X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং আমাদের বিদ্যুৎ ভাবনা

আনিস আলমগীর
১১ অক্টোবর ২০১৬, ১৫:২৬আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০১৬, ১৮:১৭

আনিস আলমগীর হলিউড একটা থ্রিলার ছবি তৈরি করেছিল গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে- ‘দ্য ডে আফটার টুমরো’। ছবিটা ভয়াবহ। ছবির প্রতিপ্রাদ্য বিষয় গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে বরফ যুগ আরম্ভ হয়েছে আমেরিকায়। হাজার হাজার লোক একটু রোদের আশায় মেক্সিকোর দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। নিউ ইয়র্ক জনমানব শূন্য। নেকড়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। টোকিওতে বরফ-বৃষ্টিতে এক কোমর বরফ জমেছে।
ফক্স স্টুডিও নির্মিত এ ছবির কাহিনীকার মাইকেল ক্রাইটন। তার দ্বিতীয় বই ‘স্টেট অব ফিয়ার’ নিয়ে আর একটা থ্রিলার নির্মাণ করতে পারে ফক্স। বইটার বিষয় হচ্ছে পরিবেশ। এ বইটির উপজীব্য হচ্ছে পরিবেশবাদীরা পরিবেশ রক্ষার নামে কী ভয়াবহ হয়ে উঠেছে তার এক লোমহর্ষক কাহিনী। এ কাহিনী শেষ করে ক্রাইটন মন্তব্য করেছেন বিজ্ঞানের সঙ্গে রাজনীতি মেশালে খারাপ ফলেরই বহির্প্রকাশ হয়। ক্রাইটনের ‘স্টেট অব ফিয়ার’ -এ বর্ণিত কাহিনী সত্য কিনা জানি না, আর পরিবেশবাদ সন্ত্রাসবাদের রূপ ধারণ করেছে কিনা তাও সঠিকভাবে জানি না তবে পরিবেশবাদীদের আন্দোলনে নানাভাবে নানা-দেশে নানারূপে যে রাজনীতি ঢুকেছে তা উপলব্ধি করতে কারও কষ্ট হয় না।
পরিবেশবাদীদের নানা আন্দোলনের রূপ রং দেখে রাজনীতির বিষয়টা নানা দেশে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রমের কিছু নেই। কিওটোর স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী কার্বন ডাই অক্সাইড এর মতো গ্যাসের উৎপাদন কমানোর ব্যাপারে পৃথিবীর সব দেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। এটাকেই বলে গ্রিন-হাউস গ্যাস। এ গ্যাস পৃথিবীর আবহাওয়ায় একটা আস্তরণ তৈরি করে। ফলে এ আস্তরণ ভেদ করে পৃথিবীর তাপ ছড়িয়ে যেতে পারে না দূর আকাশে। তাই আবহাওয়ায় গ্যাসের পরিমাণ যত বাড়ে পৃথিবীর উত্তাপও ততো বৃদ্ধি পায় আর এ কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন হয়।

কিওটোর প্রোটোকল বলবৎ হয় ২০০৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে। কিন্তু, তাতে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন-হাউস গ্যাস কমার বিষয় নিয়ে আশা সৃষ্টি হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। চীন ও ভারত যথেষ্ট সংযমের পরিচয় না দিলে এবং শিল্প উন্নত দেশগুলো সহযোগিতা না করলে বায়ুমণ্ডলে গ্যাস কমানো যাবে না। ২০০৫ সালেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ বলেছিলেন যে আমেরিকা এ চুক্তি মানবে না। অবশ্য পরবর্তী সময়ে বারাক ওবামা সহযোগিতার কথাই বলেছেন এবং প্যারিসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ভালো ভূমিকাই পালন করেছিলেন।

ক্রাইটনের কাহিনী বানানো হতে পারে তবে গ্রিন হাউস গ্যাস যে পৃথিবীকে কুড়ে খাচ্ছে এবং এক ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা নিয়ে তো কোনও দেশে কোনও স্তরে বিরোধ নেই। আড়াই হাজার বিজ্ঞানী নিয়ে গঠিত ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, রাষ্ট্রপুঞ্জকে পরামর্শ দিচ্ছে পরিবেশ বিষয়ে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাইক্লোন বিষয়ক কমিটি বহুবার বলেছে বর্তমানে যে সব হারিকেন পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আঘাত হানছে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে আবহাওয়ার পরিবর্তন। অবশ্য বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার ল্যান্ডসি এ অভিমত বাস্তবতার ভিত্তিতে নয় বলে অভিমত দিয়েছেন।

তিন শ’ বিজ্ঞানী মিলে ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট আসেসম্যান্ট রিপোট তৈরি করেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে এ শতাব্দীর শেষের দিকে সুমেরু অঞ্চলের স্থলভাগের তাপমাত্রা বাড়বে তিন ডিগ্রি থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড আর জলভাগের তাপমাত্রা বাড়বে সাত ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তাতে বরফ গলবে এবং জলের আয়তন বাড়বে কিন্তু বিপদ অন্যখানে। সুমেরু এলাকায় সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বাড়লে তার আয়তন এতটা বাড়বে যে পৃথিবীর অনেক এলাকা সমুদ্রের তলদেশে চলে যাবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন এর ফলে প্লাবিত হয়ে যাবে সমুদ্র উপকূলবর্তী বা নদী উপকূলবর্তী কিছু শহর। যেমন, আমস্টাডাম, লন্ডন, ম্যানিলা, ফ্লোরিডা, কলকাতা। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এক তৃতীয়াংশ জায়গাও প্লাবিত হবে, তাতে দেড় কোটি লোক বাস্তুভিটা হারাবে। মালদ্বীপ নাকি তলিয়ে যাবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন বিপদের সম্মুখীন হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে। বিদ্যুৎ নিয়ে বাংলাদেশের বিপদের সীমা নেই। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয় হয় জল দিয়ে, না হয় কয়লা পোড়ানো তাপ দিয়ে অথবা পরমাণু শক্তি থেকে। জল ছাড়া পরিবেশবিদদের কয়লা অথবা পরমাণু দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে ঘোর আপত্তি রয়েছে। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে পরমাণু বিষয়ে পরিবেশবাদীদের উপলব্ধি পরিষ্কার হচ্ছে।

এক গ্রাম ইউরিনিয়ামের মাঝে রয়েছে আড়াই টন কয়লা পুড়িয়ে পাওয়া তাপের সমান পরিমাণ শক্তি। এখন বহুদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চীন ২৬টি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে গেছে, ২০২৫ সালের মাঝে চীন এ ২৬টি প্রজেক্টের কাজ সম্পূর্ণ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। ব্রিটেনও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। গ্রিন পিস সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা প্যাট্রিক মুর বলেছেন- পরিবেশবাদীদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ বিষয়ে বিরোধিতা স্থগিত করা উচিৎ।

বাংলাদেশও রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। ১৯৮৬ সালে ইউক্রেনের চেরনোবিল, ১৯৭৭ সালে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার থ্রি মাইল আইল্যান্ডে এবং ১৯৯২ সালে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার কারণে পরিবেশবাদীরা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে মানুষের মাঝে আতংক ছড়ায়। কিন্তু প্রতি বছর তাপ বিদ্যুতের প্রধান কাঁচামাল কয়লা তুলতে গিয়ে যে পরিমাণ মানুষ খনিতে মারা যায় সে পরিমাণ মানুষ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে মরলে পরিবেশবাদীরা আকাশ ফাটাতেন।

গত বছর শুধু চীনে কয়লা খনিতে মানুষ মরেছে ৫,২০০ জন। আমেরিকায় এত বেশি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে যে সম্প্রতি হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর এক সমীক্ষায় জানিয়েছে, আমেরিকার তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যে দূষণ ছড়ায় তাতে প্রতিবছর আমেরিকায় ১৫,০০০ মানুষ মারা যায়। ১,০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যে পরিমাণ ক্ষতিকর পদার্থ বায়ুমণ্ডলে ছড়ায় ১,০০০ মেগাওয়াটের তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র তার চেয়ে ১০০ গুণ বেশি দূষণ ছড়ায়।

বাংলাদেশ রূপপুরে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে তা স্থাপন করছে রাশিয়া। এতদিন আমরা শুনেছি যে কেন্দ্রটিতে যে বর্জ্য হবে তা সরানো ও ধ্বংস করার দায়িত্ব রাশিয়া নিয়েছে। এখন শুনছি রাশিয়া সে দায়িত্ব নেয়নি। বর্জ্য নিয়েও কম মাথা ব্যাথা নয়, সুতরাং এ বিষয়টা নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট সুস্পষ্ট একটা সমাধানে আসা জরুরি।

বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ। তার উৎপাদিত বিদ্যুতের ব্যবহারকারীরাও দরিদ্র। সুতরাং বিদ্যুতের দামও সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হয়। সে হিসাবে জল বিদ্যুৎই হচ্ছে কম মূল্যে পাওয়া বিদ্যুৎ, কিন্তু কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রজেক্ট ভিন্ন বাংলাদেশে আর কোনও প্রজেক্ট নেই এবং জল বিদ্যুতের আর কোনও প্রজেক্ট হওয়ারও সম্ভবনাও নেই।

বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র বর্তমানে বড় পুকুরিয়া ছাড়া আর কোথাও নেই। সরকার রামপাল, পায়রা ও মাতারবাড়ীতে আরও তিনটি ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় একজন সোচ্চার সদস্য তাই এরপর আর কোনও তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ হবে না। কারণ এটা স্বীকৃত সত্য যে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেই বেশি বায়ু দূষণ হয়।

সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায়। ভারতও সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং আগামী পাঁচ বছরে নাকি ভারত ১ লাখ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এখন থেকেই বাংলাদেশ সরকারও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশও পাঁচ বছরের মাঝে ভারতের মতো ১ লাখ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে যা কারও বিরোধিতার মুখেও পড়বে না এবং এই বিদ্যুতের মূল্যও কম হবে।

সর্বোপরি গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও গ্যাস শেষ হলে বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং বিদ্যুৎ সেক্টরে ভয়াবহ বিপর্যয় আসার আগেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করা উচিৎ। বিদ্যুৎ এর মতো জরুরি বিষয় বিদেশ থেকে আমদানির বিষয়ে দীর্ঘ মেয়াদি নির্ভর করাও উচিৎ নয়। নেপালে ও ভুটানে বাংলাদেশ যৌথভাবে জল বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে শতবার চিন্তা করে দেখা উচিত। কারণ, নেপাল-ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আনতে হলে ভারতীয় গ্রিড ব্যবহার করতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের প্রতিবেশী নেপালের সঙ্গে ভারতের আচরণ খুব মানবিক ছিল না। সুতরাং ভারতীয় গ্রিড ব্যবহার করে বিদ্যুৎ আনলে এবং ভারতের সঙ্গে দেশগুলোর কোনও বিষয়ে মনোমালিন্য হলে বিদ্যুৎতের বিপর্যয় হয়ত দেখা দিতে পারে। সুতরাং এমন ঝুঁকিতে না যাওয়াই উত্তম। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক চিরদিন মধুর থাকবে তারও তো নিশ্চয়তা নেই। তাই ভেবে চিন্তে কাজ করাই উত্তম হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ