X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদি আরবকে নিয়ে মার্কিন বিল দুরভিসন্ধিমূলক

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৭:৩০আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৭:৩৭

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা না চাইলেও অবশেষে তাই হলো। ২০০১ সালের নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এখন চাইলে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। এ মাসে মার্কিন কংগ্রেস ‘জাস্টিস এগেনইস্ট স্পন্সরস অব টেররিজম’ নামে  একটি বিল প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেট পাস করে প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে পঠিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার ভেটো ক্ষমতা বলে এ বিল পাস না করে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
এর আগে বিল পাস না করায় কংগ্রেস তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল এবং বলেছিল তারা প্রেসিডেন্টের অসম্মতিকে শাসনতান্ত্রিকভাবে অকার্যকর করে দেবে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয়ে ঘোষণা দিয়েছেন তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এ বিলে স্বাক্ষর দেবেন। কিন্তু হিলারি বা ট্রাম্পের প্রয়োজন পড়েনি। ২৮ সেপ্টেম্বর দেশটির কংগ্রেসে ওবামার ভেটো খারিজ করে দেওয়ার জন্যে যে ভোটাভুটি হয়েছে, তাতে সিনেটে বিলটির পক্ষে ভোট দেন ৯৭ জন আর বিপক্ষে মাত্র একজন। আর হাউজ অব রিপ্রেসেন্টেটিভসের পক্ষে ৩৪৮জন ভোট দেন, বিপক্ষে ভোট পড়ে ৭৭টি। বিলটি পাস হওয়ার ফলে নাইন ইলেভেনে ক্ষতিগ্রস্তরা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে।
সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কোনও ভেটো খারিজ হলো। অবশ্য ভেটো প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বিষয়টা নতুন কিছু নয়। নিকট অতীতে জুনিয়র বুশ ১২ বার ভেটো দিয়েছেন এবং চারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। বিল ক্লিনটন ৩৭ বার ভেটো দিয়ে ২ বার হেরেছেন। এক্ষেত্রে বারাক ওবামার অবস্থানের বিপক্ষে স্বয়ং তার দল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও রিপাবলিকান, উভয় দলের সদস্যরা একাট্টা হয়ে ভোট দিয়েছেন।
খবরে দেখলাম ওবামা বলেছেন, এই ভেটো প্রত্যাখ্যান করে কংগ্রেস চরম ভুল করেছে।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কে বরাবরই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, এই আইনটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বয়ে আনবে। কারণ এর ফলে রীতি অনুযায়ী অন্য দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের বিচারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে যে দায়মুক্তি দেওয়া হয়, সেটি আর থাকবে না। ফলে অন্য দেশে কর্মরত মার্কিন বাহিনী বা কর্মকর্তাদেরও একইভাবে বিচারের আওতায় আনার ঝুঁকি তৈরি হবে। অন্যদিকে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সৌদি বাদশাহের পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, বিলটি পাস হলে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রে ৭৫ হাজার কোটি ডলারের বন্ড এবং অন্যান্য বিনিয়োগ তুলে নেবে।
এ বিলের মূল বয়ানটা কী? নাইন ইলেভেনের যারা ভিকটিম, তাদের পরিজনেরা ইচ্ছে করলে মার্কিন আদালতে সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন। নাইন ইলেভেনের মৃত ব্যক্তিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিলটি স্বাক্ষর না করার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, বিলটি পাস হলে আমেরিকার জাতি স্বার্থ ব্যাহত হবে।

নাইন ইলেভেনের ঘটনাটি আমার পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ২০০১ সালে ১১ই সেপ্টেম্বর সকালবেলা আমেরিকার এক বিমান বন্দরে ১৯ জন সন্ত্রাসী যাত্রীবেশে তিনটা যাত্রীবাহী বিমানে উঠেছিল। প্রথম বিমানটি কিছুদূর যাওয়ার পর সন্ত্রাসীরা জোরপূর্বক বিমান পরিচালনার নিয়ন্ত্রণভার নিয়ে নেয় এবং এ বিমান পরিচালনা করে তারা নিউইয়র্ক পর্যন্ত নিয়ে যায় আর টুইন টাওয়ারে আঘান হানে। তাতে টুইন টাওয়ার সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিমানটিরও নিয়ন্ত্রণভার সন্ত্রাসীরা নিয়ে নেয় এবং পেনসিলভানিয়ায় আমেরিকার সামরিক বাহিনীর সদর দফতর পেন্টাগন ভবনে আঘাত হানে। এতে পেন্টাগন ভবনের উত্তর অংশ বিধ্বস্ত হয়।

তৃতীয় বিমানটির নিয়ন্ত্রণভার সন্ত্রাসীরা নিতে পারেনি। বিমানের পাইলট ও যাত্রীদের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের হাতাহাতির কারণে তৃতীয় বিমানটি অন্যত্র বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তৃতীয় বিমানটি নাকি ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসে আঘাত হানার কথা ছিল। (১) বিমান তিনটির সবযাত্রীই নিহত হন, (২) টুইন টাওয়ার সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায় এবং টুইন টাওয়ারে তিন হাজার লোক মারা যায়, (৩) পেন্টাগণ ভবন আংশিক বিধ্বস্ত হয় এবং আমেরিকার সেনাবাহিনীর ৩ শত কর্মকর্তা নিহত হন। এই ছিল নইন ইলেভেন হামলার মোটামুটি চিত্র।

আমেরিকা প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে বলেছে, ১৯ জন সন্ত্রাসী এ দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। ১৯ জন সন্ত্রাসীর মাঝে ১৫ জন সৌদি নাগরিক। সৌদি সরকার এ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পেছনে অর্থ ঢেলেছে। আবার প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়র ঘোষণা করলেন এ কাজ আল-কায়েদা আর ইরাকের সাদ্দামের মিলিত প্রয়াস। বুশ বিশ্ববাসীকে জানালেন, একুশ শতকের প্রথম যুদ্ধ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যারা নেই, ধরে নিতে হবে তারা সন্ত্রাসবাদের সমর্থন করেন।

বুশের এ ঘোষণা মনরো ডকট্রিনের নবসংস্করণ। নাইন ইলেভেন এর দুর্ঘটনার পর আফগানের কোনও এক নিবৃত পাহাড়ি পল্লিতে সাংবাদিক পিটার আর্নেট ওসামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। পিটার আর্নেটকে ওসামা বিন লাদেন বলেছিলেন ‘ইহুদিদের নির্লজ্জ তোষণের ফলে আমেরিকার ঔদ্ধতা এত বেড়ে উঠেছে যে, তারা মুসলমানদের পবিত্র ভূমির ওপর দখলদারি চালাতে সাহস পেয়েছে। দুনিয়া জুড়ে মুসলমানদের ক্রোধের ফল তাদেরতো ভোগ করতেই হবে।’

প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ আল-কায়েদা ও ইরাকের সাদ্দামকে নাইন ইলেভেনের ঘটনার জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছেন। সাংবাদিক পিটার আর্নেটের কাছে আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন তা  স্বীকার করে নিয়েছেন। ওসামা তো আসলে ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’। অন্তর্ঘাতের তালিম সে ওয়াশিংটনের মাধ্যমেই পেয়েছে। অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে কোনও হামলার জন্য ধাপে ধাপে একটা ছক তৈরি করতে এবং তা বাস্তবায়িত করার সুনীপণ কৌশল অবলম্বনে তার জুড়ি তো এখনও বিশ্বে নেই। নাইন ইলেভেনের প্রতিশোধ নিতে আমেরিকা আফগানে উপস্থিত হলো, কার্পেট বোমিং করল, আফগানের পাহাড়ে জঙ্গলে এবং পাকিস্তানের উপজাতি অধ্যুষ্যিত এলাকায়। লাদেন এবং তার আল-কায়েদা গোষ্ঠীকে নিঃশেষ করার জন্য।

আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিতাড়িত করার জন্য আমেরিকার সহায়তায় লাদেন আল-কায়েদা গড়ে তুলেছিলেন। লাদেন বাহিনীকে অস্ত্র-অর্থের সহায়তা দিয়েছিল  আমেরিকা আর সৌদি আরব। সারা বিশ্ব থেকে মুসলিম যুবাগোষ্ঠী একত্রিত হয়েছিল। পাকিস্তানের আফগান সীমান্তে আফগান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিতাড়িত করার জেহাদে শরিক হওয়ার জন্য। সব কিছুর নেপথ্যে থেকে মনিটরিং করেছিল সিআইএ।

আল-কায়েদার লোকজনকে ট্রেনিং ও দিয়েছিল আমেরিকা। বিশ্বের যে মুসলিম যুবকেরা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আফগান জেহাদে শরিক হতে পাক-আফগান সীমান্তে সমবেত হয়েছিল, তাতে সৌদি-আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের যুবক ছিল এবং তারা যদি পরবর্তী সময়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তা হলে তাতে সৌদি আবর দায়ী হবে কেন? আর যদি দায়ী হতে হয়, তবে সৌদি আরব ও আমেরিকা উভয়েই হবে। কারণ উভয়ে মিলে এ যুবগোষ্ঠীর জন্য অর্থ-অস্ত্র, প্রসিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল।

ওবামার উপলব্ধি সঠিক যে, আমেরিকা যদি ১৫ বছর পর সৌদি আরবকে এ ঘটনার ‘স্পন্সর্স’ আইন করে দোষী সাব্যস্ত করে এবং ভিকটিমের পরিবারকে আমেরিকার আদালতে সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার আইনসম্মত অধিকার ভোগ করার আইন প্রণয়ন করে, তবে মুসলিম বিশ্ব আমেরিকার বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই অবস্থান নেবে। তাতে নিশ্চয়ই আমেরিকার জাতি স্বার্থ ব্যাহত হবে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপলব্ধিই ঠিক।

গত ১৫ বছরব্যাপী আমেরিকা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে আসছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং ধর্মীয় সন্ত্রাস মিলেমিশে সন্ত্রাসবাদের এমন এক নগ্ন কদর্য রূপের প্রকাশ ঘটেছে, তাকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করা সহজ হচ্ছে না। আমেরিকার কংগ্রেস যদি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে এই আইনটি পাস করে তবে মুসলিম বিশ্ব ধরে নেবে মুসলিম জগতের আর একটি রাষ্ট্রকে  বিধ্বস্ত করে ফেলার জন্য আমেরিকা দুরভিসন্ধি করছে। তখন সন্ত্রাসের বিশ্বায়ন হবে চূড়ান্ত রূপে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ