X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘আমি কান পেতে রই’

শারফুদ্দিন আনাম
০৯ অক্টোবর ২০১৬, ১৮:৪৯আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৬, ১৬:৪৮

শারফুদ্দিন আনাম প্রচণ্ড ধারালো, শান দেওয়া একটা সময় পার করছি সবাই। সময়ের ছোঁয়া যেখানে লাগছে, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে সব অস্তিত্ব, ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে পরম যত্নে লালন করা একেকটা স্বপ্ন। বাজ পড়লে বিদ্যুতের আলোর ঝলকানি দেখার অনেক পরে যেমন শব্দের অস্তিত্ব কানের ভেতরের পথ বেয়ে অন্তরাত্মা নাড়িয়ে দেয়; চমকে ওঠাটা তখন যেমন একটু বিলম্বে, একেবারে তেমন করেই সময়ের আঘাতে ঝাঁঝরা হতে হতে একেবারে নিঃশ্বেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে আমাদের চৈতন্য জাগে। তখন আহাজারি করি, হাহাকার ওঠে উত্তর থেকে দক্ষিণে কিংবা পূর্বে-পশ্চিমে। তখন মস্তিস্কের ভেতরে প্রবল স্রোতে কোনও এক অচেনা তরলের ক্ষরণ পুরো শরীর জুড়ে বোধ হয়। তবে সে তরল আর যাই হোক, রক্ত নয়। আমাদের রক্ত সে তো কবেই শুকিয়ে গেছে। মাটির এই শরীরটাতে আর ওঠে না লোনাখুনের ঝড়। এখন যে ক্ষরণ ভেতরে হয়, তা কেবলই এঁকে চলে বেদনায় ভারাক্রান্ত ছোট্ট এক টুকরো আর্তনাদের অশ্রুনদীর বলিরেখা। তবু জীবন বয়ে চলতে হয়, বইতে হয় বলেই।
যখন এই কথাগুলো লিখছি, তখন খাদিজা আক্তার নার্গিস নামের সিলেটের এক তরুণী চাপাতির একের পর এক আঘাতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। লেখাটি যখন বের হবে, তখন তার বেঁচে যাওয়া কিংবা চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি হয়তো নিষ্পত্তি হয়ে যাবে, অথবা নিয়মের কঠিন বেড়াজাল মেনে ঝুলে থাকার আরেকটা উদাহরণ তৈরি করবে। কিন্তু এই মনের অন্তরালে যে ক্ষরণের কথা বলছিলাম, তার নিষ্পত্তি কে করবে? কিভাবে মোছা যাবে সেই বলিরেখা, কিভাবে সম্ভব? নাকি সত্যিই অসম্ভব? জানি না, জানার শক্তিটুকুও আর অনুভব করি না। শুধু মনে হয়, পাহাড় ঠেলার চেয়েও অনেক বেশি শক্তি নিঙ্‌ড়ে শূন্যের মাঝে মহাবিশ্বকে ক্রমাগত ঠেলে যাচ্ছি।
খাদিজাকে কেন এভাবে কুপিয়ে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে ফেলে রাখা হলো, কার দোষ কতখানি, এর পেছনের প্লট কী?— আইনের মারপ্যাঁচে একেএকে অনেক কথাই আসবে। দোষগুণ বিচার করতে বসিনি আজ, কিন্তু একটা মানুষকে কসাইয়ের দোকানে মাংস কোপানোর মতো একজন কুপিয়ে যাচ্ছে, কুপিয়েই যাচ্ছে। অন্যজন পড়ে আছে নিথর দেহে, প্রতিবাদহীন, প্রতিরোধহীন, নিষ্প্রাণ। কীই বা করতে পারবে সে। বাকিরা মোবাইলে ভিডিও করতে কতই না ব্যস্ত ! আজ সাগর-রুনির পথ ধরে তনু, মিতু, রিশা হয়ে খাদিজার মাথার খুলিতে যে জিঘাংসার রেখা আঁকা হলো, সে দায় কার? একদিকে অপরাধী অপরাধ করে, আরেকদিকে রাজনীতিবিদ বিচারের গান গলায় তুলে ২৪/৪৮/৭২/৯৬ ঘণ্টার ছন্দমেলানো লিরিকে গান রচে যান একের পর এক। অপরাধীও তখন নানারকম ব্যানারে আশ্রয় খুঁজে নেওয়ার স্বপ্ন দেখে। কখনও কখনও তার সে স্বপ্ন পূরণও হয়।

সাগর-রুনিকে প্রেতাত্মা মেরেছে, তনুকে মেরেছে বনের জন্তু, মিতু মরেছে মহাশূন্য থেকে আগত এক অজ্ঞাত শক্তির হাতে, গল্পের খাতিরে সবই মেনে নিচ্ছি। আচ্ছা, বদরুলের হাতের চাপাতি কি পার্থিব? নাকি তাতেও গ্রাফিক্সের ভার্চুয়াল কারুকাজ থাকার গল্প শুনব কদিন পর, জানি না। হয়তো ‘আরও চাপাতি ও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার’ করতে গিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ মৃত্যুও হতে পারে তার। প্রধানমন্ত্রী যখন ঘটনায় হাত দিয়েছেন, ধরে নিতে পারি বদরুলের বিচার হবে। কিন্তু তাতে তো খাদিজার স্বাভাবিক জীবন ফিরবে না, তাতে তো রিশাও ফিরে আসবে না মায়ের কোলে, মিতুর বুকে তার দুই সন্তান তো আর উষ্ণতা খুঁজে পাবে না, তনুর কণ্ঠে আর উঠবে না নাটকের সংলাপ, মেঘ আর কোনও দিনই বৃষ্টি হয়ে ঝরবে না রুনি-সাগরের অস্তিত্বজুড়ে। তিলতিল করে বুকে আগলে রেখে মা-বাবা তার সন্তানকে বড় করবে, নিজের সব রক্ত ঘামে পরিণত করে, নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাইয়ে চোখের সামনে ছোট্ট এতটুকুন শরীরটা একটু একটু করে বড় করবে। শেষে সব যখন পরিপূর্ণতায় টইটুম্বুর, তখনই পেছন থেকে কোনও এক কালো শক্তি এসে ওই শরীরটার সব রক্ত মাটিতে বইয়ে দেবে। আমি আপনি আমরা সেই লাশ বুকে করে আবেদন জানাব দ্বারেদ্বারে। ছুটতে ছুটতে পা যখন আর চলবে না, তখনই নতুন করে ঘটে যাবে আরেকটা নৃশংসতা। তখন আগের সব ঘটনাগুলোয় শেকড় গজাবে। সেই শেকড়ের ওপরে তৈরি হবে প্রত্যাশার একেকটা মহিরূহ। সেখানে বৃক্ষের শাখা আর দুলবে না, পাতায়-পাতায় আর প্রাণের বাতাস বইবে না। পাতার বদলে সেখানে কেবল ঝুলবে অদৃশ্য ঘড়ি। হয়তো সে ঘড়ির তিনটি কাঁটায় সাগর, রুনি, তনু, মিতু, রিশা কিংবা খাদিজাদের সময় ঘুরবে অনন্তকাল। জানি মৃতরা আর ফেরে না। তবু নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে হয়, বাঁচাতে ইচ্ছা হয়, ফেরাতে ইচ্ছা করে ফেলে আসা পথের বাঁকে হারিয়ে ফেলা এই চেনা মুখগুলো। আজও বাতাসে আমি কান পেতে রই। ভীষণ কালো এক নিস্তব্ধতার মাঝে পরাজিত শুভ্র আত্মাগুলোর প্রচণ্ড এক আর্তচিৎকারে মধ্যরাতে নিজের শয়ানে কেঁপে কেঁপে উঠি। 

লেখক: সহযোগী বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ