X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানকে ‘পানিতে মারা’র ভারতীয় কৌশল!

চিররঞ্জন সরকার
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১০:৫৩আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১০:৫৭

চিররঞ্জন সরকার ভারতের কাশ্মীরের সীমান্ত বরাবর উরি সেক্টরের আর্মি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন সেনাসদস্য নিহত হওয়ার পর গোটা পাক-ভারতের মধ্যে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। ভারত জুড়ে পাকিস্তান বিরোধী স্বর তীব্র হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানকে এই সন্ত্রাসের মদতদাতা হিসেবে চিহ্নিত করে এর যোগ্য জবাব দেওয়ার দাবি উঠেছে। `সামরিক জবাব’ দেওয়ার পথ আপাতত দেখা না গেলেও ‘ভিন্ন কায়দায়’ পাকিস্তানকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার একটা তোরজোর লক্ষ্য করা যাচ্ছে।  
যে সব পথে পাকিস্তানকে জবাব দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো সিন্ধু জল চুক্তি বাতিল করার ভাবনা। ‘সন্ত্রাসে লাগাতার মদত দিয়ে পাকিস্তান যখন বার বার রক্তাক্ত করছে ভারতকে, তখন পাকিস্তানের প্রতি আর সৌজন্য দেখানোর প্রশ্ন ওঠে না’ বলে একটি শিবির মনে করছে। পানিচুক্তি বাতিল করে দিয়ে পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার দাবি তুলেছেন তারা।
বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকও করেছেন এবং বলেছেন, ‘রক্ত ও জল এক সঙ্গে বইতে পারে না। পাকিস্তানের ক্রমাগত হিংসার পরিবর্তে ভারত বরাবরই তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চেয়েছে৷ কিন্তু সবসময় তা আর সম্ভব নয়৷’
১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছে ভারত-পাকিস্তান। ১৯৯৯ সালেও কার্গিলের পাহাড় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সাক্ষী থেকেছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও এই চুক্তি বাতিল করার কথা ভাবা হয়নি। কিন্তু এবার ভাবা হচ্ছে। ভারত কি তবে রাষ্ট্রীয় নীতিতে আদিম হিংস্রতাকেই ফিরিয়ে আনছে?
উল্লেখ্য, দেশভাগের আগে এই সব নদ-নদী নিয়ে কোনও সমস্যা না থাকলেও, দেশভাগের পর পানির অধিকার নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। পানিবণ্টন নিয়ে যাতে কোনও সমস্যা না থাকে, তার জন্য বিশ্ব ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘সিন্ধু জল চুক্তি’ হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান ওই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন।
সিন্ধু জল চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তিনটি নদীকে পাকিস্তানের নদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়— সিন্ধু, বিতস্তা (ঝিলম), চেনাব। এই তিন নদীর জলকে ভারত ব্যবহার করতে পারলেও, জল আটকাতে বা জলের ধারাকে অন্যত্র ঘুরিয়ে দিতে পারবে না বলে এবং সিন্ধুর মাত্র ২০ শতাংশ জল ভারত ব্যবহার করতে পারবে বলে স্থির হয়। অন্যদিকে বিপাশা (বিয়াস), রবি ও শতদ্রু (সতলুজ) সম্পূর্ণ ভাবে ভারতীয় নদী হিসেবে চিহ্নিত করে এই তিন নদীর জল ভারত যে কোনও ভাবে কাজে লাগাতে পারবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

এই নদ-নদীগুলি মূলত ভারতের জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ এবং পাঞ্জাব প্রদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। পাকিস্তানে ঢোকার পর সেগুলো পাক পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে পড়েছে। যেহেতু ছ’টি নদ-নদীই ভারতের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর পাকিস্তানের মধ্যে ঢুকেছে, সেহেতু নদ-নদীগুলোর পানিকে সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পোপৎপাদনসহ নানা কাজে লাগানোর সুযোগ ভারতের সামনে রয়েছে। ভারত যদি এই ছয় নদ-নদীর পানি যথেচ্ছ পরিমাণে ব্যবহার করে, তা হলে পাকিস্তানের বিপদ। কারণ এগুলোই পাকিস্তানের মূল নদ-নদী। সব ক’টি নদীর পানির সিংহভাগ ভারতেই আটকে গেলে, পাকিস্তানে পানিসঙ্কট তৈরি হতে পারে।

পাকিস্তানকে ‘পানিতে মারা’র এই প্রচেষ্টার পক্ষে ভারতজুড়েই একটা উগ্র সমর্থন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দাঁতের বদলে চোয়াল নেওয়ার সুপরামর্শ ঘোষণা করে বক্তব্য রাখছেন খোদ বিজেপি নেতারা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রথম দিকে পাকিস্তানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন এই বলে যে, কে আগে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করতে পারে, পরীক্ষা হোক। কিন্তু ক্রমাগত জঙ্গি মনোভাবের প্রভাবে তিনি স্থির থাকতে পারছেন বলে মনে হয় না! সেই ইচ্ছে তার প্রবল-এমনটাও বলা যাচ্ছে না।  

আপাতত ‘সেনাবাহিনী ঠিক সময়ে যা করার করবে’ বলে তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত। কিন্তু মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে যেভাবে পাকিস্তানবিরোধিতার ‘তাণ্ডব’ চলছে, তীব্র ঘৃণা-বিদ্বেষ আর বৈরিতার চর্চা চলছে, তাতে এ অঞ্চলের শান্তি-স্থিতি নিয়ে দুর্ভাবনার যথেষ্ট কারণ আছে। যারা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, তারা ‘যুক্তি’ দিয়েছেন: যারা সন্ত্রাস করে, তাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখা যাবে না। সন্ত্রাসবাদী, রাষ্ট্র, দেশ, নাগরিক-বিদ্বেষের গরলে সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে!

এই হিংস্রতা থেকে এখন নদীরও রেহাই নেই। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সিন্ধুদের জল বণ্টনের চুক্তি ছাপ্পান্ন বছর ধরে বহাল, দুই প্রতিবেশীর নিরবচ্ছিন্ন বিবাদ এবং একাধিক যুদ্ধবিগ্রহ সত্ত্বেও এমন একটা চুক্তি মেনে চলার ইতিহাস গোটা দুনিয়ার সামনে সুস্থবুদ্ধির দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃত, প্রশংসিত। এখন আজ হঠাৎ ধুয়ো তোলা হল, ‘শত্রু’র সঙ্গে এমন চুক্তি কেন মেনে চলা হবে? কেন ভারত ভূগোলকে কাজে লাগিয়ে নদীর জল আটকে দেবে না?

নদীর জল আটকানোর রণকৌশল এই একুশ শতকের দুনিয়াতেও কমই প্রয়োগ করা হয়, অন্তত প্রতিপক্ষকে ‘পানিতে মারব’ বলে সরাসরি বুক ফুলিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি ভাঙার চেষ্টা খুব একটা কেউ করে না।

হয়তো শেষ পর্যন্ত নদীর জল বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এটা করতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। ও পথে পা বাড়ালে পাকিস্তান যদি চিনের সমর্থন আদায় করতে পারে তাহলে চিন  ভারতকে বিপাকে ফেলতে পারে। সে আবার নদীর ভূগোলে ভারতের ওপরে আছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসলে সীমাহীন সংকটে রয়েছেন। কিছু একটা করে দেখাতে না পারলে তাঁর মান বাঁচে না, অথচ নাগালে বিশেষ কিছু নেই, তাই আশঙ্কা, বিপাশা-ইরাবতী-শতদ্রুর পানি নিয়ে সত্যিই নতুন সংকটের সৃষ্টি না হয়! যদি সত্যি সত্যিই তেমন কিছু ঘটে তবে সেই সংকটের ফল ভুগতে হবে, যথারীতি, সাধারণ নাগরিকদের। পাকিস্তানের আমজনতারই পানিতে টান পড়বে— চাষের জল, কলকারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্রের পানি, স্কুলকলেজ, হাসপাতালের পানি, পানীয় জল। তবে তাতে একশ্রেণির ‘দেশপ্রেমিক ভারতীয়র’ কিছু যায় আসে না। তাদের কাছে পাকিস্তান তো শত্রু! শত্রুর অকল্যাণ কামনা করার মধ্যেই তেজ, দেশপ্রেম, কল্যাণ!

ইহুদি-বিদ্বেষে নাৎসীরা যে সন্দেহ, অবিশ্বাস, ঘৃণা লালন করত, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের মধ্যেও আজ সেই একই বিষাক্ত সংশয় ঘনিয়ে তোলা হচ্ছে। যাতে উস্কানি দিচ্ছে উগ্র-জাতীয়তাবাদ, দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার শক্তি আর সন্ত্রাসের কারবারিরা। ব্যর্থ শাসকরাও এ আগুনে ঘি ঢালছে। হাওয়া দিচ্ছে। কম-বেশি দুই দেশের শাসকরাই ক্ষুধা-দারিদ্র্য-বেকারত্ব দূর করা, মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শোচনীয় রকম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলছে (পাকিস্তানের অবস্থা অবশ্য অনেক বেশি খারাপ)। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে রাখতে অনাবশ্যক উত্তেজনা সৃষ্টি করে, ঘৃণাবিদ্বেষের দাবানল জ্বালিয়ে যুদ্ধংদেহী একটা আবহ জিইয়ে রাখা হচ্ছে। প্রকৃতির অন্যতম সেরা উপহার নিরীহ নদীও হয়ে উঠছে হিংসার অস্ত্র। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নাগরিকদের সঙ্গে এই প্রতারণা আর কত দিন? প্রতারণার ধামা দিয়ে অপারগতার সত্যটাকে আর কত দিন চাপা দিয়ে রাখা যাবে?

রবীন্দ্রনাথ রাজর্ষি উপন্যাসে লিখেছিলেন, ‘হৃদয় যাহার কঠিন হইয়া গিয়াছে, দেবতার কথা সে শুনিতে পায় না।’ রবীন্দ্রনাথ বাকিটা লেখেননি— সে শয়তানের কথা শুনতে পায়। আসলে হিংসা আর সন্ত্রাসের কারবারিরাই জয়ী হতে চলেছে। ভারতীয়, পাকিস্তানি এমনকি আমাদের মনগুলোও এখন তাদের মতো হয়ে গেছে!

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ