X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবাদ হোক অধিকার আদায়ের ভাষা

লীনা পারভীন
০৭ অক্টোবর ২০১৬, ১২:২৪আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০১৬, ১২:২৫

লীনা পারভীন আমরা বাংলাদেশের নাগরিকরা বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল পার করছি। একদিকে বিশ্বজুড়ে মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান যা থেকে বাংলাদেশও আলাদা নয়, অন্যদিকে সামাজিক অস্থিরতা, নারী নির্যাতন সহ বিভিন্নরকম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে আমরা দিনযাপন করছি। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ঘটনা আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে গেছে সামগ্রিকভাবে। নারী নির্যাতনের তালিকা দিনে দিনে বড় হয়েই যাচ্ছে কিন্তু কোনটারই এখনও পর্যন্ত সুবিচার আসেনি। যে তনু ইস্যুতে সারা দেশ এমনকি, দেশ পেরিয়ে বিদেশেও সরব ছিলাম আমরা। কিন্তু তনুর বিচার কি পেয়েছি?
প্রতিমুহূর্তে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে অযত্নে অবহেলায়। এভাবেই ইস্যু আসে আমরা সরব হই আবার মিইয়ে যাই প্রাকৃতিক নিয়মে। বর্তমানে আমরা আবার সোচ্চার হয়েছি সিলেটে এক বখাটে এবং মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত এক ছাত্র কর্তৃক চাপাতির কোপের শিকার নার্গিসকে নিয়ে। জানিনা নার্গিস আর ফিরবে কিনা, ফিরলেও স্বাভাবিক হবে কিনা? এইরকম হাজারো প্রশ্ন আছে মনে। যদিও আসামিকে হাতে নাতে ধরে পুলিশে দেওয়া হয়েছে কিন্তু আমরা কতটা নিশ্চিত হতে পারছি যে এর সুবিচার পাবো আমরা? এই ইস্যুটি নিয়েও আমাদের মধ্যে চলছে বিভক্তিমূলক আলোচনা।
অপরাধীর অপরাধের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে তার রাজনৈতিক পরিচয়। আমি বলছি না তার রাজনৈতিক পরিচয়কে অস্বীকার করার কথা কিন্তু আমাদের তর্কের বিষয় যদি এখানেই থেমে যায় তাহলে ন্যায় বিচারের লড়াই হবে কখন? কিভাবে? বদরুলতো তাকে সাংগঠনিক প্রভাব খাটিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি বা খুন করতে চায়নি। এখানে যদি আমরা ব্যক্তি বদরুলের চেয়ে সংগঠন হিসাবে ছাত্রলীগকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রতিবাদের ভাষা নির্ধারণ করি তাহলে তনুর ক্ষেত্রে কাকে কী পরিচয় দেব? বা উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের যে বাচ্চা মেয়েটিকে খুন করা হয়েছে তার খুনিকে কী পরিচয়ে আখ্যায়িত করবো? আসলে, খুনির পরিচয় সে খুনি, অপরাধীর পরিচয় সে অপরাধী। তাদের কোনও বংশ পরিচয় বা অন্য কোনও পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়াটা হবে মূল ফোকাস থেকে সরে আসা।

সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলো প্রতিনিয়ত সক্রিয় হচ্ছে নিত্যনতুন কৌশলের মাধ্যমে। তারা কিন্তু নিজেদের মধ্যে একটি সক্রিয় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। তাদের মধ্যে চূড়ান্ত অর্থে কোনও বিরোধ নেই এবং সেই জায়গাটাতেই তারা নিজেদের ঐক্য রক্ষা করে চলেছে। সে তুলনায় আমরা যারা প্রগতির কথা ভাবছি যারা প্রতিনিয়ত নিজেদের ক্ষোভের কথা লিখছি, একটু থেকে একটু সামান্য কিছু ঘটলেই সরকারের তুলোধুনা করতে ছাড়ছি না তারা কি একবারও ভেবে দেখেছি এই মুহূর্তে আমাদের বড় শত্রু কে? সেটা কি নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছি? আমার মনে হচ্ছে আমরা তা করতে পারছি না। আর পারছি না বলেই আমরা আজো আলাদা আলাদাভাবে লড়াই করার চেষ্টা করছি, কেউ বা মিছিলটা একটু লম্বা করতে পারছি আর কেউবা সামান্য কয়েকজনের সম্মিলনে কিছু শ্লোগান দিয়েই তৃপ্তি মিটানোর চেষ্টা করছি আর ঘরে বসে ফেসবুক টুইটারে অন্যদের মুণ্ডুপাত করছি। বর্তমান সময়ে যত ঘটনা ঘটছে কোনটারই কিন্তু কম প্রতিবাদ হয়নি কিন্তু কতগুলোর আমরা ফলাফল আদায় করতে পেরেছি?

আমরা কি পেরেছি কোনও বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনের ডাক দিতে? আমরা সবাই কেবল ঘটনাভিত্তিক প্রতিবাদে ব্যস্ত। একটি করে ঘটনা ঘটছে আর আমরা তার প্রতিবাদে কিছু মিছিল মিটিং করে চলেছি। হয়তো কোনটার বিচারে রাষ্ট্রকে আমরা বাধ্য করতে পারছি আর কোনটা থেকে যাচ্ছে বিচারহীনতায়। আমাদেরকে খুব গভীরভাবে ভাবতে হবে আসলে এর কারণ কী? আমি মনে করি এর মূল কারণ আমাদের ঐক্যের অভাব, বোধের অভাব, রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাব, শত্রু মিত্র নির্ধারণের অভাব এবং ব্যক্তিগত ইমেজের ঊর্ধ্বে উঠতে পারার অভাব। পহেলা বৈশাখের নারী নিপীড়নের ঘটনা থেকে আজকের নার্গিস সব জায়গাতেই একই ধারায় চলছে। পহেলা বৈশাখে নারী নীপিড়নের ঘটনায় আমি দেখেছি এক একদিন এক এক গ্রুপের মিছিল। এবং সেইসব মিছিলের কোনও কোনওটা শুধু একদিনেই সীমাবদ্ধ। কারও মধ্যেই আমি দেখিনি একটি সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তুলবার তাগিদ। এখানে কোথায় যেন আমাদের ‘প্রতিবাদ বিলাসীতা’র একটি সুক্ষ বহিঃপ্রকাশ ছিল।

একই দিনে আমি দেখেছি কয়েক গজের মধ্যেই দুটি তিনটি করে প্রতিবাদ সমাবেশ। আমার মতো যারা কোনও নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর হয়ে যাইনি তারা একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম আসলে আমি কোনটাতে যাবো? কারা সত্যিকার অর্থে বিচারের জন্য লড়াই করছে? আয়োজকদের মধ্যে আমি দেখেছি এক ধরনের তথাকথিত শো-অফ মানষিকতা। আমি এদের কারোরই প্রচেষ্টাকে খাটো করে দেখছি না, এখানে আমার মন্তব্যকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যার কোনও অবকাশ নেই।

হয়তো কেউ দ্বিমত করতেই পারনে। কিন্তু আমি বলার চেষ্টা করছি আমার মতো হাজারো সাধারণ মানুষ খুশি হতো যদি আমি বিনা দ্বিধায় শ্লোগান তুলতে পারতাম একটি নির্দিষ্ট ব্যানারের নিচে। এবং আজকাল প্রায় প্রতিটা ঘটনার ক্ষেত্রেই একই রকমভাবে ঘটছে। কিছু লোক ব্যানারের সামনে থেকে বড় বড় কথা বলে টেলিভিশনের কল্যাণে রাতারাতি আন্দোলনের আইকন হয়ে যাচ্ছেন। সামাজিকভাবে নিজের কদর বাড়াচ্ছেন। এভাবে হয় না। আন্দোলন একটি ধারাবাহিক ও সম্মিলিত প্রক্রিয়া। এর কোনও সংক্ষিপ্ত পথ নেই। কেবল ফেসবুক, টুইটারে বা দু একদিন যাদুঘর বা শাহবাগের সামনে ব্যানার নিয়ে দাঁড়ালেই সফলতা আসে না। পহেলা বৈশাখের ঘটনার যদি একটি ধারাবাহিক, সামগ্রিক এবং সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তোলা যেত তাহলে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাটা অনেক সহজ হত। রাষ্ট্রকে বাধ্য করা যেত দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জন্য। আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্র যদি আমরা বুঝে থাকি তাহলে এটাও আমরা জানি যে, এখানে বিনা প্রতিবাদে কোনও প্রতিকার পাওয়ার আশা করাটাই বোকামি। আর রাষ্ট্র কোনও বায়বীয় পদার্থ নয়। আমাদেরকে নিয়েই রাষ্ট্র। তাই কেবল রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা বলে অবসরে যাওয়ার কোনও অবকাশ নেই।

বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন ছাড়া কখনই কোনও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বাধ্য করা যায় না ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়। বাংলাদেশের জন্মই তার একটি বড় উদাহরণ। রাজনীতি মানে কোনও দল নয়, রাজনীতি হলো একটি দর্শন, একটি শিখন প্রক্রিয়া। তাই রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত হওয়া ছাড়া কোনও আন্দোলনকে সামাজিক রুপ দেওয়া সম্ভব নয়।

আমাদের নতুন ও উদ্যোমী তরুণ প্রজন্মকে তাই রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত হতে হবে। সমাজের ও রাষ্ট্রের পরিচালন কৌশল সম্পর্কে জানতে হবে, রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে একটি অ্যানালাইসিস থাকতে হবে, আমি কোনও ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা চাই তার সম্পর্কে নিজস্ব মতামত গড়ে তুলতে হবে এবং সেই মতের পক্ষে গড়ে তুলতে হবে নিরন্তর লড়াই। আর এই মুহূর্তে একটাই চাওয়া, প্রতিবাদ হোক অধিকার আদায়ের ভাষা, ইমেজ রক্ষার নয়।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ