X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে ফেসবুক বন্ধের প্রস্তাব কেন?

সিয়াম সারোয়ার জামিল
১৩ অক্টোবর ২০১৬, ২০:০৪আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০১৬, ২১:২৮

সিয়াম সারোয়ার জামিল গত কয়েক বছরে দেশের শিক্ষাখাতে বড় দু’টি ঘটনা ঘটেছে। প্রথমটা অনেক সুখের, হাইব্রিড বেগুন উৎপাদনের মতো জিপিএ-৫ এর বাম্পার ফলন হয়েছে। লাখ লাখ শিক্ষার্থী 'শিক্ষিত' হয়ে দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করছে। দ্বিতীয়টা বুকে আঘাত করার মতো, প্রায় প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষা আন্দোলন কর্মীদের অনেকেই ঘটনা দু’টির যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। তারা বলছেন, জিপিএ-৫ এবং পাসের হার বাড়াতেই হচ্ছে এই ‘প্রশ্নফাঁস’।
টেলিভিশনের টকশো, পত্রিকার কলাম কিংবা সামাজিক মাধ্যমে কড়া সমালোচনা হলেও প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ আসা বন্ধ হয়নি। প্রাথমিকের সমাপনী থেকে শুরু করে পিএসসি পর্যন্ত এই 'অসহ্য যন্ত্রণা' এখন 'ট্রাডিশনে' পরিণত হয়ে গেছে। যদিও সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রশ্নফাঁস রোধে নানা প্রক্রিয়া, নিষেধাজ্ঞা আরোপ ধারাবাহিকভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে। এবছর মেডিক্যাল ভর্তির প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও হয়েছে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, চলতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী (জেএসসি) পরীক্ষা চলাকালীন ফেসবুক বন্ধ রাখার পক্ষে আলোচনা করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে এবং সেখানে অনেকে ফেসবুক বন্ধ রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রশ্নফাঁস রোধ করতেই  নাকি এ ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে কোচিং সেন্টারগুলোয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকবে। ফটোকপির দোকান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশের ডিআইজি ও এসবিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্রে জেনে এসব খবর বেশ গুরুত্ব নিয়েই ছেপেছে।
ফেসবুক বন্ধ রাখার পক্ষে ওই কমিটির সদস্যদের এমন পরামর্শ ও প্রস্তাবের সংবাদ প্রকাশের  স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ফেসবুক বন্ধ করলেই প্রশ্নফাঁস বন্ধ হয়ে যাবে? হোয়াটস আপ, ভাইবার, ট্যাঙ্গো দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস হবে না? আচ্ছা সেসবও বন্ধ করে দেওয়া হলো। তাতেও কি কোনও ফল মিলবে? দেশের বড় একটা অংশ ফেসবুকের মাধ্যমে জীবনজীবিকায় সম্পৃক্ত। ফেসবুক বন্ধ হলে তাদের আর্থিক লোকসান গুনতে হবে। সেটাই বা কে দেবে? ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ এই সব সিদ্ধান্ত সরকারের হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ন্যূনতম দায়িত্বশীলতা থাকলে এসব সিদ্ধান্ত নিতে পারত না মন্ত্রণালয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে পাবলিক পরীক্ষা এবং প্রশ্নফাঁসকে কেন্দ্র করে গোটা শিক্ষার সংকট; আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণের সার্বিক চিত্র উপস্থিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

দুই.

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় পৌনে দু’কোটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। তাদের টার্গেট করে বেসিসের হিসাব অনুযায়ী দেশে প্রায় ১৩ হাজার ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে নানা রকম পণ্য। যার মধ্যে কসমেটিকস, ইলেক্ট্রনিকস ও পোশাক অন্যতম। যে ব্যবসা বর্তমানে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় শতভাগ অর্ডার আসে ফেসবুকের মাধ্যমে। ফেসবুকের মাধ্যমে যে ব্যবসাটা হয়, ফেসবুক বন্ধ হলে তা একদম শূন্যে নেমে আসবে। 

বেশিরভাগ ব্যবহারকারী ফেসবুকে ঢুকতে না পারার থাকার কারণে সমস্যায় পড়বে অনলাইন গণমাধ্যমগুলোও। খুব সহজ একটি যোগাযোগ মাধ্যম হওয়ার কারণে বাংলাদেশে ফেসবুকের ব্যবহার খুব দ্রুত বেড়েছে। এর ওপর নির্ভরতাও বেড়েছে। ফেসবুক বন্ধ থাকলে এসব প্রতিষ্ঠান ও তাদের সঙ্গে যুক্তরা কর্মহীন হয়ে পড়বে। অবিক্রিত পড়ে থাকবে কোটি কোটি টাকার পণ্য। গত বছর যখন টানা তিন সপ্তাহ বন্ধ হয়েছিল ফেসবুক, ওই সময়ের ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি অনলাইনের ব্যবসায়ীরা।

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এখন শিক্ষা কার্যক্রমেও ঢুকে পড়েছে ফেসবুক। সরকারি-বেসরকারি বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত করে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে। তাই হুট করে ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মাঝে সৃষ্টি হবে এক ধরনের হতাশা। প্রায় প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি বিষয়ের জন্য খোলা হয় পৃথক পৃথক ফেসবুক গ্রুপ। এই সব গ্রুপের অ্যাডমিন থাকেন শিক্ষকেরা। পুরো সেমিস্টারের সব তথ্য ওই সব গ্রুপে দেওয়া থাকে। তেমন কিছু ঘটলে সংকটে পড়বে শিক্ষার্থীরাও। 

শুধু কি তাই? কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সেন্টমার্টিন, পাহাড়ি অঞ্চলের মতো সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে দেশের। এসব স্থানে ভ্রমণের নানা তথ্য তুলে ধরা হয় ফেসবুক পেজে। সেখান থেকে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা তথ্য সংগ্রহ করে পর্যটন কেন্দ্রগুলো ভ্রমণ করেন। কিন্তু ফেসবুক বন্ধ করলে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন না দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা। ফলে চরম অন্ধকারে পড়বে সম্ভাবনাময় এই খাতটি। গত বছর টানা তিন সপ্তাহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকায় বড় ধরনের লোকসানে পড়ে দেশের পর্যটন খাতের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সে সময় অনেক প্রতিষ্ঠানেই হয়েছে কর্মী ছাটাই। 

তিন.

ব্রাজিলের দার্শনিক পাওলো ফ্রেইরির মতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় থাকে দু’টি পক্ষ- শিক্ষক আর ছাত্র। শিক্ষক মনে করেন তিনি সব জানেন। ছাত্ররা মনে করে তারা কিছুই জানে না আর শিক্ষক সব জানেন। তাই জানতে হবে শিক্ষকের কাছ থেকেই। নিজেরা একে অন্যের কাছ থেকে কিছুই শিখতে পারে না। একের পর এক সারিতে বসা, শিক্ষক ছাড়া অন্যের কাছ থেকে জানতে না চাওয়া এবং শিক্ষকের প্রশ্নের জবাব দেওয়া ইত্যাদি আয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য। এর ব্যত্যয় করা শাস্তিযোগ্য। আমাদের দেশেও কিন্তু একই অবস্থা। রাষ্ট্র মনে করে সে সব বোঝে, এমন হঠকারি সিদ্ধান্ত বারবার নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়, সে দেউলিয়া হওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এখানে, না রাষ্ট্র জনগণ থেকে কিছু শিখছে, না জনগণ রাষ্ট্রের দেউলিয়া হওয়া দেখে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এরকম আয়োজন জাতিকে কী দিচ্ছে? রাষ্ট্রকে সরব রাখছে। বিপরীতে জনগণ নীরব থাকছে। শহর থেকে যাওয়া আমলা যিনি জীবনে কৃষিকাজ করেননি তিনিও গ্রামে গিয়ে কৃষককে উপদেশ দিতে ছাড়ছেন না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এই আদলেই গড়ে উঠেছে আমাদের সমাজ।
বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ হওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। একাধিকবার বন্ধ করা হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে  আইনশৃঙ্খলা অবনতি হতে পারে, এমন আশঙ্কায় ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এর আগেও ধর্মীয় অবমাননাকর কন্টেন্টের কারণে ফেসবুক বন্ধ করা হয়েছিল। তবে সবসময় তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনায় পড়েছে সরকার। মানুষ উড়োজাহাজে উড়ে যাওয়া শেখার পর আর জাহাজে করে সাত সমুদ্র পাড়ি দিতে চায় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বন্ধুত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করেছে, সহজ করেছে প্রেম পরিণয়, মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড। মানুষের চিন্তা ভাব-বিনিময়ের প্রসার ঘটিয়েছে। মানুষে মানুষে বন্ধুত্বের জায়গা করেছে।

সেই ফেসবুক যখনই বন্ধ হয়েছে, প্রত্যেকবার তরুণরা বিকল্প পথ বের করেছে। ফেসবুক বন্ধ করলেই প্রশ্নফাঁস বন্ধ হয়ে যাবে না, এটা বোঝানোর মতো রাষ্ট্রে কেউ নাই? হোয়াটস আপ, ভাইবারে পাঠানো যাবে না? আচ্ছা, সবগুলোই বন্ধ করে দেওয়া হলো, প্রক্সি সফটওয়্যার আছে না? গত বছর যখন সাকা চৌধুরীর ফাঁসি হলো তখন টানা ফেসবুক বন্ধে দেশব্যাপী জনপ্রিয় হয়েছিল প্রক্সি সফটওয়্যার। যার মধ্য দিয়ে আইপি চেঞ্জ করে ফেসবুক ব্যবহার করত সবাই অনেকেটা 'ওপেন সিক্রেটের' মতো। 

এসব ঠুনকো প্রযুক্তির ব্যবহার যেখানে সাধারণ জনগণও বোঝে, অপরাধীরা বুঝবে না? মাথাব্যথা করলে মাথা কেটে ফেলাটা সমাধান নয়, এটা সবাই বোঝে এখন। শুধু সরকার বোঝে না। 

চার.

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনি অঙ্গীকার ছিল ২০২১ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ এক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা। কিন্তু গত আট বছরে বছরে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’  কথাটি সম্পর্কে ধারণা কতটা স্পষ্ট হয়েছে?  

এটা স্পষ্ট যে, প্রশ্নফাঁসে প্রতিরোধ করতে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়। যারা প্রশ্ন ফাঁস করছে, তারা সরকারের মধ্যে বা তার আশপাশেই আছে। তাদের আগে আইনের আওতায় আনা জরুরি। অপরাধীদের না ধরে আজগুবি বা হঠকারি সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভালো হবে না। বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নইলে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমন ব্যক্তি। এর মধ্যে একজন ইউজিসির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও জড়িত ছিলেন। যিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন। কিন্তু তার তদন্ত রিপোর্ট কি  আলোর মুখ দেখেছে?

লেখাটা শেষ করব একটা কৌতুক দিয়ে। একবার স্বর্গের দেবতা আর নরকের শয়তানরা মিলে ক্রিকেট খেলার সিদ্ধান্ত নিল। দেবতারা খেলায় জয় নিয়ে খুবই আত্মবিশ্বাসী, নিয়মিত তারা ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং চর্চা কর। ভালো ভালো ক্রিকেটাররা স্বর্গে তাদের দলেই আছেন। কিন্তু শয়তানদের এনিয়ে চিন্তিত দেখা গেল না। তাদের নিশ্চিন্ত ভাবভঙ্গি দেখে এক দেবতা শয়তানদের ক্যাপ্টেনকে ডেকে বলল, ‘কী ব্যাপার, ভালো ভালো ব্যাটসম্যান তো সব আমাদের এখানে, কিন্তু তোমাদের বিশেষ চিন্তিত মনে হচ্ছে না!’ শয়তান দাঁত বের করে শয়তানি হাসি দিয়ে বলল, ‘তোমাদের যতই ব্যাটসম্যান থাকুক, আম্পায়ারগুলো তো সব আমাদের দলে’।

লেখক: সহকারী সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ