X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস থেকে কাউকে মুছে ফেলা যায় না

গোলাম মোর্তোজা
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২০:০০আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২০:০৩

গোলাম মোর্তোজা এখন ‘সময়’ অনুকূল নয়, এই লেখাটি লেখার জন্যে। হয়তো অনুকূল নয় বলেই, লেখার তাগিদ অনুভব করছি। আমরা বেড়ে উঠেছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে। ‘বিকৃত’ ইতিহাসের সময়ে। প্রথমাবস্থায় প্রকৃত ইতিহাস জানার সুযোগ হয়নি। জেনেছি অনেক পরে। কখনও কখনও মনে হয়েছে ইতিহাস বিকৃতির ধারা থেকে আমরা বের হচ্ছি। বিষয়টি প্রশ্নহীন থাকেনি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো কঠিনতর এবং তাৎপর্যপূর্ণ বিচার করছেন বর্তমান সরকার। ঠিক সেই সময়েই আবার আরেকটি বিতর্ক সামনে আনা হলো। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। কেন কোন প্রেক্ষাপটে পদক প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো, তার যৌক্তিকতা... প্রভৃতি বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
১. জিয়াউর রহমানের ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো, উচ্চ আদালত তার শাসনকালকে অবৈধ ঘোষণা করেছে বলে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশের টালমাটাল অবস্থার একপর্যায়ে ক্ষমতায় আসেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করে সামরিক বাহিনীর একটি অংশ। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, ডেপুটি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান, জিওসি খালেদ মোশারফসহ কেউ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার উদ্যোগ নেননি। জিয়াউর রহমান যেহেতু এই ঘটনার বেনিফিশিয়ারি হিসেবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন, রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, ফলে তাকেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জন্যে দায়ী করা হয়। যদিও সেনাপ্রধান হিসেবে মূল দায় শফিউল্লাহর ওপরই পড়ার কথা। যেহেতু পরবর্তীতে তিনি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন, তাই হয়ত তাকে সেভাবে দায়ী করা হয় না। দায়ী করা হয় জিয়াউর রহমানকে। এসব বিতর্ক ছিল, আছে, থাকবে। তথ্য-প্রমাণ দিয়ে জিয়াউর রহমানকে যেমন দায়ী করা সহজ নয়, আবার পুরো দায় এড়ানোরও সুযোগ নেই। ক্ষমতায় থাকাকালীন একের পর এক ক্যু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের নির্দয়ভাবে প্রাণদণ্ড দিয়ে ক্যু মোকাবিলা করেছেন জিয়াউর রহমান। এ কারণেও তিনি সমালোচিত।
পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের শাসনকালকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই যুক্তিতে তার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। জিয়াউর রহমানই ‘একুশে পদক’ এবং স্বাধীনতা পুরস্কার প্রবর্তন করেছিলেন। ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা। জিয়াউর রহমানের শাসনকালকে অবৈধ ঘোষণা করা হলেও, তার প্রবর্তিত ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ ‘একুশে পদক’ প্রদান করা অব্যাহত আছে। দেশের অনেক গুণীজনকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। আবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শর্ষিনার পীরকেও ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। যা মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তথা দেশের স্বাধীনতার প্রতি চরম অবমাননার শামিল।
শর্ষিনার পীরের সঙ্গেই ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছিল ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও মুনীর চৌধুরীর মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বদেরও।
বাংলাদেশ বিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন জিয়াউর রহমান, রাজাকার গোলাম আযমের পুনর্বাসন করেছেন।
সুতরাং সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক, নিন্দা-প্রশংসা সবই জিয়াউর রহমানকে নিয়ে হবে, সেটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। এর প্রেক্ষিতে তাকে দেওয়া ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রত্যাহার করা যায় কি না, প্রত্যাহার করা কতটা যৌক্তিক?
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আরেকটি অভিযোগ, জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু যেহেতু জাতির জনক, তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার কিছু নেই। প্রতিবাদ স্বরূপ আওয়ামী লীগ এই পুরস্কার গ্রহণ করেননি। মনে করি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন আওয়ামী নেতৃবৃন্দ। বিষয়টি এখানে শেষ হলেই ভালো হতো। জিয়ার স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেওয়ার আদৌ কোনও প্রয়োজন ছিল না।
২. স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর জিয়ার কবর সংসদ ভবন এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার কথাও আলোচনায় আছে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার চন্দ্রিমা উদ্যানে ঢোকার ঝুলন্ত ব্রিজটি সরিয়ে নিয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেখানে কংক্রিটের ব্রিজ বানিয়েছে, যাতে আর সরিয়ে নেওয়া না যায়।
প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহার করে বা কবর সরিয়ে নিলে আওয়ামী লীগের কী লাভ হবে, বিএনপির কী ক্ষতি হবে? এভাবে জিয়াউর রহমানকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে কি না? জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তা প্রমাণ করা যাবে কিনা?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের মূল্যায়ন নিশ্চয়ই নির্মোহভাবে করতে হবে। লেখার শুরুতে যা বলেছি, তা আরও বিস্তৃতভাবে আসবে। সেই মূল্যায়ন যত কঠিনই হোক, ১৯৭১ সালের মেজর জিয়াকে অস্বীকার করা যাবে না। জিয়াউর রহমানের শাসনকাল হাজারবার অবৈধ ঘোষণা করা হলেও, মেজর জিয়ার ১৯৭১ সালের অবদান মিথ্যা হয়ে যাবে না, স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহার বা কবর সরিয়ে নিলেও।
১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্যে গঠিত ১নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন জিয়াউর রহমান। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১১নং সেক্টরের কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। তার অধীনের সৈনিক-মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে অনেকগুলো যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্যে।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ মেজর জিয়া চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। বিএনপি যেভাবে বলতে চায় ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দিয়েছিলেন, তা সত্য তথ্য নির্ভর বক্তব্য নয়। সেই সময় মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার মতো কেউ ছিলেন না। বাঙালির প্রশ্নহীন নেতা বঙ্গবন্ধুর নামেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। ‘পাঠ করেছিলেন’ বললে গুরুত্ব মোটেই কমে যায় না। এই ‘পাঠ করাটা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। যা যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী বিচক্ষণ রাজনীতিক তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতাও স্বাধীনতার পর তার লিখিত বক্তব্যে স্বীকার করেছেন।
সেক্টর কমান্ডার, জেড ফোর্সের অধিনায়ক, স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ, বীর উত্তম খেতাব- সবকিছু মিথ্যা? প্রমাণ করা যাবে? তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কত বড় প্রশ্ন উঠবে?
‘জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে মেজর জিয়া বিদ্রোহ করেছিলেন’- এই বক্তব্যের পক্ষে তথ্য নির্ভর কোনও প্রমাণ নেই। এটা নেহাতই অসত্য রাজনৈতিক বক্তব্য।
ইতিহাসের যে অবস্থানে জিয়াউর রহমানের থাকার কথা, তিনি সেখানেই থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধ করেননি বা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহার বা কবর সরিয়ে নিয়ে, সত্য ইতিহাসকে মিথ্যায় পরিণত করা যাবে না।
কেউ পারবেন না, কেউ পারেননি।
৩. ইতিহাসের সত্য যদি মিথ্যায় পরিণত করা যেত, ইতিহাস থেকে যদি কারও নাম মুছে ফেলা যেত, বঙ্গবন্ধুর নাম কোথাও থাকত না। দীর্ঘ ২১ বছর এক নাগারে চেষ্টা হয়েছে ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার। ৭ মার্চের ভাষণ, পৃথিবীর ইতিহাসের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ। সেই ভাষণ শুনতে দেওয়া হয়নি। পাঠ্য পুস্তক বিকৃত করা হয়েছে। কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম-গন্ধ রাখা হয়নি। এরশাদের সময়ের একটি ঘটনা। এমআর আখতার মুকুলের ‘আমি বিজয় দেখেছি’ বইটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিটিভিতে। আলোচক কে ছিলেন মনে নেই। মনে আছে, আলোচক বইয়ের প্রচ্ছদের মাঝখানে বুড়ো আঙুল এমনভাবে রেখেছিলেন যাতে বঙ্গবন্ধুর ছবিটি দেখা না যায়। প্রচ্ছদের মাঝখানে ছিল বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি।
হাত দিয়ে ঢেকে রাখা বঙ্গবন্ধু, ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা বঙ্গবন্ধু, কত বড় সত্য হয়ে, কত শক্তিশালীভাবে ফিরে এসেছেন, তা কারোরই অজানা নয়।
বঙ্গবন্ধু অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা। তার দেশ পরিচালনা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে। তার সঙ্গে জিয়াউর রহমান কেন, কারোরই তুলনা করা যাবে না। তুলনা করা উচিত নয়। সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন... সবাই যার যার অবস্থানে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জিয়াউর রহমানও থাকবেন তার অবস্থানে। অপবাদ দিলে, অস্বীকার করলে, মুছে ফেলার চেষ্টা হলে, ফিরে আসবেন আরও বড়ভাবে।
পুরস্কার প্রত্যাহার, কবর সরিয়ে নেওয়ার মতো অনাবশ্যক বিতর্ক তৈরি করে, প্রকারান্তরে জিয়াউর রহমানকে রাজনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে।
জিয়াউর রহমানকে নিয়ে সব তাত্ত্বিক সমালোচনামূলক মূল্যায়নের পরেও জনমানুষের একটি মূল্যায়ন আছে। স্বীকার করি বা না করি সত্য এই যে, জনমানুষের কাছে জিয়াউর রহমানের একটা ইতিবাচক গ্রহণযোগ্য ইমেজ আছে। সেই ইমেজ এই প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করতে চাইলে, ফল উল্টো হতে বাধ্য।
ইতিহাস থেকে কাউকে মুছে ফেলা যায় না। কেউ কারও স্থান দখল করতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুর স্থান দখল তো দূরের কথা, কারও পক্ষে কাছাকাছিও যাওয়া সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর গড়া রাজনৈতিক দল, ইতিহাস থেকে কাউকে মুছে ফেলার পেছনে সময় ব্যয় করছে, ভাবতে কষ্ট হয়।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ