X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিপ্লবের ফেরিওয়ালা চে গুয়েভারা

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৯ অক্টোবর ২০১৬, ১৩:০৩আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০১৬, ১৪:৫২

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার বারিয়েন্টোস সরকার ব্যাপক এক অভিযান চালিয়ে আটক করেছিল চে গুয়েভারাকে। সম্পূর্ণ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল আমেরিকার সিআইএ। ডালাস ডকট্রিনের শেষ কথা ছিল ল্যাটিনে সব বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে উচ্ছেদ করে দিতে হবে। কোনও বিচারের সম্মুখীন করার প্রয়োজনই মনে করেনি বলিভিয়ার বারিয়েন্টোস সরকার আর সিআইএ। সে দিনেই চে গুয়েভারাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ৯ অক্টোবর  ২০১৬, চে গুয়েভারার ৪৯ তম মৃত্যুদিবস।
এই মহান বীর চে গুয়েভারা জন্মেছিলেন আর্জেন্টিনায় ১৯২৮ সালে। আর মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলিভিয়ার জঙ্গলে ১৯৬৭ সালে। আজন্মের হাপানি রোগী চে গুয়েভারা মনে করতেন তিনি সারা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের সন্তান। তাই তিনি কখনও কিউবায়, কখনও কঙ্গো, কখনও বলিভিয়ায় নির্যাতিতদের পক্ষে মুক্তির মশাল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কোথাও সফল হয়েছেন, কোথাও ভিত্তি প্রস্তুত করেছেন, আবার বলিভিয়ায় গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
কিছু লোক কথা তুলেছেন সোভিয়েত ভেঙে গেছে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো রূপ পাল্টে গেছে, বার্লিনের দেয়াল ধসে পড়েছে- এ অবস্থায় বিশ শতকের চে গুয়েভারা একবিংশ শতাব্দীতে কতটুকু প্রাসঙ্গিক। সারা বিশ্বব্যাপী চে গুয়েভারা হচ্ছে একটি আকুল বিদ্রোহী আকাঙ্ক্ষার অবিনাশী উৎস। এখন চে  গুয়েভারা আর নেই। বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের কাছে তার প্রতিকৃতিই তার প্রতিনিধিত্ব করছে। তাই আমেরিকার কালো মানুষগুলোকে দেখা যায় চে  গুয়েভারার প্রতিকৃতি নিয়ে নির্যাতনের বিরুদ্ধে মিছিল করতে। চে গুয়েভারা তাদের শক্তির তাদের সাহসের উৎস। যুগ শেষ হতে পারে, শতাব্দী ফুরিয়ে যেতে পারে এ অবিনাশী আকাঙ্ক্ষার নির্ভেজাল প্রতীকটি নিঃশেষ হবে কেন?
যেখানে নির্যাতন থাকবে সেখানেই চে গুয়েভারা মূর্ত হয়ে আত্মপ্রকাশ করবেন। তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে কেন? কিউবার বিপ্লব সফল হওয়ার পর ফিদেল কাস্ত্রো তাকে মন্ত্রী করেছিলেন। অনেকে মনে করেছিলেন রণক্লান্ত চে গুয়েভারা হয়ত কয়দিন মন্ত্রীত্বও করবেন আর বিশ্রামও নেবেন। কিন্তু তিনি বেশি দিন মন্ত্রীত্ব করলেন না। মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে আবার নির্যাতিত শোষিত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
ষোড়শ লুইকে উৎখাত করে, বাস্তিল ধ্বংস করে ফরাসী বিপ্লব সম্পন্ন করা হলো- আর নেপোলিয়ান ক্ষমতায় বসলেন। কয়দিন পরে তিনিই সম্রাট হলেন। ইতালীর কিছু জায়গা দখল করে ভাইকে সেখানকার সম্রাট বানালেন।
চে গুয়েভারা ইতিহাসের এমতো গৎবাধা পরিক্রমার বাইরের মানুষ। তার জীবন থেকে বিচ্ছুরিত আলো, ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝে প্রবাহিত কর্মধারা তাকে এমন এক মানুষ হিসাবে তৈরি করেছে এবং মানুষের কাছে উপস্থিত করেছে তাকে ফরাসী দার্শনিক জ্যঁপল সার্ত্র বলেছেন- বিশ্ব শতকের একজন সম্পূর্ণ মানুষ।

অনেকে চে  গুয়েভারাকে তুলনা করেছেন দ্বাদশ শতকের রাজা আর্থারের সঙ্গে। আর্থার পূর্ব ফ্রান্সে রোমান সেনাদের পরাজিত করে আবার দ্বিতীয় এক যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন। অতুলনীয় দেশপ্রেম নিয়ে ফ্রান্সের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আর্থার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়েছিলেন রোমানদের বিরুদ্বে। তার অসামান্য দৃঢ়তার কথা গত আটশত বছরব্যাপী ফরাসী ও ইংরেজি সাহিত্যে বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়েছে। লোকে তাকে প্রেরণার উৎস হিসেবে মেনে থাকে। চে গুয়েভারা মধ্যে আর্থারের গুণাবলী ছিল। তিনিও আর্থারের মতো নিজের বিশ্বাসের জন্য সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ করতে কখনও দ্বিধা করেননি। ল্যাটিন ও আমেরিকার এ অসামান্য গেরিলা যোদ্ধার সব কিছুই কিংবদন্তীর মতো।

তাকে নিয়ে ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ৭০টি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। চে গুয়েভারা শহীদ, যুবা বয়সের লোক, সুদর্শন, বেপরোয়া ও দুঃসাহসী। তিনি চেয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়ানক যারা লেটিন আমেরিকার দেশে দেশে ক্ষমতায় বসে সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণের প্রক্রিয়ায় সহায়তা করছে তাদেরকে উচ্ছেদ করে মানুষের রাজ কায়েম করতে। সে কাজে তার অব্যাহত প্রচেষ্টা ছিল। সে কাজে জীবনও হারিয়েছেন।

গুয়েভারা ইতিহাসের একটি সময়ে জন্ম নিলেও শুধু সে সময়ের মাঝে তিনি সীমাবদ্ধ নন। অনন্তকাল তিনি জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রেরণা হয়ে জীবিত থাকবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এ বিশ্বায়নের যুগে যেভাবে চে গুয়াভারাকে মানুষ স্মরণ করবে তার আদর্শের ও আত্ম-ত্যাগের কাহিনি পর্যালোচনা করে নতুন মুক্তির পথ সন্ধান করবে সেভাবে তা করা হচ্ছে না। চে সর্বব্যাপী হয়েছেন সত্য কিন্তু তা প্রকাশ পেয়েছে তার প্রতিমূর্তি মগে, খেলোয়াড়ের জার্সিতে, চাবির রিংয়ে, গয়নায়, নাটকে, শিল্প প্রদর্শনীতে। যতই তার প্রতি মহত্ব, দেবত্ব আরোপ করা হচ্ছে ততই তিনি আসল চে’ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। ছবির ফ্রেমে আটকা পড়ছেন। কিংবদন্তী যেন তাকে গিলে খাচ্ছে।

ল্যাটিন  আমেরিকার সব দেশে দেশে এখন প্রেসিডেন্টের দফতরে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে সরকারি অফিসে চে এর ছবি টাঙানো হচ্ছে এমন কী বলিভিয়াও কিন্তু হচ্ছে চে পূজার আয়োজন। কিউবায় প্রতিদিন স্কুলে ছাত্ররা গান করে স্মরণ করে চে গুয়েভারাকে ‘আমরা সবাই চে হব’। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট এভো মোরালেস সাংবাদিক সম্মেলন করেন চে’র প্রতিকৃতি নিয়ে। চে গুয়েভারা এখন সারা লেতিন আমেরিকার আপনজন।

বিশ্বের মাঝে দুজন গেরিলাযুদ্ধের সংগঠক পূজনীয় হিসাবে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে আসন দখল করে আছেন। মানুষের মুক্তির নেশাই ছিল এ দুজনের ধ্যান জ্ঞান। হো-চি-মিন আর চে গুয়েভারা। অনেকে প্রশ্ন উত্থাপন করেন কে বড় কে ছোট।  এ প্রশ্ন অবান্তর। হো মুক্ত ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন সত্য। না হলে হয় না এ জন্যই হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ভবন তার জন্য বরাদ্দ ছিল সত্য কিন্তু থাকতেন প্রেসিডেন্ট ভবনের পেছনে ৪র্থ শ্রেণির এক স্টাফের কোয়াটারে।

জ্যোতি বসুর সংবর্ধনা সভায় কলকাতায় এসেছিলেন। মঞ্চে সাধারণ পোষাকে চপ্পল পায়ে বসা। অনেকে মনে করেছিলেন কোনও এক সন্ত্রাসী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভের্সাই চুক্তির প্রণয়নের সভায় দুইজন বেসরকারি লোককে সাম্রাজ্যবাদের শিরোমনিরা ডেকেছিলেন এবং তারা যোগদানও করেছিলেন। একজন হলেন তুরস্কের কামাল পাশা এবং অন্যজন ছিলেন ভিয়েতনামের হো-চি-মিন। কোনও স্তরে হো অবজ্ঞার পাত্র ছিলেন না।

অনেকে চে গুয়েভারার ব্যর্থতার কথা বলতে সোচ্চার। চে কেন বলিভিয়ায় গেলেন? চে গুয়েভারা কখনও বলিভিয়ায় ব্যর্থ হতেন না যদি বলিভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি সহযোগিতা করতো। সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন জানি না চে গুয়েভারাকে পছন্দ করতেন না। সোভিয়েত এক সময় কাস্ত্রোকে পরামর্শ দিয়েছিলো যেন চে গুয়েভারাকে কোনও সহযোগিতা না করেন। কাস্ত্রো নিজের প্রেসিডেন্ট পদটাকে অনিরাপদ করতে কখনও রাজি ছিলেন না। আমেরিকার ৯০ মাইল দূরে তাকে টিকে থাকতে হলে সোভিয়েত’র সমর্থনের প্রয়োজন। তাই তিনি সোভিয়েতের পরামর্শের এক পাও বাইরে যাননি।

চে  গুয়েভারা চীন এর মাও সে তুং এর কাছেও লেটিন আমেরিকার মুক্তি সংগ্রামে সাহায্য চেয়েছিলেন। কেউই এগিয়ে আসেননি। আসলে চে গুয়েভারা কমিউনিস্টদের প্রতিহিংসার বলি। যৌথ চেতনাই ছিল সফলতা পাওয়ার উপায় কিন্তু দুর্ভাগ্য যে বলিভিয়ায় চে গুয়েভারা কারও সহযোগিতা পাননি। এভাবেই এক চীর বিদ্রোহীর জীবনের অবসান হয় বলিভিয়ার জঙ্গলে গুলির আঘাতে ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর। জয়তু-চে গুয়েভারা।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমা ‌‘অমীমাংসিত’ প্রদর্শনে অযোগ্য!
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমা ‌‘অমীমাংসিত’ প্রদর্শনে অযোগ্য!
মোদি ও রাহুলের বিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ, ইসির নোটিশ
মোদি ও রাহুলের বিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ, ইসির নোটিশ
টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১৪ পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি
টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১৪ পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ