X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

অকার্যকর সার্ক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৩:৩৭আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৩:৩৯

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ইসলামাবাদে ১৯ তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছে না বাংলাদেশ। ভারত, আফগানিস্তান, ভুটানও সম্মেলনে যাচ্ছে না। ফলে আগামী ৯ ও ১০ নভেম্বর ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হয়ে গেল। শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হয়েছে, বারবারই হচ্ছে, তবে এখনও চরম অকার্যকর এই সংগঠনটি বিলুপ্ত হয়নি।
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা -সার্ক দীর্ঘ ৩২ বছরেও একটি কার্যকর সংস্থায় পরিণত হতে পারলো না। সার্ক গঠনের সময় স্বপ্ন ছিল এক সময় এই মোর্চা হয়ে উঠবে ইউরোপীয় ঐক্যের মতো একটি সফল প্রতিষ্ঠান। ইউরোপীয় ইউনিয়নতো দূরের কথা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আসিয়ানের কাছাকাছিও যেতে পারছে না সার্ক।
সার্কের প্রথম সম্মেলন হয়েছিল ঢাকায়। ১৯৮৫ সালের ৭ ও ৮ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ ভবনে। ৮ ডিসেম্বর ঢাকা ঘোষণায় সে সময় সাতটি দক্ষিণ এশীয় দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা সার্ক চার্টার আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করেন। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সার্ক গঠিত হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম প্রত্যাশা ছিল- মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধি, সম্প্রীতির প্রসার, দেশগুলোর মধ্যে সামরিক ব্যয় দশ শতাংশ কমিয়ে আনা, সামাজিক অর্থাৎ শিক্ষা-স্বাস্থ্য- সংস্কৃতিখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, ভিসা-প্রক্রিয়া সহজ করে তোলা, শুধু পুঁজি নয়- শ্রমের বাজার উম্মুক্তকরণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ভারসাম্য রক্ষা করা। নদীগুলোকে বহমান রাখা, সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মীয় উগ্রতার বিরুদ্ধে ঐক্যমতে পৌঁছে কার্যকর উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নেওয়া। 
বিস্ময়কর এই যে, স্বৈর শাসনের সময়, এই দক্ষিণ অঞ্চলীয় জোট- সার্ক এর সৃষ্টি। ভারত ছাড়া সেসময় সার্কভুক্ত কোনও দেশেই গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিলে না। সাতটি দেশের সার্ক পরবর্তীতে আফগানিস্তানকে যুক্ত করে আট জাতির মোর্চা।

ইউরোপীয় ঐক্যের ধারণাটা সেখানকার রাজনৈতিক ভিশনারি নেতৃত্বের ফসল। ইউরোপের দেশগুলো প্রথমে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, পরে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে নিরাপত্তা পর্যন্ত অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে নিয়ে একটি একক ইউনিট হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশরা সম্প্রতি গণভোট করে বেরিয়ে গেছে ইইউ থেকে, তবুও, ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শক্তি।

আমাদের এই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কী ভিশন ছিল আর বাস্তবে কী হচ্ছে, তা জানা নেই আটটি দেশের মানুষের। সহযোগিতার পরিবর্তে কেবলই প্রদর্শিত হচ্ছে বৈরীতা। এ মুহূর্তে সার্কের বড় দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে নাক গলানোয় ঢাকার সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্কও ভালো নয়। সন্ত্রাসবাদ দমন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, দারিদ্র দূরীকরণসহ অধিকাংশ লক্ষ্য পূরণেই ব্যর্থ হয়েছে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সংগঠন সার্ক। এসব জাতীয় ও আঞ্চলিক সমস্যা মোকাবিলায় সার্কের শক্তিশালী ভূমিকা থাকতে পারতো।

আঞ্চলিক সহযোগিতা কার্যকর না হওয়ায় এখন বাংলাদেশকে নজর দিতে হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দিকে। আর এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে দৃষ্টি যাবে সার্কের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি ভারতের দিকে। বাংলাদেশ-ভারত দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা দেখা যাচ্ছে দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে। বাংলাদেশের পণ্যের জন্য নিজের বাজারকে উন্মুক্ত করে দেওয়াসহ বিনিয়াগ ও নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণে ভারত এগিয়ে গেলে বাংলাদেশের সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে ভারত সম্পর্কে বিরাজমান নেতিবাচক মনোভাব কেটে গিয়ে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হবে।

সার্কের বড় অন্তরায় ভারত পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্ক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল ওই অঞ্চলের দুই বৃহত্তম দেশ জার্মানি ও ফ্রান্স। অথচ এ দুটি দেশের রয়েছে একে অপরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করার দীর্ঘ ইতিহাস। মাত্র ছয়টি দেশের নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের অর্থনৈতিক সহযোগিতা থেকে এটি এখন আঞ্চলিক সহযোগিতার অনুপম দৃষ্টান্ত হয়ে বিশ্বকে নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানি তাদের সম্মিলিত অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের সুবিধাকে অপরাপর দেশের জন্য উন্মুক্ত করে এবং বলা যায়, ইউনিয়নের স্বার্থে তারা নিজেদের নগদ লাভকে তুচ্ছ করে দীর্ঘমেয়াদি সম্মিলিত ইউরোপীয় শক্তির লাভকে আমলে নিতে পেরেছিল বলেই এখন ডলারকে পর্যন্ত টেক্কা দিতে পারছে।

পাকিস্তানে হয় সামরিক শাসন থাকে, নয়তো সামরিক বাহিনীর ছায়ায় বেসামরিক শাসন থাকে। আর বাস্তবতা এই যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থনে দেশটি জঙ্গিবাদের সূতিকাগার হয়ে উঠেছে। মুম্বাই হামলা, পাঠানকোট হামলা, এবং সম্প্রতি উড়ি সেনা ছাউনিতে হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানকেই দায়ী করছে। বাংলাদেশেও পাকিস্তানপন্থী জঙ্গি সংগঠনের বাড়বাড়ন্ত। এমন বাস্তবতায় প্রত্যাশিত সহযোগিতা গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না।

পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো নয়। সম্প্রতি আফগানিস্তানও পাকিস্তান সম্পর্কে নানা আভিযোগ তুলছে। সার্কের সফলতার জন্য সেই শুরু থেকে পিপল টু পিপল কনটাক্ট বা মানুষের যোগাযোগের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আর এটি করতে গেলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও কট্টরপন্থীদের রাজনৈতিক প্রভাবকে কমিয়ে আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের বিদগ্ধ মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রভাব দেশটির সমাজ ও রাজনীতিতে ভিত্তি না পাওয়ায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তানীতি রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে আসতে পারছে না। পাকিস্তান একটি বিকাশমান ও স্থিতিশীল দেশ হিসেবে না এগুলে ভারত-পাকিস্তান বৈরিতাকে জাদুঘরে পাঠানোর কাজটি কষ্টসাধ্য হয়ে থাকবে আর সার্কেরও কোন ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের কাছে বাস্তবতা হলো আট জাতির আঞ্চলিক সংস্থা সার্ক আঞ্চলিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে ব্যর্থ একটি সমিতি। তাই আমাদের এগুতে হচ্ছে উপ-আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির দিকে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্পর্কের ওপরই বাংলাদেশের ভরসা।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মানবিকতায়ও নজির স্থাপন করেছে পুলিশ: ডিএমপি কমিশনার
মানবিকতায়ও নজির স্থাপন করেছে পুলিশ: ডিএমপি কমিশনার
চাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বাজেট
চাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বাজেট
লিঙ্গবৈচিত্র্য ও পুরুষতন্ত্রের মেনে নেওয়া-না নেওয়া
লিঙ্গবৈচিত্র্য ও পুরুষতন্ত্রের মেনে নেওয়া-না নেওয়া
তীব্র গরমে কৃষিশ্রমিকের সংকট চরমে
তীব্র গরমে কৃষিশ্রমিকের সংকট চরমে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ