X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইস্যুর দেশের শিশুরা এবং আমাদের কান্নার উপলক্ষ

আমীন আল রশীদ
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২০:১১আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০১৬, ১২:৩১

আমীন আল রশীদ ফরিদপুরের নবজাতক গালিবার মৃত্যু আমাদের কাঁদিয়েছে। আমাদের কান্নার উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছে গণমাধ্যম। যদিও নবজাতকের এমন অকাল কিংবা নির্মম মৃত্যু নতুন কিছু নয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় প্রতিদিনই শিশুদের খুলি উড়ে যায় বুলেট কিংবা বোমায়। তারপরও আমাদের মনে দাগ কাটে আয়লান, ওমরান। আমাদের মনে রেখাপাত করে মার্কিন শিশু অ্যালেক্সের মানবিকতা।
আমরা আনন্দে উদ্বেল হই শিশু শীর্ষেন্দুর সাফল্যে। যে কিনা পটুয়াখালীর পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে এখন গণমাধ্যমের আলোচিত চরিত্র।
তবে এসব শিশুর ভিড়ে আমরা হয়তো মনেও করব না শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কুণ্ডেরচরের সেই শিশুদের, একে একে যাদের সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গিলে নিয়েছে রাক্ষুসী পদ্মা।
গালিবা: জন্মের পর প্রথম দফায় মৃত ঘোষণার চার দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর একটি অভিজাত হাসপাতালে প্রকৃতপক্ষেই মৃত্যু হয় ফরিদপুরের শিশু গালিবা হায়াতের। গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, ফরিদপুর শহরের কুঠিবাড়ী কমলাপুর এলাকার বাসিন্দা নাজমুল হুদা মিঠুর স্ত্রী অ্যাডভোকেট নাজনীন আক্তার পপিকে ২১ সেপ্টেম্বর রাতে হাসপাতালে নেওয়া হয়। স্বজনরা রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাকে শহরের ডা. জাহেদ মেমোরিয়াল শিশু হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করেন। কিন্তু চিকিৎসক শয্যা সংকটের কারণে ভর্তি নিতে রাজি হননি। একপর্যায়ে চিকিৎসকের কক্ষেই সন্তান প্রসব করেন পপি। কিন্তু চিকিৎসক ওই নবজাতককে মৃত ঘোষণা করেন। কিন্তু ভোররাতে দাফন করতে গেলে তার চিৎকার শোনা যায়। ফের হাসপাতালে নেওয়া হয় শিশুটিকে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে নেওয়া হয় ঢাকায়। শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি তাকে।
বাংলাদেশের যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা, তাতে এরকম নবজাতকের মৃত্যু আমাদের খুব বিস্মিত করে না। কিন্তু এত মৃত্যু ছাপিয়ে গালিবা কেন আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেলো?
আমরা স্মরণ করতে পারি রাজধানীর কমলাপুরে পাইপের ভেতরে পড়ে শিশু জিহাদের মৃত্যুর কথা। সারা দেশের মানুষ অপলক তাকিয়েছিলো টেলিভিশনের পর্দায়। ১৬ কোটি মানুষ যেন একসঙ্গে প্রার্থণা করছিল শিশুটির জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেও বাঁচানো যায়নি। তখন আমরা আরও একবার কেঁদেছিলাম।

গণমাধ্যম এই যে মাঝেমধ্যেই আমাদের কান্নার উপলক্ষ তৈরি করে দেয়, এর মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি আমরা বেঁচে আছি। অনেক হতাশা আর আত্মকেন্দ্রিকতার ভেতরেও একটা নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যু আমাদের বুকের ভেতরে একটু চিনচিন ব্যথার জন্ম দেয়। চোখে জল না এলেও আমাদের বুকটা ভারি হয়ে ওঠে। এই তো মানুষ। এই তো মানবিকতা।

প্রতিদিন নানা কারণে আরও অনেক শিশুর মৃত্যু হয়। সবার মৃত্যুতে আমরা কাঁদি না। সবার মৃত্যু খবর হয় না। একসঙ্গে দুই ভাইবোন পানিতে পড়ে মারা গেলে হয়তো পত্রিকার ভেতরের পৃষ্ঠায় সিঙ্গেল কলাম খবর হয়। যদিও পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতি ৩০ মিনিটে একটি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।  কিন্তু নবজাতক গালিবা কিংবা শিশু জিহাদ যেন আলাদা হয়ে ধরা দেয়। আমাদের অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে যায়।

আয়লান: আমাদের অনুভূতিকে নাড়া দিয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার শিশু আয়লান কুর্দি। নীল রঙের হাফপ্যান্ট আর লাল শার্ট গায়ে সাগরের উপকূলে উপুড় হয়ে পড়া থাকা আয়লানের মৃতদেহ দেখে কাঁদেনি, এমন পাষাণ খুঁজে পাওয়া ভার। বিশেষ করে আয়লানের বয়সী সন্তান যাদের রয়েছে, তাদের কাছে এর চেয়ে হৃদয়বিদারক আর কোনও দৃশ্য হতে পারে না।

গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়া থেকে আয়লানের পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল তুরস্কে। সেখান থেকে নৌকায় চেপে গ্রিস যাওয়ার চেষ্টা করার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয় তারা। নৌকা ডুবে গেলে বাবার হাত ফসকে সাগরের ঢেউয়ে তলিয়ে যায় তিন বছর বয়সী আয়লান আর পাঁচ বছর বয়সী তার ভাই গালিব। ভূমধ্যসাগর কেড়ে নেয় তাদের মাকেও। এরপর তুরস্কের সমুদ্রসৈকতে পড়ে থাকা আয়লানের ছোট নিথর দেহের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বড় ধরনের ঝাঁকুনি খায় অভিবাসী-সংকট নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ইউরোপ। ঘুম ভাঙে বিশ্বনেতাদের। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের অনলাইন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আয়লানের ওই ছবি বদলে দেয় জনমত। শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ইউরোপের যে নেতারা এত দিন নির্লিপ্ত ছিলেন, তারাও মানবিক উদ্যোগের পথে এগোনোর কথা বলেন।

ওমরান: আয়লান ও তার ভাইয়ের মৃতদেহ সমুদ্র উপকূল থেকে উদ্ধারের পর আলোচনায় আসে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার আরেক শিশু ওমরান দাকনিশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার রক্তাক্ত ধুলোমাখা শরীরের ছবি প্রকাশিত হলে আরও একবার ধাক্কা খায় বিশ্ববিবেক। খোদ হোয়াইট হাউজের তরফে বলা হয়, সিরিয়ায় যে যুদ্ধ চলছে তা কতটা বীভৎস হতে পারে, ওমরান দাকনিশের ছবিই তার প্রমাণ। যুদ্ধের ‘সত্যিকারের মুখ’।

তবে গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কেননা আয়লান বা ওমরানরা এরকম নিয়তি নিয়েই জন্মায়। কিন্তু  আমাদের আরও একবার কান্নার উপলক্ষ্য তৈরি করে দেয় মার্কিন শিশু অ্যালেক্স। যে কি না খোদ বারাক ওবামাকে চিঠি লিখে জানায়, সে ওমরান দাকনিশকে তার ভাই বানাতে চায়। তাদের বাসায় নিয়ে আসতে চায়।

মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সে লিখেছে, ‘জনাব প্রেসিডেন্ট, সিরিয়ায় যে শিশুটিকে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হয়েছিল তাকে কি মনে করতে পারেন? আপনি কি তাকে খুঁজে বের করতে এবং আমাদের বাড়িতে আনতে পারেন? আমরা আপনাদের জন্য পতাকা, ফুল ও বেলুন নিয়ে অপেক্ষা করব। আমরা তাকে একটা পরিবার দেবো এবং সে আমাদের ভাই হবে।’

এইটুকু শিশুর এমন মানবিকতায় মুগ্ধ বিশ্বনেতারা। জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলনে শরণার্থীবিষয়ক আলোচনায়ও অ্যালেক্সের চিঠির কথা উল্লেখ করেন ওবামা। বলেন, ‘আমাদের সবার অ্যালেক্সের মতো হওয়া উচিত। যদি আমরা তেমন হতাম, তাহলে একবার চিন্তা করে দেখুন পৃথিবীটা কেমন হতো। কল্পনা করুন আমরা এই দুর্ভোগটা কত কমিয়ে ফেলতে পারতাম এবং কত জীবন বাঁচাতে পারতাম।’

শীর্ষেন্দু: তবে এতসব কান্নার ভেতরে কিছু আনন্দের উপলক্ষ্যও তৈরি হয়। যেমন পটুয়াখালীর জুবিলী স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শীর্ষেন্দু বিশ্বাস। প্রতিদিন তাকে উত্তাল পায়রা নদী পার হয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করতে হয়। এরকম বিপজ্জনক অবস্থা থেকে রেহাই পেতে সে চিঠি লিখে বসে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

এই গল্পটাও এখানে শেষ হতে পারতো। কেননা, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রতিদিনি হাজারো চিঠি যায়। তার কয়টা চিঠিই বা তার টেবিলে পৌঁছায়?  কিন্তু শীর্ষেন্দুর চিঠিটা পৌঁছেছে। আর প্রধানমন্ত্রীও তার জবাব দিয়েছেন। শীর্ষেন্দুকে লেখা সেই চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন, পায়রা নদীতে সেতু হবে। শুধু তাই নয়, শীর্ষেন্দুর পড়ালেখার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন।

যদিও এ কথা ঠিক, এরকম সমস্যা দেশে হাজারটা আছে। সব সমস্যা নিয়ে কি শিশুরা চিঠি লিখবে। আবার লিখলেও সেই সব চিঠি কি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাবে? পৌঁছালেও কি সব সমস্যার সমাধান সম্ভব? হয়তো সম্ভব নয়।

শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নের যে শিশুরা একে একে তাদের প্রায় সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভয়াল পদ্মায় বিলীন হতে দেখেছে, তারা কার কাছে চিঠি লিখবে? চিঠি লেখা হয়েছেও। দাবি-দাওয়া, মানববন্ধন কম হয়নি। কিন্তু রাক্ষুসী পদ্মার থাবা থেকে কুন্ডেরচরের শিশুদের কে বাঁচাবে?

লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ