X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান: বিদ্বেষ বনাম সমালোচনা

আমীন আল রশীদ
০৮ অক্টোবর ২০১৬, ২০:১৬আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০১৬, ২০:২০

আমিন আল রশীদ কোনও বেসরকারি সংস্থা বা ব্যক্তি সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক বা অশালীন বক্তব্য দিলে বা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড করলে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও’র নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে এনজিও ব্যুরো—এমন বিধান রেখে ৫ অক্টোবর সংসদে পাস হলো বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন বিল, ২০১৬।
প্রশ্ন হলো, ‘বিদ্বেষমূলক’ বা ‘অশালীন’ বক্তব্যের সংজ্ঞা কী? সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়নে যথেষ্ট সময় দেন না বা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ অথবা বিল নিয়ে সংসদে যথেষ্ট বিতর্ক হয় না—এ রকম কোনও মন্তব্য যদি কোনও ব্যক্তি বা কোনও এনজিও’র রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তাহলে সেটি কি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় সংসদের প্রতি বিদ্বেষমূলক হবে?
আবার কোনও বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কোনও রিপোর্টে যদি নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে কোনও সমালোচনা করা হয় এবং সেটি  ঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার পরও যদি নির্বাচন কমিশনের তরফে বলা হয় যে, এটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে হেয় করেছে, তাহলে সেটি কি রাষ্ট্রদ্রোহিতার আওতায় পড়বে?
স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছর টিআইবির ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সংসদকে ‘পুতুলনাচের নাট্যশালা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই মন্তব্যকে ঘিরে সংসদে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরপরই সংসদে এই বিলটি উত্থাপন করা হয়। টিআইবি বলেছিল, বর্তমান জাতীয় সংসদ শুধুই নিয়ম রক্ষার এবং এটি কেবল ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র ভুবনে পরিণত হয়েছে। আরেকটি নির্বাচনই পারে জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে।
এরপরই এই রিপোর্টের কড়া সমালোচনা হয় জাতীয় সংসদে। ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর পয়েন্ট অব অর্ডারের ওই আলোচনায় সংসদ সদস্যরা টিআইবির নির্বাহী পরিচালকের ওই বক্তব্যকে সংবিধান পরিপন্থী উল্লেখ করে সংস্থাটিকে সংসদে তলবের দাবি জানান।
সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেন, টিআইবির বক্তব্য ও কার্যক্রম খতিয়ে দেখা দরকার। তারা যে বক্তব্য দিয়েছে, তা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে কিনা, তা দেখতে হবে। তারা সাংবিধানিকভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নতুন নির্বাচন চেয়েছে। বিরোধী দলকে কথিত বিরোধী দল বলেছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘টিআইবির কোথা থেকে টাকা আসে, কিভাবে খরচ হয়, এর কোনও জবাবদিহিতা নেই। তাদের একটাই কাজ—বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অগ্রগতি বানচাল করা।’ আরও বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য টিআইবির কড়া সমালোচনা করেন। কেউ কেউ এনজিওর কার্যক্রম মনিটরিং আরও জোরদার করা এবং এ সম্পর্কিত কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি জানান।

এই ঘটনার আগে ২০১৪ সালের ১৮ মার্চ টিআইবি যে পার্লামেন্ট ওয়াচ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে বলা হয়েছিল, জাতীয় পার্টি দশম সংসদে নামে বিরোধী দল হিসেবে থাকলেও, সেই দায়িত্ব তারা পালন করতে পারছে না। কার্যকর বিরোধী দল পেতে দশম সংসদের মেয়াদ ‘সাময়িক’ হবে বলেও আশা প্রকাশ করে টিআইবি। এই প্রতিবেদন তুলে ধরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিরোধী দল বলতে যা বোঝায়, তা এই সংসদে নেই।’ টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘বিরোধী দল হবে বিরোধী দলের মতো, তারা সরকারের অংশ হবে না। জাতীয় পার্টি কি তাদের ভূমিকা রাখছে? তারা নামে মাত্র বিরোধী দল।’

ওই বছরের ৭ জুলাই দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনের কার্যক্রমের ওপর টিআইবি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে বলা হয়, সংসদে কোরাম সংকটের দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা কিছুটা কমে এলেও দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের উপস্থিতির ঘাটতির কারণে কোরাম সংকট এখনও উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। দৈনিক গড়ে ২৮ মিনিট কোরাম সংকটের কারণে নষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের অংশ হয়েও বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির পরিচিতির প্রচেষ্টা সংসদকে একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য দিয়েছে।  সংসদকে কার্যকর করতে ১৮ দফা সুপারিশও তুলে ধরে টিআইবি।

টিআইবির এই প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সংস্থার ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন,সংসদের মূল কাজ জনস্বার্থে আইন প্রণয়ন করা, অথচ সংসদের কার্যাবলির মধ্যে আইন প্রণয়নের হার ২ শতাংশেও পৌঁছায় না। এর কারণ ব্যবসায়ী অধ্যুষিত সংসদ। আর সেজন্যই জনগণের স্বার্থের বিষয়গুলো প্রাধান্য পায় না এবং জনস্বার্থে আইন প্রণয়নে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। অথচ ব্যবসায়িক স্বার্থের আইনগুলো অত্যন্ত দ্রুত পাস হয়।

তবে টিআইবির এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিনই এর সমালোচনা করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। তিনি বলেন, টিআইবি সব সময় তীর্যক রিপোর্ট দেয়। তাদের প্রতিবেদন সঠিক নয়। এরশাদের অভিমত, জাতীয় পার্টি সংঘাত কিংবা সংসদ বর্জনে বিশ্বাস করে না বলেই টিআইবি দলটিকে কার্যকর বিরোধী দল মনে করছে না। বলেন, বিরোধী দল জনগণের প্রতিনিধি। আমরা সব কাজ জনগণের স্বার্থেই করি।

তবে শুধু টিআইবি নয়, জাতীয় সংসদের এমপিদের ভূমিকা, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া, সংসদীয় কমিটিগুলোর দুর্বলতা, এমপিদের বক্তব্যে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে অশালীন বক্তব্য দেওয়াসহ নানা ইস্যুতে বিভিন্ন সময়ে সমালোচনা এসেছে নানা ফোরাম থেকে।

তবে শুধু টিআইবি নয়, সংসদ ও সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে নানাবিধ সমালোচনা হয়েছে বিভিন্ন ফোরামে। গত ২ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে খোদ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘একটা বিষয় পীড়া দেয়, যখন দেখি নতুন যেসব আইন বা সংবিধান সংশোধন হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে আইনসভায় আলোচনা হয় না। আইনের উদ্দেশ্য বোঝার জন্য যখন সংসদীয় বিতর্ক নিয়ে আসি, সেখানে কিছু পাই না।’ তিনি বলেন, ‘আইন প্রণেতাদের অন্যতম দুর্বলতা হলো আইন বিষয়ে অজ্ঞতা; অজ্ঞতা থাকতে পারে, আমারও অজ্ঞতা আছে। কিন্তু এমপিদের মধ্যে লেখাপড়া করা, আইন বোঝার একাগ্রতা কম দেখা যায়। এ জন্য ধীরে ধীরে আইনসভায় আইনের চর্চা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।’

এরপর গত আগস্টে রাজধানীতে আরেক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা যখন কোনও আইন প্রণয়ন করবেন, তখন দেখবেন, সেটি যেন সঠিক ও নির্ভুল হয়। ত্রুটিপূর্ণ আইন করলে বিচার বিভাগের ওপর চাপ পড়ে।’

প্রধান বিচারপতি এই যে কথাগুলো বললেন, এগুলো কি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদকে হেয় করেছে নাকি এই কথাগুলো তিনি বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে বলেছেন? নিশ্চয়ই না। তিনি যা বলেছেন, সেটিই বাস্তবতা। সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় রাজনৈতিক বিষোদ্গারে ঘণ্টার পটর ঘণ্টা কেটে যায়। কিন্তু আইন প্রণয়নের বেলায় সময় যেন খুবই কম। এমপিরা যেসব ছাঁটাই প্রস্তাব বা সংশোধনী দেন, তার ওপরে আলোচনা হয় নামমাত্র। আবার স্পর্শকাতর বা অতিগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আনা বিলের ওপর যে দীর্ঘ বিতর্ক ও আলোচনা করবেন, এমন জানাশোনা এমপির সংখ্যাও হাতেগোনা। সুতরাং এইসব সংকট নিয়ে যখন কেউ কথা বলবেন বা রিপোর্ট দেবেন, সেটি কি সংসদের প্রতি বিদ্বেষমূলক হবে?

আমাদের জাতীয় সংসদ এবং সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সাধারণ ধারণা কী? এটি যদি কেউ বলেন বা লেখেন, সেটি কি সংসদকে হেয় করবে?

সংসদ হচ্ছে মানুষের আশা-ভরসার জায়গা। সেখানে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে যারা কথা বলেন, আমরা নাগরিক হিসেবে তাদের কাছ থেকে যা প্রত্যাশা করি, তারা যদি তা দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে সেই ব্যর্থতার সমালোচনা করার অধিকার কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের থাকবে না?

স্বাধীনতার পর গত ৪৫ বছরে আমরা কি একটি কার্যকর সংসদ তৈরি করতে পেরেছি। আমরা কি দেশে আইনের শাসন এবং কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক পরিবেশ পেয়েছি? আমরা কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখিয়ে সুশাসন নিশ্চিত করার পথে এগিয়ে যেতে পেরেছি? এখনও আমাদের উন্নয়নের পথে দুর্নীতি, লুটপাট, দলীয়করণ, জবাবদিহিতার সংকট কি অন্যতম প্রধান অন্তরায় নয়? সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের কমিটিগুলো কি সঠিক ভূমিকা রাখতে পারছে? যদি না পারে তাহলে কেন সাধারণ মানুষ এবং প্রতিষ্ঠান এসব নিয়ে কথা বলবে না বা বলতে পারবে না? 

বাস্তবতা হলো, গত এক দশকে যতবারই টিআইবি জাতীয় সংসদ বা রাষ্ট্রের দুর্নীতি নিয়ে কোনও গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, ততবারই তারা ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়েছে। কারণ দুর্নীতি ও দুঃশাসন প্রধানত সরকারি দল এবং সরকারের কর্তা ব্যক্তিরাই করে থাকেন (সব আমলেই)। ফলে তারা এসব রিপোর্টকে ভয় পান এবং ভয় পান বলেই এদের নিয়ন্ত্রণ করতে চান। কারণ এসব রিপোর্ট অনেক গোমর ফাঁস করে দেয়। কেউই চায় না তার থলের বিড়াল বেরিয়ে আসুক।

লেখক, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পোড়া রোগীদের যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে তাপদাহ
পোড়া রোগীদের যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে তাপদাহ
নিখোঁজের ২৫ দিন পর ছাত্রলীগ নেতার মরদেহ উদ্ধার
নিখোঁজের ২৫ দিন পর ছাত্রলীগ নেতার মরদেহ উদ্ধার
যুক্তরাষ্ট্র বড় শক্তি, তাদের পরোয়া করতে হয়: শ্রম প্রতিমন্ত্রী
যুক্তরাষ্ট্র বড় শক্তি, তাদের পরোয়া করতে হয়: শ্রম প্রতিমন্ত্রী
ব্যাংক ডাকাতি রোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে
ব্যাংক ডাকাতি রোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ