X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

রামপাল নিয়ে আরও কিছু কথা

আনিস আলমগীর
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৯:১২আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১২:৪৫

আনিস আলমগীর রামপাল নিয়ে আবারও কলম ধরছি। প্রথম কলামে রামপাল কয়লা ভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বার্তা বলেছি। এবারও বলবো। কারণ উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ এর বিকল্প নেই। আমাদের ছোট দেশ, জায়গা কম। সুতরাং কথায় কথায় স্থান পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে জায়গাটা নদীর ধারে হওয়া প্রয়োজন। কারণ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান কাঁচামাল হলো কয়লা। কথাগুলো পুরানো মনে হতে পারে কিন্তু এটাই রামপালের প্রধান বাস্তবতা।
মহেশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হলে ১ কোটি টন কয়লার প্রয়োজন হবে। তার জন্য একটা বন্দর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হবে। কোনও সমুদ্রগামী জাহাজতো নদীর তীরে দাঁড়িয়ে মালামাল খালাস করতে পারে না। মালামাল খালাসের জন্য একটা আধুনিক যন্ত্রচালিত ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন। সুতরাং মহেশখালীর মাদার বাড়িতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে বন্দর ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে। কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন।
পায়ারা বন্দরও গড়ে তুলতে হচ্ছে পটুয়াখালিতে পরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য। অবশ্য পায়রাতে বহুমুখী ব্যবহারের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করে সমৃদ্ধ করা হলে এ বন্দরটা বহুজাতিক ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা যাবে। ভারত, নেপাল আর ভুটান তাদের আমদানি রফতানির জন্যও এই বন্দরটা ব্যবহার করতে পারবে।
পূর্ব ভারতের একমাত্র বন্দর হলো কলকাতা বন্দর। হুগলির নাব্যতা কমে যাওয়ায় এখন বন্দরটি হলদিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। হলদিয়াও সমুদ্র থেকে ৫০/৬০ মাইল ভেতরে। মূলত হুগলির খারিটা বন্দরের উপযুক্ততা হারিয়েছে। সারা হুগলি নদীটাই নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। হুগলির উভয় পাড়ে বিভিন্ন শহর আর গত সাড়ে তিনশত বছর ধরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিল্প কারখানা নদীটাকে বিষাক্ত ও ভরাট করে ফেলেছে। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে গঙ্গা থেকে একটা পানি প্রবাহ হুগলীতে ফেলে নাব্যতা বাড়ানোর চেষ্টাও করা হয়েছিল কিন্তু তাও কার্যকরী হয়নি। সুতরাং পূর্ব ভারত এখন ধীরে ধীরে তার নৌপথের বিদেশ-বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশের পায়রা বা মংলা বন্দরের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।

ইউরোপের রোটারডাম বন্দর আটটি জাতি ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশ খনিজ সম্পদের কোনও প্রাচুর্য্য নেই। সুতরাং নব নব আয়ের উৎস তৈরি করতে না পারলে ১৬ কোটি মানুষের এ জাতিটা চলবে কি করে!

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নতুন কোনও বন্দর গড়ে তুলতে হবে না কারণ মংলা বন্দরতো তার কাছেই রয়েছে। মংলা বন্দরের মোট ক্যাপাসিটির মাত্র ৩৫% ব্যবহৃত হয়। রামপালের কয়লা আসা আরম্ভ হলে তার কেপাসিটির ইউটিলাইজেশনও বাড়বে এবং বন্দরও আরও কর্মচঞ্চল হবে। তেল, গ্যাস, খনিজ ও বন্দর রক্ষা কমিটি বলেছে, রামপালে মাত্র ৬০০ লোকের কর্মসংস্থান হবে। কয়লা আমদানির পেছনে আরও বহুলোকের কর্মসংস্থান হবে। কারণ হীরণ পয়েন্ট থেকে কয়লা মাদার ভেসেল থেকে লাইটার ভেসেলে আনলোড করতে বহুলোকের প্রয়োজন হবে। মংলা বন্দরে কয়লার শিপিং এজেন্ট, ক্লিয়ারিং এজেন্ট, স্টিভেডরিং এজেন্ট থাকবে- তাদেরও তো কর্মচারী রয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে গেলে এ বিদ্যুৎ দিয়ে শিল্প গড়ে উঠলে সেখানে তো লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।

ছোট দেশ বেশি মানুষ সুতরাং এদেশের বুদ্ধিজীবী মহলকে দেশের মঙ্গল-অমঙ্গল নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির’ নেতারা যে রামপাল ও সুন্দরবন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছেন এটা কোনও অযৌক্তিক বিষয় নয়। তবে চিন্তাটা বাস্তবতা নিরিখে হওয়া বাঞ্ছনীয়।

প্রাচীন পুঁথি পুস্তিকা ঘেটে দেখলাম, দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে বরিশাল পর্যন্ত অঞ্চলকে সুন্দরবন বলা হয়েছে।

সুন্দরবন সমুদ্রের কুলবর্তী এলাকা। নদীর বাহিত পলিতে গঠিত হয়েছে অঞ্চলটি। গঠনকালে অঞ্চলটি অসংখ্য দ্বীপে বিভক্ত ছিল। কিন্তু কালক্রমে মোহনা অঞ্চলে নদীবাহিত পলিমাটির অত্যধিক সঞ্চয় ও নদীপ্রবাহের বহুশাখা মজে যাওয়ায় সমগ্র অঞ্চলটি কোথাও কোথাও ব্যতিক্রম ছাড়া একটি প্রায় নিরবিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে পরিণত হয়। এ অঞ্চলটির বয়স কত নির্ণয় করা কঠিন।
তবে প্রত্নতত্ত্ববিদদের কল্যাণে এ অঞ্চলে নব্য প্রস্তর যুগের অস্ত্রও পাওয়া গেছে। সান বাধানো পুকুরের ঘাট, দেবমূর্তিও সংগৃহিত হয়েছে। পূর্বে সমুদ্রতীরে, নদীর তীরে সহজ যোগাযোগের জন্য জনবসতি গড়ে উঠতো। নির্মলেন্দু মুখোপাধ্যায় তার  ‘সুন্দরবনের মনি অববাহিকা’ নামক গ্রন্থে আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে নব্য প্রস্তর যুগের শেষপর্ব থেকে সুন্দরবন অঞ্চলে মানুষের আনাগোনা আরম্ভ হয়েছিল। এখানে জনবসতি ছিল এ সম্পর্কে গবেষকদের দ্বিমত নেই। তবে কতকাল আগে থেকে এ বসতি আরম্ভ হয়েছিল তা নির্ণয় করা কঠিন।
বইটিতে বলা হয়েছে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেছেন নব্য প্রস্তর যুগের যে হাতিয়ারগুলো পাওয়া গেছে তার সঙ্গে রাজমহল পাহাড়ে আবিষ্কৃত হাতিয়ারগুলো প্রায় একই রকম। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন, জলে পড়ে গিয়ে হাতিয়ারগুলো স্রোতের সঙ্গে এ পর্যন্ত এসেছে। সম্ভবত তার অভিমতটাই সঠিক। জনবসতি উঠে যাওয়ার কারণ হিসাবে কেউ কেউ বলেছেন ভূমি ধসের কারণে জনবসতি উঠে গেছে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের উৎপাতে জনবসতি সরে গেছে। মূলত ব্রিটিশের সময়েই জনবসতিহীন বিরাণ সমুদ্রকুলে বনভূমি গড়ে উঠেছিল।
১৮১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ডবলিউ-ই-মরিসন্স হুগলী থেকে পশুর নদী পর্যন্ত জরিপ কাজ পরিচালনা করেছিলেন। ২৪ পরগনা জেলার সহকারী কালেকটর মিস্টার স্কট-এর ওপর দায়িত্ব ছিল সুন্দরবনের জমিকে চাষযোগ্য করার। তা হলে দেখা যাচ্ছে ইংরেজ সরকারও চাননি যে সুন্দরবনে বন গড়ে উঠুক। যাহোক এখন বাস্তব সত্য যে সুন্দরবনে এখন ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বিদ্যমান। পূর্বে যখন এ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ছিল না তখন কি বাংলাদেশে মানুষ বসবাস করেনি? তাদের বসবাসের কোনও অসুবিধা তখন না হয়ে থাকলে এখন হবে কেন?
আকবরের সময়ে অত্র অঞ্চলে একবার ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। আইনে আকবরিতে আছে চন্দ্রদ্বীপে নাকি সাইক্লোনের প্রভাবে খড়-দুর্বাও ছিল না। চন্দ্রদ্বীপ মানে এখনকার বরিশাল। তখন বৃহত্তম ফরিদপুর জেলা পরিপূর্ণভাবে জেগে না ওঠায় বরিশাল মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক ছিল এবং এটাকে তখন চন্দ্রদ্বীপ বলা হতো। জলোচ্ছ্বাস বছর বছর হয় না।
তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির অভিযোগের উত্তর দেওয়ার জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই সম্প্রতি  গণভবনে সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন এবং উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে, বনে, শহরের পাশে স্থাপিত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছবি সাংবাদিকদের দেখিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন যে তিনি শতভাগ নিশ্চিত এই কয়লাকেন্দ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের কোনও ক্ষতি হবে না। এমনকি জীববৈচিত্রেরও কোনও ক্ষতি হবে না। প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান। তিনিই এ প্রজেক্ট করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

এটা সবাই স্বীকার করবেন এ প্রজেক্টের কারণে সুন্দরবনের কোনও ক্ষতি হলে আমার বা তেল গ্যাস রক্ষা কমিটির সদস্যদের কোনও ব্যক্তিগত ক্ষতি হবে না। ১৬ কোটি মানুষের যা ক্ষতি হবে তাতে আমরাও অংশীদার হবো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কি কোনও ক্ষতি হবে? অবশ্যই। শেখ হাসিনা নিজে রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির শিকারও হতে পারেন। চরম পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে আওয়ামী লীগের। এতবড় ঝুঁকি প্রধানমন্ত্রী নিতে যাবেন কেন! তিনি কি রামপাল বিরোধীদের থেকে রাজনীতি কম বুঝেন, নাকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশপ্রেম ওদের কারও থেকে কম?

এ বাস্তবতা যারা অনুধাবন করতে পারেন না, তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন কিংবা আন্দোলনের দিবা-স্বপ্ন দেখা লোক। তাদের উচিত বাস্তবতা উপলব্ধি করে এসব আন্দোলন থেকে বিরত হন।

পটুয়াখালীতে অনুরূপ আর একটা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ আরম্ভ হয়েছে। সেখানেও কারা নাকি জনগণকে আতংকিত করার জন্য লিফলেট বিতরণ করেছে। কোথাও যদি বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে না পারে তবে দেশ বিদ্যুৎ পাবে কোথায়! চীনের সঙ্গে অংশীদারিত্বে পটুয়াখালীর প্রজেক্টের কাজ খুব দ্রুত গতিতে চলছে। আশা করি কেউ আর দেশের উন্নয়নের কাজে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করবেন না।

চীন ও ভারতের ডজন ডজন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে।  তারা যথাক্রমে বিশ্বের এক নম্বর এবং তিন নম্বর বিদুৎ উৎপাদনকারী দেশ, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৩। অন্যদিকে এনার্জি খরচের কারণে পৃথিবীর বুকে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনকারী দেশের তালিকায় চীন রয়েছে শীর্ষে আর ভারত রয়েছে চার নম্বর অবস্থানে, যেখানে পরিবেশ ধ্বংসে বাংলাদেশের অবস্থান খুঁজে পাওয়াই যাচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভূষিত হন ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে। চীন ও ভারততো বিরান হয়ে যায়নি, তাহলে বাংলাদেশে পরিবেশ ধ্বংসের নামে এতো আহাজারি কেন!

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
উপজেলা নির্বাচনদলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ