X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কার হাতে স্টিয়ারিং?

আমীন আল রশীদ
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৯:০৯আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৯:২০

আমীন আল রশীদচিড়িয়াখানা থেকে বাসে উঠেছি। সিটিং বাস। ভাড়া বেশি। বাসের চেহারা-সুরতও ভালো। ফলে এটা ধরে নেওয়াই সঙ্গত যে, এই গাড়ির চালক প্রশিক্ষিত এবং তিনি বেপরোয়া চালাবেন না। কিন্তু এই ধারণা পাল্টে দিয়ে মিরপুর এক নম্বর গোল চত্বর থেকে পাশাপাশি আরেকটা গাড়ির সঙ্গে আমাদের বাসটি এমন বেপরোয়া গতিতে পাল্লা দিলো যে, আনসার ক্যাম্প স্টপেজের কিছু আগে আমাদের গাড়িটা তার পাশে থাকা বাসের ডানপাশের জানালার কয়েকটি গ্লাস চুরমার করে নিয়ে গেলো। দুই বাসের যাত্রীরাই চিৎকার শুরু করলেন। তারপরও আমাদের বাস থামছে না। পাশের বাসটিকে অনেকটা টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেলো। কিছুদূর যাওয়ার পর বাসটিকে থামালো ক্ষতিগ্রস্ত বাসের হেলপার। গালি, পাল্টা গালি, ক্ষতিপূরণ দাবি। দফারফা হয় না কিছুতেই। দুই বাসের যাত্রীরাই বিরক্ত। ক্ষুব্ধ। কেউ কেউ বাস থেকে নেমেও গেলেন। অবশেষে আমাদের বাসের কনডাক্টর ক্ষতিগ্রস্ত বাসের কনডা্‌ক্টরকে ক্ষতিপূরণ দিলেন। তারপর আমাদের বাস চললো।
ঢাকা শহরে যারা প্রতিনিয়ত পাবলিক বাসে চলাফেরা করেন, এরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তাদের যেতে হয়। খোদ রাজধানীর বুকেই যখন এই চিত্র, তখন ঈদের সময় মহাসড়কে এই প্রতিযোগিতার চেহারা কী দাঁড়াতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। অনেক সময়ই যার পরিণাম মৃত্যু অথবা পঙ্গুত্ব।
এবার ঈদুল আজহার পর এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে দেড় শতাধিক মানুষের। দৈনিক গড়ে অন্তত ১৫জন। এর মধ্যে কেউ বিধবা হয়েছেন, কেউ সন্তানহারা, কেউ হারিয়েছেন বাবা-মা, কেউ প্রিয়তমা স্ত্রীকে। কেউ হারিয়েছেন তার প্রিয় বন্ধুকে। অর্থের হিসাব যে ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব নয়।
সড়কে মৃত্যু এমনই যে, এর কোনও পূর্বাভাষ নেই। যে মানুষটি একটু আগেও পাশের সিটের লোকের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করলেন, মুহূর্তেই তিনি লাশ, অথবা পঙ্গু। এ এক নির্মম বাস্তবতা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আবু সুফিয়ান বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন। নতুন বউ নিয়ে আসবেন বাড়িতে। অপেক্ষায় ছিল স্বজন প্রতিবেশী, সাজানো হয়েছিল বাসর ঘর, বড় বড় পাত্রে রান্না হচ্ছিল জিভে জল আনা খাবার। এক মুহূর্তেই সব পরিণত হলো বিষাদে। হয়তো চালকের অসতর্কতা কিংবা বেপরোয়া মনোভাব কেড়ে নেয় ৮টি প্রাণ। ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এই ঘটনা ঘটে। যার বা যাদের কারণে এই ঘটনা ঘটলো, এত মানুষের মৃত্যু হলো, তাদের স্ত্রী বা সন্তানও একদিন এই পরিণতির শিকার হবেন না, তাও কোনও নিশ্চয়তা নেই।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ ৫জন। এ রকম আলোচিত সব দুর্ঘটনার পরই মামলা হয়েছে। কিন্তু বিচার আটকে আছে আইনি জটিলতায়। জামিন নিয়ে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ান অভিযুক্ত গাড়ির চালক। বিচার তো দূরে থাক, ঘটনার পরে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও কিছুদিন পর ফের তাদের হাতেই স্টিয়ারিং। তাদের হাতেই শত শত মানুষের প্রাণ।

বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আআরআই)-এর গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা; যা দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২ শতাংশেরও বেশি।

দুর্ঘটনায় সরাসরি ক্ষতির মধ্যে রয়েছে হিসেবে মানুষের জীবননাশ, তার কর্মক্ষমতানষ্ট হওয়া, চিকিৎসা খরচ বহন করতে গিয়ে পথে বসা ইত্যাদি। এর বাইরে পরোক্ষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির মানসিক আতঙ্ক। বড় কোনও দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার পর বেঁচে থাকলেও সারাজীবন এক ধরনের ট্রমার মধ্যে তাকে থাকতে হয়। আবার দুর্ঘটনায় পঙ্গু বা কর্মহীন হয়ে গেলে একটা পর্যায়ে কেউ তার খোঁজও নেয় না।

কোনও অসচ্ছল এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি যদি দুর্ঘটনায় পড়ে নিহত বা কর্মহীন হয়ে পড়েন, তখন ওই পুরো পরিবারের পাশে অনেক সময়ই দাঁড়ানোর কেউ থাকে না। বড়লোক আত্মীয়-স্বজন সহায়তা করলে সেটি খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। অন্যথায় কী নিদারুণ কষ্টে ওই পরিবারের সদস্যদের দিনযাপন করতে হয়, সেটি বাইরে থাকা আন্দাজ করা কঠিন। রাষ্ট্রও এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ায় না বা সেই সক্ষমতাও হয়তো রাষ্ট্রের এখনও তৈরি হয়নি।

প্রতিদিনই সড়কে মৃত্যু। প্রতিদিনই সংবাদ। বিশ্লেষণ। বিশেষজ্ঞ মতামত। কিন্তু আখেরে ফলাফল শূন্য। এত এত আন্দোলন, মানববন্ধন, চিৎকার চেঁচামেচি—কোনও কিছুতেই সড়কে মৃত্যু কমানো যাচ্ছে না। এতদিন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এর দায়ভারও নিতেন না। ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মিট দ্য প্রেসে প্রথমবারের মতো সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বীকার করেন, সড়ক দুর্ঘটনার দায় তিনি এড়াতে পারেন না। কিন্তু এরকম কোনও অপরাধের দায়ভার নিয়ে কোনও মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, তার নজির আমাদের সামনে নেই। এমনকি সংবিধানের শপথ ভাঙার পরও তারা স্বপদে বহাল থাকেন। 

আবার চালকরাও সংঘবদ্ধ। সবাই কোনও না কোনও শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত। বেশির ভাগেরই কোনও আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। পাবলিক পরিবহনের ড্রাইভিং এখন করতে করতে শেখার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা শহরের ফার্মগেট থেকে নীলক্ষেত বা অন্যান্য রুটে যেসব লেগুনা চলে, সেগুলোর না আছে নিবন্ধন না আছে নিয়ন্ত্রণ। ফলে অল্পবয়সী চালকরা যেভাবে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালান, তাতে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা হয়; যার সব খবর গণমাধ্যমে আসে না। কারণ মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত এখন সড়ক দুর্ঘটনা আর কোনও খবর নয়।

প্রশ্ন হলো আর কত হাজার মানুষ মরলে আমাদের মনে হবে এনাফ ইজ এনাফ? কে থামাবে এই মৃত্যু? কেন থামছে না এই গণহত্যা? বলা হয়, আইনের পদ্ধতিগত ত্রুটি, তদন্তের দুর্বলতা আর বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে সড়কে হত্যার কোনও বিচার হয় না। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তির বিধান যেমন নেই, তেমনি রয়েছে জামিনের সুযোগ। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচার করতে হলে আইন সংশোধনেরও দাবি দীর্ঘদিনের।

তবে কঠোর আইনের চেয়েও বেশি প্রয়োজন মানবিক বোধ। যে লোকেদের হাতে আমাদের জীবন, গণপরিবহনের যে চালকেরা আমাদের নিয়ে যান মাইলের পর মাইল; গভীর রাতে ফাঁকা মহাসড়কের যে চালক চল্লিশজন মানুষকে বহন করে নিয়ে যান, তার দায়িত্ববোধ, মানবিকতাবোধ কতুটুক আছে, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ কতুটুক আছে, সেই হিসাব আমরা কখনও করিনি। এতগুলো মানুষের জীবন যার হাতে, সেই মানুষটিকে জীবন ও জীবনের মূল্য সম্পর্কে কখনও জ্ঞান দেওয়া হয়েছে? সরকারি-বেসরকারি কোনও প্রতিষ্ঠান কখনও কি এই চালকদের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আন্তরিকভাবে কথা বলেছে? দুর্ঘটনার পরে আমরা চালককে খুব দোষারোপ করি। তার ফাঁসির দাবি জানাই। কিন্তু যে মানুষটির হাতে আমরা স্টিয়ারিং তুলে দিচ্ছি, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, পারিবারিক মূল্যবোধ ইত্যাদি যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা কখনও ভেবেছে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র?

লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ