X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের দেশে দায়িত্বশীলরা কেউই ভুল করেন না!

চিররঞ্জন সরকার
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৩:৫১আপডেট : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৩:৫৪

চিররঞ্জন সরকার আমরা কথায় কথায় বলি, মানুষ মাত্রই ভুল হয়। হ্যাঁ, ভুল তো হয়ই। ভুল মানুষেরই হয়। আমাদের দেশের মানুষের, বিশেষ করে দায়িত্ববান মানুষের যেন ভুলটা আরও বেশি বেশি হয়। কিন্তু এদেশে কেউ ভুল স্বীকার করেন না। প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা না, রাজনীতিবিদরা না, ব্যবসায়ীরা না, এমনকি বুদ্ধিজীবীরাও না।
তাহলে কি এদেশে কেউ ভুল করেন না? কোথাও কারও কোনও অবহেলা, গাফিলতি, দায়িত্বহীনতা কিছু নেই?
ঈদের আগে গাজীপুরে টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীতে টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড নামের একটি কারখানায় বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো। সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অনেকগুলো মানুষ পুড়ে মরলো। এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কারখানার মালিক,সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিদর্শক, মন্ত্রী বা প্রশাসনের কোনও কর্তাব্যক্তি কেউই দায় নেননি। কেউই এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ, ভুল স্বীকার কিংবা ক্ষমা চাননি।
আমাদের দেশে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কারখানায় নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় নিরীহ শ্রমিকরা নির্মমভাবে প্রাণ হারাচ্ছেন। অথচ দুর্ঘটনার জন্য কেউ দায়ী বা চিহ্নিত হচ্ছে না, কারও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হচ্ছে না। বয়লার বিস্ফোরণে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনাও ইদানীং প্রায়ই ঘটছে। এ ব্যাপারে কোনও প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে ছোট ছোট যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, তার বেশিরভাগই বয়লারভিত্তিক। শিল্প কারখানায় বয়লার একটি প্রধান যন্ত্র বা প্রাণ স্বরূপ। বড়, মাঝারি বা ছোট প্রায় সব কারখানাতেই বয়লার থাকে।
বাংলাদেশ শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়’ নামে একটি কারিগরী অধিদফতর আছে। প্রধান বয়লার পরিদর্শক এই অধিদফতর পরিচালনা করেন। বয়লারের নিবন্ধন দেওয়ার পাশাপাশি শিল্প কারখানার বয়লারের নিরাপদ চালনা ও সংশ্লিষ্ট জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এই অধিদফতরের কাজ। ১৯২৩ সালের সেই পুরনো আইন দিয়ে চালানো হচ্ছে বয়লার খাত। বয়লার আইনের পর ‘বয়লার রেগুলেশন’ তৈরি হয় ১৯৫১ সালে (সংশোধিত ২০০৭)। এরপর ১৯৫৩ সালের বয়লার অ্যাটেনডেন্টস রুলস (সংশোধিত ১৯৮৬), ১৯৬১ সালের বয়লার রুলস; তারপর থেকে সেই অনুযায়ী চলছে বাংলাদেশের বয়লার খাত।
বয়লার চালানোর দায়িত্বে যিনি থাকেন তাকে বয়লার অ্যাটেনডেন্ট বা বয়লার পরিচালক বলা হয়। এটি একটি দক্ষতামূলক কারিগরী কাজ হলেও আইন অনুযায়ী তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা মোটেও বাধ্যতামূলক নয়। বুয়েটের সহযোগিতায় প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয় প্রতিবছরই একটি পরীক্ষা নিয়ে থাকে। তাতে বছরে ৭০০-৮০০ জন পরিচালক এ সনদ নেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে ব্যবহৃত বিপুল সংখ্যক বয়লারের বিপরীতে সারা দেশে মাত্র ছয় জন পরিদর্শক রয়েছেন। দেশে তৈরি অসংখ্য ত্রুটিপূর্ণ বয়লার, অগণিত নিবন্ধনহীন বয়লার এবং অশিক্ষিত-অনভিজ্ঞ বয়লার অ্যাটেনডেন্টদের জন্য এই ছয় জন পরিদর্শকসহ অধিদফতরের মোট ৩২ জন কর্মকর্তা কর্মচারী কি যথেষ্ট? এ প্রশ্নের জবাব নেই। ঈদের দু’দিন আগে টঙ্গীতে যে মানুষগুলো মারা গেলেন, তাদের এই মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? এ প্রশ্নেরও কোনও জবাব নেই।
এতগুলো নিরীহ মানুষ মারা যাবার পরও কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। এই শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকের কোনও হদিস নেই। সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের কর্তা ব্যক্তিদের কোনও ভাবান্তর নেই। এমনকি শিল্প দফতরের মন্ত্রীরও কোনও আওয়াজ নেই। যেন এই অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের জন্য কারও কোনও ভুল নেই। দায় নেই। দায়িত্বও নেই!
দায়িত্বহীনতা শুধু কলকারখানার ক্ষেত্রেই নয়, অন্য অনেক ক্ষেত্রেই আছে। উপযুক্ত নীতি ও প্রকেটশনের অভাবে এবারের ঈদেও পশু ও চামড়া ব্যবসায়ীরা বিপুল অংকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। হঠাৎ করে চোরাই পথে ভারতীয় গরু আসায়, দেশের গরু পালনকারীরা এবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর দায় সরকারের ও প্রশাসনের। কাদের মাধ্যমে, কীভাবে শেষ সময়ে হাজার হাজার ভারতীয় গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করল? বিজিবি-পুলিশসহ সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কার পক্ষে, কী ভূমিকা পালন করল? এটা দেখার দায়িত্বই বা কার?

কোরবানির পশুর চামড়া নিয়েও তৈরি হয়েছে সংকট। লবণের বাজারে অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে চামড়ার দামে বিপর্যয় নেমেছে। গত ৫ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কমদামে বিক্রি হয়েছে পশুর চামড়া। কোনও যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই দেশে আকস্মিক লবণের দাম বেড়েছে।চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিপুল পরিমাণ লবণ প্রয়োজন হয়।লবণের দাম বাড়ার পাশাপাশি কৃত্রিম সংকট তৈরি হওয়ায় চামড়া সংরক্ষণ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এই লবণের দাম কেন বাড়লো, আদৌ বাড়ার কথা কিনা,এটা কি কৃত্রিম সংকট, নাকি লবণ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজি,এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সচিবরাও এ ব্যাপারে কিছু বলছেন না। যেন কিছুই হয়নি, লবণের দাম বাড়ার পেছনে কারোর কোনও ভূমিকা নেই, ভুল নেই, পাপ নেই, উদ্যোগ ও পরিকল্পনার অভাব নেই! যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে, ভালো হচ্ছে!

এবার একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। বাংলা ভাষার বরেণ্য সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একবার এক লেখায় মহাভুল করেছিলেন। এ জন্য তাকে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছিল। বাংলায় প্রগতিশীল মাহিষ্য সম্প্রদায় আর চাষি কৈবর্ত সম্প্রদায় যে আসলে এক ,সে সম্পর্কে তার তেমন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তারাশঙ্কর নিজেই বলেছেন, ‘ভুলটা আমারই। কৈবর্তদের ‘দাস’ ছাড়া অন্য কোনও পদবি আমি কখনও শুনিনি। সমাজের এক পাশে পরিত্যক্ত অবজ্ঞাত পড়ে থাকতেন তারা। মাহিষ্যদের মতো প্রভাবশালী মানুষদের সঙ্গে এরা যে একই গোত্রে পড়েন, সেই সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করা আর হয়ে ওঠেনি।’

‘সন্দীপন পাঠশালা’ উপন্যাস হিসাবে যতদিন পাঠকদের হাতে ছিল, মানুষের ক্ষোভটা ততো বোঝা যায়নি। বিপদ বাড়ল সে উপন্যাস সিনেমা হওয়ার পর। হলে মুক্তি পাওয়া মাত্র মাহিষ্য সমাজের একাংশ রীতিমতো চটে গেলেন। তারাশঙ্করের বাড়িতে কুৎসিত গালাগালি করা চিঠিপত্র আসতে লাগল। কেউ কেউ তো দস্তুরমতো হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠালেন। খবরের কাগজের চিঠিপত্র কলামে ক্ষোভ-বিক্ষোভের ছড়াছড়ি। ভেবেছেন কী তারাশঙ্কর? মাহিষ্যদের নামে যা খুশি লিখে পার পেয়ে যাবেন! তারাশঙ্কর বার বার বলে চললেন, চাষি কৈবর্ত নায়ককে তিনি অবজ্ঞা দেখাতে চাননি। বরং সমাজের যে অংশ ওদের তাচ্ছিল্য দেখায়, তাদেরই আচরণের প্রতিবাদ করেছেন। কে শোনে কার কথা। ক্ষোভ -বিক্ষোভ তখন অনেকটাই আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে।

অবস্থা শেষে এমন দাঁড়াল যে, হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হলেন স্বয়ং পুলিশ কমিশনার। হলে বসে সিনেমাটাও তিনি দেখলেন। রিপোর্ট দিলেন, যদি কোনও সম্প্রদায়ের আপত্তি করার থাকে তো সে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের, মাহিষ্যদের নয়।
সেই রিপোর্টেও কোনও লাভ হলো না।

এর পর ঘটল চরম অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা। হাওড়ায় এক অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে তিনি জনতার ক্ষোভের মুখে পড়লেন। তার গাড়িতে আক্রমণ করা হলো। জনতার মধ্য থেকে জিজ্ঞেস করল তারাশঙ্কর কে?

তিনি গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘বলুন কী বলছেন, আমি তারাশঙ্কর।’ সেই হিংস্র জনতার মধ্য থেকে একজন তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দিলো,‘এমন বই লিখতে তুমি কোথায় শিখলে বাছাধন?’

বলতে না বলতে তারাশঙ্করের মুখের ওপর প্রচণ্ড এক ঘুষি! ডান দিকে ঠোঁট কেটে দু’ফাঁক হয়ে গেল। কিছু বোঝার আগে আবার ঘুষি-ডান চোখের পাশে হনুর ওপর। চশমাটা ছিটকে গাড়ির মধ্যে পড়ে গেল। কিছু দেখতে পাচ্ছেন না তারাশঙ্কর। তারই মধ্যে আবার ঘুষি, আবার!

প্রবীণ সাহিত্যিকের জামা রক্তাক্ত, ঠোঁট, কপাল, মাথা থেকে রক্ত ঝরছে।

এরপর ক্রুদ্ধ জনতা এক সময় চলে যায়। পুলিশও আসে। পুলিশ এলাকার সবাইকে ধরে এনে তাকে যারা মেরেছে, তাদের শনাক্ত করতে বলে। তারাশঙ্কর তাদের চিনলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। যারা মার দিলো তাদের তিনি ক্ষমা করে দিলেন। কারণ? অনুতপ্ত তারাশঙ্কর বলছেন, অপরাধ তিনিই করেছেন, মাহিষ্যদের তো কোনও দোষ নেই। তারা তাকে ভালোবাসতো, শ্রদ্ধা করতো। তারই অজ্ঞানতার বশে ওদের মর্মে কোথাও একটা আঘাত লেগেছে; প্রত্যাঘাত করেছে ওরা তাই। এই তো স্বাভাবিক।

এ প্রসঙ্গে তারাশঙ্কর লিখেছেন, ‘ঘটনাটি আমার মুখের ওপর চিহ্ন রেখে গেছে। অন্তরে কোনও দাগ ফেলতে পারেনি। ভ্রান্তিরূপিণী সেদিন ভয়ঙ্করী মূর্তিতে দেখা দিয়ে আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ প্রসাদ দিয়ে গেছেন। আমি তাকে জাগ্রত করেছিলাম আমারই ভ্রান্তি দিয়ে।’

আমাদের মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী,শিল্পপতিরা যদি তারাশঙ্করের মত এমন করে নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারতেন এবং ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার মত মহৎ হতে পারতেন!

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উবারের ‘নো কমেন্টস’ এর পরে কমেন্টস
উবারের ‘নো কমেন্টস’ এর পরে কমেন্টস
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ