X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল

প্রভাষ আমিন
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৬:২০আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৬:২৫

প্রভাষ আমিন একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল। ব্যথায় কাতর বাঘ আহা-উহু করছিল দেখে বকের খুব মায়া হলো। বক ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে বললো, মহারাজ, আপনার কি কোনও সমস্যা হচ্ছে? আমি কি কোনও সাহায্য করতে পারি? কোকাতে কোকাতে বাঘ বললো, আমার গলায় কাঁটা ফুটেছে। তোমার লম্বা চঞ্চু দিয়ে আমার কাঁটা বের করে দাও। আমি তোমাকে পুরস্কার দেবো। পুরস্কারের লোভে বক রাজি হয়ে গেলো। বাঘ হা করলে বক তার লম্বা ঠোঁট দিয়ে কাঁটাটি বের করে আনলো। বাঘেরও ব্যথা উপশম হলো এবং ফিরে এলো স্বমূর্তিতে। বক পুরস্কার চাইতেই বাঘ হুঙ্কার দিল, বাঘের গলায় মাথা ঢুকিয়ে আবার তা আস্ত অবস্থায় ফিরে পেয়েছিস। এটা কি যথেষ্ট পুরস্কার মনে হচ্ছে না?
গত বৃহস্পতিবার রাতে যুবলীগ নেতা ইউসুফ সরদার সোহেল গুলশান থেকে বনানী ২ নম্বর রোডে যাওয়ার জন্য রিকশা ভাড়া করেন। ভাড়া ঠিক করা হয় ৪০ টাকা। কিন্তু বনানী ২ নম্বর রোডে নেমে ভাড়া না দিয়েই হেঁটে চলে যাচ্ছিলেন। রিকশা চালক কবির হোসেন ভাড়া চাইতেই ক্ষেপে যান যুবলীগ নেতা। একজন যুবলীগ নেতা তার রিকশায় চড়েছেন, এতেই তো সন্তুষ্ট হওয়া উচিত ছিল কবির হোসেনের। তার ওপর আবার ভাড়া চাইছে। এই বেয়াদবিটা সহ্য হয়নি সোহেলের। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে কবিরের পায়ে গুলি করেন সোহেল। যুবলীগ নেতা হলেও দয়ার শরীর সোহেলের। তিনি রিকশাচালক কবিরের পায়ে গুলি করেছেন, মাথায় নয়। আসলে আমার ধারণা সোহেল খালি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যুবলীগ কী জিনিস। ভবিষ্যতে যেন আর কখনও কারও সঙ্গে বেয়াদবী না করে। পিস্তলের গুলির দাম সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই। নিশ্চয়ই অনেক সস্তা। ইলিশ মাছের মতো পানির দরেই নিশ্চয়ই পাওয়া যায় গুলি। নইলে ৪০ টাকার রিকশা ভাড়া বাঁচাতে কেউ আস্ত একটা গুলি খরচ করে। দুয়েকটা চড়-থাপ্পর দিলেও তো নিশ্চয়ই মাইন্ড করতেন না কবির হোসেন। অবশ্য ৪০ টাকা ভাড়া বাঁচাতে গুলি করে আরো খেসারত দিতে হয়েছে।

রিকশাচালকের মামলায় তৎপর পুলিশ সোহেলকে গ্রেফতার করে। অবশ্য একরাত থানায় কাটিয়েই মুক্তি পেয়েছেন সোহেল। পুলিশ রিমান্ড চাইলেও ৫ হাজার টাকা মুচলেকায় আদালত সোহেলকে জামিন দিয়ে দেন। অবশ্য জামিন না দিয়ে উপায়ও ছিল না। মামলার বাদি রিকশাচালক কবির হোসেন আদালতে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দেন, জামিন দিলে তার আপত্তি নেই। কবির হোসেনের মাথায় কয়টা মাথা। তিনি ভাড়া চেয়ে প্রথম অপরাধ করেছেন। মামলা করে করেছেন দ্বিতীয়টি। সে অপরাধের সাজাও পেয়েছেন পায়ে গুলি খেয়ে। এখন আবার যুবলীগ নেতার জামিনের বিরোধিতা করে জানটা খোয়াবেন নাকি।

প্রথমবার পায়ে গুলি করেছেন। দ্বিতীয়বার নিশ্চয়ই অত দয়া করবেন না। সোহেল অবশ্য আমাদের সবার একটা দারুণ উপকার করেছেন। রিকশাচালকের পায়ে গুলি করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, যুবলীগ কী জিনিস। আমরা যেন কেউ ভুলেও যুবলীগের সাথে লাগতে না যাই।

অবশ্য যুবলীগ নেতারা যে শুধু গুলি করেন তাও নয়। গুলি খানও। প্রতিপক্ষের গুলিতে মারা গেছেন মতিঝিলের যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবু। প্রতিপক্ষ কারা? না, বাংলাদেশে এখন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কোনও প্রতিপক্ষ নেই। তারা নিজেরাই নিদেজের প্রতিপক্ষ। নিজেরা নিজেরাই গোলাগুলি করেন। যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান খুন হয়েছেন নিজ দলের নেতাকর্মীদের হাতেই। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এখন নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ, নিজেরাই নিজেদের মেরে ফেলেন। নিজেরাই নিজেদের সংগঠনের ভাবমূর্তি ধুলায় লুটিয়ে দেন। লুটে যাক। ভাবমূর্তি রক্ষা করে কী হবে।

দেশে তো কোনও প্রতিপক্ষ নেই। কার জন্য ভাবমূর্তি নিয়ে অত মাথাব্যথা করতে হবে। গত কয়েকদিনের পত্রিকা দেখলেই বুঝবেন দেশে আসলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের আসলেই কোনও প্রতিপক্ষ নেই। প্রধানমন্ত্রী যখন কানাডা জয় করে যুক্তরাষ্ট্র জয় করছেন; তখন তার দলের এমপি আমানুর রহমান খান রানা খুনের অভিযোগ মাথায় নিয়ে কারা ভোগ করছেন। কাকে খুন করেছেন? না, দূরের কাউকে নয়। রানা এবং তার ভাইয়েরা মিলে আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদকে খুন করেছিলেন। পুলিশী তদন্তে বেরিয়ে এসেছে রানা অ্যান্ড ব্রাদার্সের কীর্তি। গ্রেফতার এড়াতে ২২ মাস পালিয়ে ছিলেন রানা। তবে পুলিশ খুঁজে না পেলেও এই সময়ে দুই বার তিনি সংসদ সদস্য পদ রক্ষায় সংসদে গিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে এসেছেন। রানা আত্মসমর্পণ করে কারাগারে গেলেও তার ভাইয়েরা এখনও পালিয়ে আছে। রানা অ্যান্ড ব্রাদার্সের বিপক্ষে বিভিন্ন সময়ে অর্ধশতাধিক মামলা হয়েছে কিন্তু কখনও তাদের সাজা পেতে হয়নি। নানাভাবে ম্যানেজ হয়ে গেছে সবকিছু। এবারই ফেঁসে গেছেন। তার ভাইয়েরাও সব যুবলীগ, ছাত্রলীগ।

শুধু যে এমপি আর তার ভাইয়েরা খুন-খারাবি করেন, তা নয়; এমপির ছেলেরাও কম যান না। এমপি পিনু খানের ছেলে রনি মধ্যরাতে মাতাল অবস্থায় গুলি করেছিল এক রিকশাচালক আর এক সিএনজি চালককে। রনির টার্গেট অবশ্য যুবলীগ নেতা সোহেলের মতো অত খারাপ নয়। তার গুলিতে প্রাণ গেছে দুজনেরই। এমপিরা আইন বানান। অবশ্যই তাদের ছেলেদের আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার রয়েছে। আর মধ্যরাতে শ্যুটিং প্র্যাকটিস করা আইনের অত বড় লংঘন নয়। কিন্তু ‘বেরসিক’ পুলিশ ক্লু-লেস সেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করে ফেলেছে। এমপির ছেলে রনি এখন কারাগারে। সেখানে তিনি সঙ্গী হিসেবে পাচ্ছেন আরেক এমপি পুত্রকে। সাতক্ষীরার সাংসদ রিফাত আমিনের পুত্র রাশেদ সরোয়ার রুমনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা হয়েছে। মামলা কে করেছেন? না, প্রতিপক্ষের কেউ নয়। নিজ দলের এমপি পুত্রের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করেছেন যুবলীগ নেতা। সব নিজেরা নিজেরাই।

এমপি বা এমপির ছেলেরাই শুধু রাজত্ব করবে, আর বাকিরা কি ভেসে এসেছে। গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ মঞ্জুরুল ইসলামের শ্যালক আবুল বাশার সোহাগকে পুলিশ ইয়াবা-মদসহ গ্রেফতার করেছে। এমপি বা এমপির ছেলে বা এমপির শ্যালকরা যা ইচ্ছা তাই করবেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু কিছু বলা যাবে না। বললে খবর আছে। সেই খবর এখন টের পাচ্ছেন টাঙ্গাইলের এক স্কুলছাত্র। স্থানীয় সাংসদ অনুপম শাজাহান জয়ের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন নবম শ্রেণির সেই ছাত্র। সাংসদ সেই ছাত্রের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেছিলেন। ভ্রাম্যমান আদালত তাৎক্ষণিকভাবে সেই স্কুলছাত্রকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। দেশের থানায় থানায় লাখ লাখ মামলা ঝুলে আছে। কত মামলার বিচার ঝুলে আছে বছরের পর বছর। আর এক স্কুলছাত্র ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেওয়ার অপরাধে সোজা দুই বছরের কারাদণ্ড। একেই বলে আইনের নিজস্ব গতি! আইনের এই সুপারসনিক গতির বিষয়টি নজরে এসেছে হাইকোর্টের। হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে সখিপুরের ইউএনও এবং ওসিকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

এত খারাপ খবরের মধ্যে একটা ভালো ব্যাপার হলো এমপি, এমপিপুত্র, ছাত্রলীগ, যুবলীগ কেউই ছাড় পাচ্ছেন না। কিন্তু অঘটন ঘটার পর, ছাড় পাচ্ছে না, এই আত্মপ্রসাদে ভোগার চেয়ে; অঘটন যাতে না ঘটে, সে ব্যবস্থা নেওয়াই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ। সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের  অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। হতে পারে টানা আট বছর ক্ষমতায় থাকা, মাঠে কোনও সক্রিয় প্রতিপক্ষ না থাকায় সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের থোড়াই কেয়ার ভাব চলে এসেছে। দেশটাকে মনে হয় তারা নিজেদের সম্পত্তি ভাবতে শুরু করেছে। দলীয় প্রতিপক্ষ থেকে শুরু করে রিকশাচালক- কাউকেই তারা পাত্তা দেওয়ার যোগ্য মনে করেন না।

নীতিনির্ধারকদের উচিত অবিলম্বে দলের নেতাকর্মীদের মন থেকে এই হামবড়া ভাব দূর করা। বোঝাতে হবে তারা ক্ষমতায় এসেছেন মানুষের সেবা করতে, তাদের বুকে বা পায়ে গুলি করতে নয়। তারা যেভাবে প্রতিদিন সাফল্যের ঝুড়ির তলা কাটছেন, তাতে উন্নয়নের সব অর্জন হারিয়ে যাবে কৃষ্ণগহবরে।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পিছিয়ে থেকেও ব্রাজিলিয়ান-গ্রানাডিয়ানের গোলে আবাহনীর দারুণ জয়
পিছিয়ে থেকেও ব্রাজিলিয়ান-গ্রানাডিয়ানের গোলে আবাহনীর দারুণ জয়
শিশু হাসপাতালে আগুন: পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
শিশু হাসপাতালে আগুন: পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
অটোরিকশায় বাসের ধাক্কা, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিহত
অটোরিকশায় বাসের ধাক্কা, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিহত
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে: জাতিসংঘ
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে: জাতিসংঘ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ