X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ইউনেস্কো

আনিস আলমগীর
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৯:৩৫আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২০:৫৩

আনিস আলমগীর অবশেষে রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা বা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের কাছে আপত্তি জানিয়েছে। বিভিন্নভাবে আপত্তি উত্থাপিত হওয়ায় গত বছর জার্মানির বনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৩৯তম বৈঠকে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। গত ২২ মার্চ তিন সদস্যের একটা প্রতিনিধি দল এক সপ্তাহের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সফরকালে তিন সদস্যের এ দলটি বাংলাদেশ সরকারের বিশেষজ্ঞ দল, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, বিদ্যুৎ বিভাগসহ স্থানীয়দের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলেন। প্রতিনিধিদলটি ২৯ মার্চ বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পাঁচ মাস পর ইউনেস্কো প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠিয়েছে।
রামপাল ছাড়াও অরিয়ন গ্রুপ সুন্দরবনের নিকটবর্তী এলাকার আরও একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, ইউনেস্কো এ নিয়েও উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। সরকারের দ্বিতীয় প্রস্তাবিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগেও আপত্তি জানিয়েছে। ইউনেস্কো মংলাবন্দর কর্তৃপক্ষ সুন্দরবনের পাশে ও ভেতরে নদী খননের যে উদ্যোগ নিয়েছে তাও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যর জন্য ক্ষতির কারণ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
গ্যাস-তৈল-খনিজসম্পদ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ইউনেস্কো এবং আরও কিছু সংগঠন খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার উন্নয়নমূলক সব কাজ বন্ধের কথা বলছেন, সুন্দরবন ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য। ভারী শিল্প ও ভারী কাঠামো গড়ে ওঠে বন্দরের নিকটবর্তী এলাকায়। বাংলাদেশের একমাত্র সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে মীরসরাই পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম রোর্ডের উভয়পাশে আর কোনও ভারী শিল্প স্থাপনের জন্য খালি জায়গা অবশিষ্ট নেই।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বন্দর হচ্ছে মংলা। সুতরাং এখন ভারী শিল্প ও ভারী কাঠামো স্থাপনের জন্য মংলায় বন্দরের আশ-পাশ এলাকার ওপর নির্ভর করতে হবে।

কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে পদ্মা সেতু তৈরি করা হচ্ছে এবং সেতুর কাজ শেষ হলে উন্নয়নের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সে উন্নয়ন সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে হবে।

আণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করলে তার বর্জ্য সরানোর প্রশ্ন উত্থাপিত হবে। রূপপুরে এখন যে আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপন করা হচ্ছে তারও বর্জ্য হবে। বর্জ্য সরানো ও ধ্বংসের দায়িত্ব রাশিয়ার জিম্মাদারীতে রয়েছে। বর্জ্য পরিবহন করা হয় জাহাজযোগে। সুতরাং এখন রূপপুর থেকে বর্জ্য পরিবহন করে হয়ত চট্টগ্রাম না হয় মংলায় আনতে হবে। বর্জ্যরও অল্প বিস্তর তেজস্ক্রিয়তা থাকতে পারে। সুতরাং জাহাজ স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় পরিবহনের পথটা সুদীর্ঘ না হওয়াই ভালো। এ কারণেই সম্ভবতো দ্বিতীয় পারমাণবিক প্রকল্পটি মংলার আশপাশে করার কথা সরকার চিন্তাভাবনা করছে। মংলা ভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে না পারলে পদ্মায় হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সেতু করার কী প্রয়োজন ছিল!

মংলা ভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠবেই। সুতরাং শিল্পের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজন তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রও স্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশ ৫৬ হাজার বর্গমাইল মাত্র আর ১৬ কোটি মানুষের বসবাস। ২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সুতরাং পরিকল্পিত উপায়ে অগ্রসর না হলে ভবিষ্যতে দেশের সব কিছুই মুখ থুবড়ে পড়বে। বাংলাদেশে জমি স্বল্পতা এতো প্রকট যে, এ জমি দিয়ে মানুষের বসতির ব্যবস্থা খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করাই ধীরে ধীরে অসম্ভব হয়ে উঠছে। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষের বাড়ির আঙ্গিনায় ফুলবাগান করার বিলাসীতার অবকাশ নেই।

কথায় কথায় প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন মামলা ইত্যাদি আমাদের দেশের একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামের আদালাত ভবন পর্তুগিজের সময়ের নির্মিত ভবন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর স্থান সংকুলান হচ্ছিল না বলে এর দ্বিতল ভবনটিকে বহু কৌসলে তিনতলা করা হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে অর্থাৎ প্রায় ৭০ বছর আগে তখন পূর্ব বাংলার লোকসংখ্যা ছিল ৪ কোটি। এখন লোকসংখ্যার চাপে মামলা মোকদ্দমার চাপে আদলতের এ ভবন দিয়ে আর চলা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন সরকার নতুন ভবন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু এক বামপন্থী উকিলের মামলার কারণে নির্মাণের কাজ আরম্ভ করা সম্ভব হয়নি। তার যুক্তি হচ্ছে এ ভবন হেরিটেজ। অথচ নতুন ভবনটি তৈরি হলে আগামী একশত বছরের প্রয়োজন মিটে যেত। আদালত ভবন নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম শহরে এত বড় জায়গা কোথাও নেই। নতুন ভবন নির্মাণ করতে হলে রেলওয়ের পলো-গ্রাউন্ডে যেতে হবে আর না হয় বঙ্গোপসাগরে ভাসমান ভবন তৈরি করতে হবে।

চট্টগ্রাম শহরে বসতির জায়গার এখনই অভাব হয়ে গেছে। মানুষ পাহাড়ের খোপে-ডালে বসতি স্থাপন করছে আর প্রতি বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়ে মানুষ মরছে। আমার মনে হয় আগামী দু-এক দশকের মাঝে মানুষ সুন্দরবন বিরান করে নিজেরাই বসতির উদ্যোগ নেবে। হয়ত তখন কারও বাধা মানবে না।

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার কথা বললে হাসি পায়। এ পর্যন্ত বিশ্বে দুই হাজার পাঁচ শত স্তন্যপায়ীপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জীববিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই এ তথ্যটি অবগত আছেন।

এগুলো রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে বিলুপ্ত হয়নি, প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়েছে। আবার এ বিলুপ্ত হওয়াটাই সব সত্য নয়। নতুন নতুন প্রাণীরও আবির্ভাব হয়েছে। এখন বিশ্বে সাড়ে তিন হাজার স্তন্যপায়ী প্রাণী বিদ্যমান। জীববিজ্ঞান বলে মানুষও একদিন বলুপ্ত হবে তার স্থলে আরও উন্নত মেধার মানুষ আসবে।

ইউনেস্কোর কথা শুনলে মংলাবন্দর অকেজো হয়ে যাবে কারণ জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য তারা নদী ড্রেজিং এর বিরোধিতা করেছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে নদীতে পলি জমে এমনিই ভরাট হয়ে যাচ্ছে ড্রেজিং চলমান না থাকলে বন্দর অকেজো হয়ে যাবে। সুন্দরবন থেকে রামপাল ১৪ কি. মি. আর ইউনেস্কোর হেরিটেজ ঘোষিত এলাকা থেকে ৬০ কি.মি. দূরে। সুতরাং কোনভাবেই বন ধ্বংস হবে না। তবে ফারাক্কার কারণে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় জীববৈচিত্র্যের অসুবিধা হতে পারে।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ইউনেস্কোর প্রতিবেদনের জবাব হিসেবে বাংলাদেশ সরকার আরেকটা প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে। আশা করি ইউনেস্কো এবার হয়ত সন্তুষ্ট হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ