X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘চাপাতি বদরুল’ এবং আমরা

হারুন উর রশীদ
০৪ অক্টোবর ২০১৬, ২৩:৪৬আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:২৩

হারুন উর রশীদ ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলমের চাপাতির আঘাতে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে খাদিজা বেগম নার্গিস। সিলেট এমসি কলেজের মসজিদের পাশে সোমবার বিকেলে যখন বদরুল তাকে কয়েক মিনিট ধরে চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে, তখন সেই দৃশ্য কেউ মোবাইল ফোনে ভিডিও করেছেন। কেউ তুলেছেন ছবি। কেউবা নার্গিসের চিৎকার শুনে বলেছেন, ও মাই গড!
সেই ভিডিও এবং ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সংবাদ মাধ্যম হয়ে ভাইরাল হয়ে গেছে। হাহাকার পড়ে গেছে। একদিকে নার্গিসের জন্য প্রার্থনা, অন্যদিকে বদরুলের জন্য ঘৃণা। কান্না আর ক্ষোভ এখন সহযাত্রী।
বদরুল সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি)শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধ নিয়েছে সে পরিকল্পিতভাবে। মৃত ভেবে ফেলে রেখে পালানোর সময় সে জনতার হাতে আটক হয়ে এখন পুলিশ হেফাজতে। ভিডিওতে স্পষ্ট যে, বদরুল কি নৃশংসভাবে কুপিয়েছে নার্গিসকে। তাকে ঢাকায় আনার পর চিকিৎসকরা হতভম্ব হয়ে পড়েন। তারা শুধু একটি কথাই বলেছেন, নার্গিসের মাথা আর হাতে অসংখ্য গভীর ক্ষত।
নার্গিস বেঁচে থাকুক। আমরা তার জন্য প্রার্থনা করি। যদিও চিকিৎসকরা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অস্ত্রোপচারের পর বলেছেন, ৭২ ঘন্টার আগে তার ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে নার্গিস যদি বেঁচেও যান, তারপরও এই ঘটনা আমাদের যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে,তা থেকে আমরা বাঁচবো কীভাবে?
১. নার্গিসকে কোপানোর ঠিক আগ মুহূর্তে সেখানে বদরুলের কাছে বেশ কয়েকজন যুবককে দেখা গেছে। তারা দৌড়ে গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেন। চারপাশে আরও লোক ছিলেন। জায়গাটি এমসি কলেজ ক্যাম্পাস। কোপানো হয় বিকালে সদর রাস্তায়। তাই ভিডিও করা এবং ছবি তোলার লোকের অভাব ছিল না। একজন নয়, একাধিক লোক ভিডিও করেছেন, ছবি তুলেছেন। একটি ভিডিও’র মধ্যে আরও অনেককে ভিডিও করতে দেখা যায়।
তারা নিরাপদ দূরত্বে থেকে চিৎকার, ধর ধর শব্দ করেছেন ঠিকই। একটি চাপাতিসহ বদরুলকে প্রতিরোধে এগিয়ে যাননি কেউই। একা হয়তো এগিয়ে যাওয়া ভয়ের। কিন্তু এতগুলো লোক কেন সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধে এগিয়ে গেলেন না। প্রতিরোধের আগে নিবৃত্ত করারও সুযোগ ছিল বলে আমার মনে হয়। কারণ, বদরুল যখন কোপানো শুরু করে তখনও তার কাছেই পাঁচ/ছয় জন তরুণ ছিলেন।  তাহলে তারুণ্য, মানবতা সব কি এখন চাপাতির ভয়ে ভিতু? প্রশ্ন করতে পারেন, আমি নিজে সেখানে থাকলে কী করতাম। হয়তো পরিস্থিতি দেখে আমিও দূরে দাঁড়িয়ে ছবিই তুলতাম, আর হায় হায় করতাম। তাতেওতো একই কথা। চাপাতির জয়, মানবতার পরাজয়।
২. ঢাকার স্কয়ার হাসপতালে  মঙ্গলবার দুপুরে আহত নার্গিসকে দেখতে গিয়েছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন। কিন্তু, নার্গিসের অবস্থা বিবেচনায় চিকিৎসকরা সাধারণ নিয়মেই ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে ভিজিটর হিসাবে এলাউ করেননি। আমার ধারণা, ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক নিজেও সেটা জানতেন। তিনি গিয়েছিলেন একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। আর তাতে তিনি সফল হয়েছেন। বদরুল যে ছাত্রলীগের কেউ নয়, তা তিনি সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে বলতে পেরেছেন। তিনি বলেছেন,‘ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে লেখা আছে কোনও কর্মী কাজে যোগ দিলে ও বিয়ে করলে তার সদস্য পদ অটোমেটিক বাতিল হয়ে যায়। আপনারা এরই মধ্যে দেখেছেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রেস রিলিজে বলা হয়েছে, ‘বদরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও কর্মকাণ্ডে যুক্ত নয়। সে বর্তমানে সুনামগঞ্জের ছাতকের আলহাজ্ব আয়াতুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছে। সুতারাং সে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের কর্মী নয়।’

আমরা বুঝতে পারলাম বদরুল ছাত্রলীগ হলেও গঠনতান্ত্রিক ছাত্রলীগ নয়। এটা বলে কী প্রমাণের চেষ্টা করেছেন ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক? তিনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, সে এখনও ছাত্রলীগে থাকলে এই নির্মম এবং জঘন্য ঘটনা ঘটাতো না?  আর তিনি কেন স্কয়ার হাসপাতালে গেলেন? নার্গিসতো তার পরিচিত কেউ নন। তাহলে তিনি নার্গিসকে দেখার নামে ছাত্রলীগকে কলঙ্কমুক্ত করার মিশনে হাসপাতাল ভ্রমণ করলেন!

৩. শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের  কর্তৃপক্ষ বদরুলকে মঙ্গলবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে। তারা জানিয়েছে, বদরুল ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র হলেও এখনও তার অনার্স শেষ হয়নি। তাহলে প্রশ্ন, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক কিভাবে বললেন বদরুল ছাত্রও নয় ছাত্রলীগের কেউ নয়।  আর এটা করতে গিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কেও নিজের মত করে ব্যবহার করেছেন। আর শাবি ছাত্রলীগের ২০১৫ সালের কমিটি’র  বিজ্ঞপ্তির সই করা যে কাগজ, তাতে বদরুল আলম এক নম্বর সহসম্পাদক।

৪. বদরুল নার্গিসকে হত্যার পরিকল্পনা করেই গিয়েছিল। এবং নার্গিস নিহত হয়েছে ভেবেই সে পালানোর চেষ্টা করে। এখানে বদরুলের মানসিক অবস্থা ব্যাখ্যা করার একটি সুযোগ আছে-

ক. বদরুল ছাত্রলীগ নেতা। সুতরাং সে ক্ষমতাধর। তাকে পাত্তা দেয়নি নার্গিস। এটা তার ক্ষমতার দম্ভকে আরও জাগিয়ে তুলেছে। সে ক্ষমতার দম্ভে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

খ.সে চাইলে নার্গিসকে পিস্তল বা রিভলবার দিয়েও আক্রমণ করতে পারতো। প্রভাবশালী ছাত্রলীগ নেতার পক্ষে এটা জোগাড় করা কি খুবই কঠিন ছিল! কিন্তু সে বেছে নিয়ে চাপাতি। এবং এমন নয় যে হঠাৎ হাতের কাছে পাওয়া চাপাতি দিয়ে সে আঘাত করেছে। সে আগেই ওই পথে চাপাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যা অনেকে দেখেছেন।

গ. চাপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে নৃশংসতা ও ক্ষমতা প্রকাশ করতে চেয়েছে বদরুল। সে চেয়েছে নির্মমতা প্রকাশ করতে।

ঘ. বদরুলের এই আচরণকে ‘বাংলা ট্রিবিউন’ বলেছে ‘জঙ্গি’ নৃশংসতা। অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা তাৎক্ষণিক প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তার আচরণ বিশ্লেষণ করে এই অভিমত দিয়েছেন।

ঙ. আমার কথা হলো জঙ্গিবাদ শুধু ধর্মের ভিত্তিতেই হয় না। কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তিও  আচার-আচরণে জঙ্গি হয়ে উঠতে পারে। বিবেচনা করলে  দেখবেন বদরুলের পুরো কাজে জঙ্গি মানসিকতা স্পষ্ট। নির্মমতা, পরিকল্পনা এবং অস্ত্রের ব্যবহার সে কথাই বলছে।

৫. গত ২০ সেপ্টেম্বর ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে করুনা নামে এক তরণীকে একই স্টাইলে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে সুরেন্দর সিং নামে এক যুবক। উত্তর দিল্লির বুরারি এলাকা দিয়ে করুণা তার এক আত্মীয়ের সঙ্গে হেঁটে যাওয়ার সময় সাইকেলে এসে তাকে ২০টিরও কেশি ছুরিকাঘাত করে সুরেন্দর। শুধু তাই নয়, হামলাকারী এক পর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা তরুণীর মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করে এবং লাথি মারে।

সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, ওই ঘটনায়ও তরুণীকে কেউ বাঁচাতে এগিয়ে যায়নি। দু’একজন এগিয়ে গেলে হামলাকারী তরুণের ভয়ে তারা পিছু হঁটেন। আর সুরেন্দরও ওই তরুণীর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় অবশ্য জনতা তাকে ধরে পুলিশে দেয়।

দু’টি ঘটনার সঙ্গে মিল আছে। আবার অমিলও আছে। মিল হলো মানসিকতা এবং আক্রমণ ও ব্যবহৃত অস্ত্রের ধরনে। আর অমিল হলো ক্ষমতার। বদরুল ক্ষমতাধর, কিন্তু সুরেন্দরের রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায়না। তারা দু’জন দুই দেশের হলেও মগজের পচন একই। জঙ্গিবাদের মতই এটা একশ্রেণির তরুণের মানসিকতায় ঢুকে যাচ্ছে নির্মম প্রতিশোধ পরায়ণতা, প্রতিহিংসা, অমানবিকতা।

৬. এরজন্য বাংলাদেশে একটি প্রেক্ষাপট আছে। তা হলো বিচারহীনতা। কুমিল্লায় তনু হত্যার ঘটনা যেমন বিচারহীনতার একটি বড় উদাহরণ। এর কারণ, যাদের নাম আসছে তারা প্রভাবশালী এবং নিয়ন্ত্রক শ্রেণিভুক্ত। ঢাকায় সর্বশেষ আফসানা মৃত্যুরহস্য জট আরও জট পাকানো হচেছ। কারণ, এর সঙ্গে জড়িত তেজগাঁ কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিন। এই উদাহরণ হয়তো আরও বাড়ানো যাবে, তাতে কি বিচারহীনতা এড়ানো যাবে। এই বিচারহীনতা অপরাধীকে বেপরোয়া করে। ক্ষমতাধর অপরাধীকে করে চরম বেপরোয়া।

বাংলাদেশের গুলশান হামলার প্রেক্ষাপট তৈরি হতো না যদি আগেই ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের ওপর হামলা এবং হত্যায় জড়িতদের আটক  করা হতো। বিচারের মুখোমুখি করা হতো।

৭. কেউ একজন মঙ্গলবার সন্ধ্যায়ই সিলেটের নার্গিস মারা গেছে ভেবে আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে বলে আশ্বস্থ করেন। আস্থা রাখতে বলেন। আমরা প্রার্থনা করি, নার্গিস হত্যা প্রচেষ্টার বিচার হোক। মরে গিয়ে বিচার পাওয়ার দরকার নেই। আর তা-ই যদি হয় তাহলেও কি আদৌ বিচার হবে?

কারণ, আমরা দেখছি দায় এড়ানোর মানসিকতা। আমার মতো নিরীহ যারা, তারা নিজে বাঁচতে নিরাপদ দূরত্বে থেকে ভিডিও করেন। ছাত্রলীগ দায় এড়াতে বিবৃতি দেয়- সে আমাদের কেউ নয়, ছাত্রলীগের সঙ্গে তার নাম জড়াবেন না। পুলিশ সময় মতো ঘটনাস্থলে হাজির হতে পারেনা। বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ প্রথমে দুর্বৃত্তকে ছাত্র হিসাবেই স্বীকার করে না। পরে সাময়িক বহিষ্কার করে দায় এড়ায়। শেষ পর্যন্ত আমাদের আর কতো দায় এড়ানোর কলাকৌশল এবং বিচারের আশ্বাসের নাটক দেখতে হবে।

যদি বিচারের আশ্বাস প্রকৃত আশ্বাসই হয়, তাহলে আমারা সবাই দায় এড়াতে চাইবো কেন?

পুনশ্চ: কেউ যখন দায়িত্ব নিতে চায় না, তাহলে আমরা দায় কি চাপাতিকে দেব? বলেই দিই ‘চাপাতি বদরুলের’ দায় কি  শুধুই চাপাতির!

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৭ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলা বৃষ্টির পূর্বাভাস
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৭ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলা বৃষ্টির পূর্বাভাস
আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আজ থেকে শুরু প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী
আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আজ থেকে শুরু প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী
আমার কোনও অনুশোচনা নেই: গার্দিওলা
আমার কোনও অনুশোচনা নেই: গার্দিওলা
আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব: নেতানিয়াহু
আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব: নেতানিয়াহু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ