X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘সময় গেলে সাধন হবে না’

শারফুদ্দিন আনাম
০২ অক্টোবর ২০১৬, ২০:৪০আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৬, ১৬:৪৯

শারফুদ্দিন আনাম ঘটনা-১
বেশ ভালো মানের একটি অ্যাপার্টমেন্টের নিচতলায় লিফটের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। লিফটের ধারণ ক্ষমতা ১০ জনের মতো। অপেক্ষায় খুব বেশি হলে ৪/৫ জন মানুষ। হঠাৎ পূর্বপরিচিত চিকিৎসক বাবার হাত ধরে সেখানে উপস্থিত হলো বছর দশেকের এক ছেলে। বেশ মিষ্টি চেহারা। শিশুদের প্রতি আলাদা মনযোগ আমার বরাবরই। ওকে দেখেও ভালোই লাগছিল, বেশ শিশুসুলভ নাদুসনুদুস ভাব। ওর বাবা যেহেতু আমার পূর্বপরিচিত ছিলেন, তাই কিছুটা কুশল বিনিময় হলো। কথার ফাঁকেই জানলাম বেশ নামি একটা স্কুলের ক্লাস ফাইভে পড়ছে। এরই মধ্যে লিফ্ট চলে এলো। হঠাৎ দেখলাম সবাইকে কনুইয়ের গুঁতোয় সরিয়ে শিশুটি সবার আগে লিফটে ঢুকতে চাইলো এবং ঢুকলো। অবাক হয়ে দেখলাম, ওর দিকে তাকিয়ে ওর বাবা হাসছে। তারপর আমাকে আরও অবাক করে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ফার্স্ট হয়েছো তুমি, গ্রেট। ছেলে উত্তরে মধ্যবয়স্ক লোকের মতো শুধু বললো–হুমম।
ঘটনা-২
এক বাসায় গিয়েছিলাম ইনভাইটেশনে। বাড়ির কর্তা পথে আছেন, যেকোনও সময় ফিরবেন। গল্প চলছিল ঘরোয়াভাবে। হঠাৎ ভেতরের ঘর থেকে চিৎকার মেশানো কান্নার আওয়াজ। গিয়ে দেখলাম ৪/৫ বছরের একটি বাচ্চা ছেলে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাশে কাঠের সোফার সঙ্গে রীতিমতো মাথা ঠোকাচ্ছে। ঘটনার কারণ জিজ্ঞেস করতেই বেশ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার স্ত্রী বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বললেন, বাবু ৩ দিনে আটটা আইসক্রিম খেয়েছে। একটু আগেও ২টা আইসক্রিম খেলো। কাজের মেয়েটাকে একটা দিয়েছিলাম, বেশি জেদ করা কারণে সেটাও এনে ওর হাতে দিলাম। খেয়েছে কিন্তু জেদ কমছে না। যা জেদ, বাপরে, একেবারে নাছোড়বান্দা। ওকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে বোঝে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে অনেক কথার সঙ্গে শুনলাম, ছেলেদের একটু আধটু রাগ-জিদ থাকা ভালো। আর এ ব্যাপারে ওর বাবারও কড়া কথা, ছেলেকে কোনও কিছুতেই বাধা দেওয়া যাবে না। বাধা পেলেই নাকি মন ছোট হয়। মন বড় করতেই তাই এসব বাধাহীন উদ্যোগ।

ঘটনা-৩
এটা অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে শোনা গল্প। ৮ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে ওর চেয়ে সামান্য বড় একটা মেয়েকে লাঠি দিয়ে মারছে। মেয়েটা ব্যাথায় কুঁকড়ে কেঁদে উঠতেই নাকি কানে এলো, বাচ্চার মা ওই মেয়েকে বলছে, আরেকটু সহ্য কর, এর জন্য তোকে তাড়াতাড়ি খেতে দেব রাতে। ছোট গৃহপরিচারিকা কেঁদে মুখ নেড়ে সায় দেয় সেই কথায়। জিজ্ঞেস করতেই সেই মেয়ের মা বললেন, বাচ্চাদের জেদ উঠলে সেটা নাকি নামিয়ে ফেলতে হয়। ওর জেদ উঠেছে তো, তাই নামুক আস্তে আস্তে। তারপর নির্বিকারভাবে আরও বললেন, এমনিতে ও খুব ভালো ‘শান্তশিষ্ট’। শিশুর শিষ্টতা দেখে আমাকে এই গল্পটি যিনি বলেছেন, তিনি নাকি পরবর্তী কয়েকঘণ্টা শুধু শিউরে উঠেছেন।  খুব ছোট কয়েকটা উদাহরণ, অথচ খুঁজলে হয়তো অজস্র পাওয়া যাবে আমাদের সবার চারপাশে। প্রশ্ন হলো এসব কেন খুঁজব? খুঁজব কারণ এটা ২০১৬ সাল। সময়টা রাজা-বাদশা-সম্রাটের না যে, কেউ এই রাজ্যে আক্রমণ করবে, তাই আমার সন্তানকে মহাবীর আলেকজান্ডার বা আকবর-হুমায়ূন-ইশা খাঁ'র মতো মহা পরাক্রমশালী কিছু বানাতে হবে। আগেও বহুবার বলছি, এখনও বলি, বাড়িতে সব বাচ্চাদের সবার আগে ম্যানার শেখান। বাংলা বা ইংলিশ মিডিয়াম, আপনার ছোট্ট সন্তানের শিক্ষার মাধ্যম যেটাই হোক, একাডেমিক কারিক্যুলাম একদিন শেষ হবে। কিন্তু ম্যানার, কার্টিসি, পোলাইটনেস, রেসপেক্ট, কমিটমেন্ট, রিলায়েবলিটি—এগুলো অভিভাবক ছাড়া আর কেউ কোনও দিন শেখাতে পারবে না। আর তা শেখানোর একমাত্র সময় হলো শৈশব। 

আরেকটা ব্যাপার, আপনার টাকার গাছ থাকতে পারে, কিন্তু সন্তানের মধ্যে ‘প্রয়োজনীয়তা’ বোধ জেগে ওঠার সুযোগ দিন। চাইলে বা চাওয়ার আগেই অন্ধের মতো সব জোগান দিতে নেই। একটা ৩/৪ বছরের বাচ্চার ঘরের ভেতর চালানোর জন্য কটা গাড়ি দরকার, নিশ্চয়ই ৭/৮ টা নয়? ছোট নিস্পাপ শিশুর জন্য ট্যাব, এলিসিডি, প্লে-স্টেশন, জয়েস্টিক কয়টা দরকার, দিনে আপনার সন্তানকে চকলেট বা সফ্টড্রিংকস বা আইসক্রিম অবশ্যই আপনি দিতে পারেন, তাই বলে প্রায় সমবয়সী গৃহপরিচারিকাদের না দিয়ে কয়টা সফ্টড্রিংসের ক্যান আপনার সামনে নষ্ট করলে আপনার মন শান্তি পাবে—ভেবেছেন কখনও? কোনও কোনও বাড়িতে বেড়াতে গেলে মনে হয়ে টয়পার্কে এসেছি। না চাইতেই পেতে পেতে একসময় জাগতিক সব কিছুতেই শিশুটির অরুচি তৈরি হয়। আপনি তো তখন তার জন্য চাঁদে বা মঙ্গলে যেতে পারবেন না। তখন আপনার কী হবে?

অনেক অভিভাবক বলেন, আমার ছেলের খুব সাহস। অনেক শক্ত, একদম কাঁদে না। উল্লিখিত করা ৩টি কাহিনিই যে, না খেয়েপড়ে শুধু সাহস চর্চা করা পরিবারের, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।  কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে এগুলো আপনার কাছে গর্বের ব্যাপার মনে হলেও এ লক্ষণগুলো কিন্তু আদতে ভালো কিছু নয়। হাসি, কান্না, অভিমান, দুঃখ ও লজ্জা—এসবই মানবিক উপলব্ধিজাত বোধের বহিঃপ্রকাশ। মিষ্টি খেতে তো ভালোই লাগে কিংবা কড়া ঝাল। কিন্তু শরীর যখন মিষ্টিসর্বস্ব হয় তখন তা ডায়াবেটিসে ধরে। যেমন করে ধরে, অতি ঝালে আলসার। তেমন করেই চরিত্রে মমত্ববোধ, রুচিবোধ আর সহনশীলতা বাদ দিয়ে শুধু সাহস আর দুর্বারতা থাকলে, তার ধ্বংসও কিন্তু অনিবার্য। 

শাসন মানেই সিংহভাগ অভিভাবক মনে করেন, সন্তানকে বকাঝকা বা মারধরের ভেতর থেকে বড় করার কথা বলা হচ্ছে। আচরণের মতো, ভাবনা-চিন্তা ও তা চর্চায় আমরা বেশ আত্মকেন্দ্রিক। খুব সহজেই মাথায় তোলা অথবা ছুড়ে ফেলার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সন্তানের কাছে সবচেয়ে আপনজন হয়ে উঠতে হবে। একে অন্যকে কেয়ার করার জন্য দ্বিপাক্ষিক মানসিক যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। সন্তান যেমন ভালো কিছু দেখে আনন্দ পাবে, প্রতিকূলতায় নিজেকে সামাল দেওয়ার শক্তি পাবে, একইভাবে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, আপনার ছোট্ট সন্তানটি যেন কাউকে আঘাত পেতে দেখে হাততালি দিয়ে না ওঠে, কারও কান্না দেখে হেসে না ফেলে। মোট কথা, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার পাশাপাশি অন্যরাও যে গুরুত্বহীন নয়, সেই বোধ আপনার সন্তানের মাঝে আপনাকেই ছড়াতে হবে।   

এইতো কদিন আগেই ১৭ বছরের এক সন্তান মা-বাবার গায়ে আগুন দিয়েছে। বাবাটা মারা গেলেন যন্ত্রণায় ছটফট করে। পোড়ার ঘটনা আমায় বিহ্বল করেছে, তার চেয়ে আমার কাছে আরও বিস্ময়ের, এই ছেলে এরই মধ্যে পাঁচ লাখ টাকার মোটরবাইক চালায়, পোষাকে কিংবা সজ্জায় বখে যাওয়ার সুস্পষ্ট ছাপ। অথচ এসব করেই একটা ছেলে সেই ঘরে বেড়ে উঠেছে আর সেই বাবা-মা তাকে এভাবেই বাড়তে দিয়েছেন। বোঝাই যায়, সে বাধা পেয়ে অভ্যস্ত নয়। যে সন্তান মা-বাবাকে আগুনে পোড়ায়, তার এই বর্বর আচরণও হয়তো সেদিনই প্রথম ছিল না। কাজেই আদরের সন্তানকে আলেকজান্ডার নাকি দক্ষিণ-ভারতের হিরো বানাবেন তা তো আপনার খুশি, কিন্তু যেটা মিডিয়ার খবর হলো, তা তো ভালো কোনও বার্তা বয়ে আনে না। পুরোটা না হলেও অভিভাবক হিসেবে আগুনের আঁচ আমাদের অনেকেরই প্রাপ্য। আসুন, সময় থাকতে সবাই সাধন করে নেই।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট নিউজ এডিটর, একাত্তরটেলিভিশন

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ