়ে বেশী চৈনিক। বৃটিশের সময় থেকে সীমান্ত নিয়ে ভারতের সাথে চীনের বিরোধ ছিল । চীনারা কখনও নেহরুর আবেগের প্রতি কোনও দুর্বলতা দেখায়নি। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে বিরোধের সূত্রপাত। ১৯৬২ সালে এসে যুদ্ধ হলো। তারপর গত ৫৪ বছর কেটে গেছে, তার মাঝে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক, বাণিজ্য, মোটামুটি বাড়লেও পারস্পরিক বিশ্বাস তৈরি হয়নি একটুও। সাম্প্রতিক সময়ে সম্পর্ক এতই উদ্বেগ জনক হয়েছে যে, অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকরা আরেকবার চীন-ভারত লড়াই বেধে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। অবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীই দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধ ছিল তৃতীয় বিশ্বের দুটি বড় অনুন্নত, হতদরিদ্র দেশের মাঝে স্থানীয় সংঘর্ষ। তৎকালীন দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েট ইউনিয়নের কোনও প্রত্যক্ষ স্বার্থ জড়িত ছিল না। কিন্তু এখন চীন হচ্ছে বিশ্বশক্তি এবং আমেরিকার মুখ্য অর্থনৈতিক দোসর এবং ভারত হচ্ছে আমেরিকার নবলব্ধ স্ট্র্যাটেজিক সঙ্গী। তাছাড়া ভারত ও চীন উভয়েই পারমানবিক অস্ত্রধারী। সুতরাং চীন-ভারত সীমান্তে বারুদের গন্ধ পাওয়া গেলেই প্রতিবেশীসহ বিশ্বের সকল দেশই আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যায়।
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে ভারত পরাজিত হয়েছিল।সেই থেকে ভারত সতর্ক। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তখন সোভিয়েট ইউনিয়নের সাথে সামরিক সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। সোভিয়েট ইউনিয়ন সেই সময় চীনের উত্তর সীমান্তে বিপুল পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ করেছিল। চীন যদি সেই সময় পাকিস্তানকে সহযোগিতা করার জন্য ভারতের উত্তর সীমান্তে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতো, তবে সোভিয়েটের কাছ থেকে উপযুক্ত শিক্ষা পেতো। সে ভয়ে চীন নড়াচড়া করতে সাহস পায়নি।
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন লাদাখের কিছু (১২ হাজারবর্গ মাইল) অংশ এবং বর্তমান ভারতের অরুনাচল রাজ্য দখল করেছিল। কিন্তু  এক তরফা যুদ্ধ বিরতির সময় চীনারা অরুনাচল ছেড়ে চলে যায়। লাদাখের দখলকৃত জায়গা তখনও ছাড়েনি। সে জায়গা এখনও চীনের দখলে রয়েছে। এখন চীনারা বলছে, অরুনাচল হলো দক্ষিণ তিব্বত। অরুনাচলের ৩০,০০০ বর্গমাইল এলাকা চীনের। ১৯৪৮ সালেই তিব্বতের ওপর ভারত চীনের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিল। চীনের সাথে এখনও যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করায় ভারত সম্ভবত ক’দিন আগে মার্কিনীদের সাথে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে।
চীন সিনকিয়াং প্রদেশ থেকে পাকিস্তানের বেলুচিস্থান প্রদেশে-এর গোয়াদার বন্দর পর্যন্ত ইকোনমিক করিডোর নির্মাণ করেছে।  গোয়াদার বন্দরও গড়ে তুলেছে চীন। এখানে চীনারা নৌঘাঁটিও স্থাপন করেছে। ইকোনমিক করিডোর গেছে পাকিস্তানের দখলকৃত কাশ্মিরের ওপর দিয়ে। জি-২০ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্টকে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি বিষয়টি কর্ণপাত করেননি।
ভারত অরুনাচল রাজ্যে ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েন করেছে। চীন নাকি সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করেছে। হিমালয় অঞ্চলে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে কোনও যুদ্ধ সম্ভব নয়। এরপরও উভয় রাষ্ট্রের রণ-প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছে যে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সম্ভবতো ভারত চীনের পক্ষ থেকে সীমান্ত হামলার সম্ভাবনা দেখছে। ১৯৬২ সালে চীন ভারত আক্রমণ করেছিল সেপ্টেম্বর মাসেই। চীন সাগরের আশেপাশে অসংখ্য রণতরী অবস্থান নিয়ে আছে। আবার ভারতের সাথেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেকোনও সময় যেকোনও প্রয়োজনে ভারতীয় ঘাঁটি ব্যবহারের বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চীন কোনও সংঘাত গায়ে পড়ে লাগাবে বলে মনে হয় না।

রাশিয়ার সাথে চীনের সৎভাব রয়েছে সত্য, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনের বিষয় নিয়ে রাশিয়াতো নিজেই ব্যস্ত রয়েছে। রাশিয়ার কাছে যুদ্ধ করার মত সামরিক প্রস্তুতি থাকতে পাওর, কিন্তু অনেক ফ্রন্টে যুদ্ধ করার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই। আবার নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং জানুয়ারিতে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। অনুরূপ সময়ে আমেরিকাও কোনও সংঘাতে জড়াতে চাইবে বলে মনে হয় না।

ভারত আর চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র অনেক রয়েছে। তবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তান ও মায়ানমার চীন-ভারত সংঘর্ষে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পাকিস্তান চীনের সাথে সুগভীর সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে দীর্ঘ সময়ব্যাপী। আমেরিকা যখন বলেছিল পাকিস্তানের হাতে কোনও আণবিক অস্ত্র থাকা নিরাপদ নয়, তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী গিলানী চীন সফর করেছিলেন। আর চীনের প্রেসিডিন্ট তখন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন পাকিস্তানের ওপর আণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণের কোনও চাপ প্রয়োগ করলে চীন তা প্রতিহত করবে।

ভারতের সাথে পাকিস্তানের আজন্মের বৈরিতা। এখনও কাশ্মীর নিয়ে উভয় রাষ্ট্রের মাঝে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। আবার সিন্ধু নদীর পানি সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নাকি নিয়েছে ভারত। এমন কোনও পরিকল্পনা কার্যকর করতে গেলে ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ অনিবার্য। কারণ সিন্ধু নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি রয়েছে পাক-ভারতের মাঝে। ১৯৬০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের মাঝে সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল করাচিতে। সিন্ধুর পানি ভারত কাশ্মীর পয়েন্ট থেকে প্রত্যাহার করলে পাকিস্তান পানিশূন্য হয়ে যাবে এবং তার সেচ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে।এ পরিণতি পাকিস্তান কখনও মেনে নেবেনা।

সুতরাং চীন-ভারত যেকোনও সংঘর্ষে পাকিস্তান ওভারস্মার্ট  হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করবে। নেপালের সাথে ভারতের সম্পর্ক খুবই খারাপ। দীর্ঘ ছয় মাস ভারত নেপাল অবরোধ করে রেখেছিল। রাজিব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। দু’বারই চীন কার্গো বিমানে করে মালামাল পাঠিয়ে নেপালকে সংকট উত্তরণে সাহায্য করেছিল।

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর নেপালের রাজা নেপালের পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা বিষয় ভারতের হাতে দিতে চেয়েছিলেন ভুটানের মতো। কিন্তু নেহরু ও পেটেল তাতে সম্মত হননি।বরঞ্চ পেটেল বলেছিলেন, ‘বিশ্বে নেপাল একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র। আমরা চাই নেপাল পরিপূর্ণ স্বাধীন থাকুক।’ কিন্তু এখন ভারতের শাসকগোষ্ঠীর সম্ভবত মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। নেপাল তার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চীনকেই নির্ভরযোগ্য বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করবে। আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের  বৈরিতা বহুকালব্যাপী। চীন যেমন ম্যাক মোহন লাইনকে ভারত-চীনের সীমান্তের চিহ্ন হিসেবে মেনে নেয়নি,  তেমনি সীমান্তের চিহ্ন হিসেবে ডুরান্ট লাইনকেও আফগানিস্তান কখনও সীমান্তের চিহ্ন হিসেবে মানেনি। ভারতের সাথে আফগানিস্তানের ভাল সম্পর্ক বাদশা জহির শাহের সময় থেকে। অবশিষ্ট রইল বাংলাদেশ আর মায়ানমার। সামরিক জান্তার সময় থেকে চীন মায়ানমারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে বসে আছে।

সব চেয়ে বেশী সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। কারণ ভারত ও চীনের সাথে বাংলাদেশের মধুর সম্পর্ক রয়েছে।  ভারত-চীনের মাঝে কোনও সংঘর্ষ হলে বাংলাদেশের উচিৎ হবে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, ঠিক সে ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক একটি বিমান নিয়ে সকালে দিল্লী আর সন্ধ্যায় পিকিং-এ আনা-গোনা করে যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা করেছেন ১০ দিনব্যাপী। চীন একতরফাভাবে  যুদ্ধ বন্ধও করেছিল।  

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১৪ পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি
টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১৪ পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি
১৮ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন বিসমাহ মারুফ 
১৮ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন বিসমাহ মারুফ 
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ